অভিলাসী মন চন্দ্রে না পাক, জোছনায় পাক সামান্য ঠাই বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকারের জন্য প্রধান না হলেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি।
পররাষ্ট্রনীতি ২ প্রকারের,
- আক্রমনাত্মক
- আত্মরক্ষামূলক!
আভ্যন্তরীন রাজনীতির মাঠে সুবিধা আদায় করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো অল্প সময়ের মাঝেই ইস্যু ভিত্তি করে ভিন্ন অবস্থান গ্রহন করলেও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে থাকতে হয় অনেক স্থির। এবং এটা যতটুকু ন্যায় এবং সততার ভিত্তিতে পরিচালিত হয় তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে!
প্রতিটা দেশের মূলনীতি হচ্ছে নিজ স্বার্থ রক্ষা এবং দেশ ও জাতি'র সমৃদ্ধি অর্জন।
কিন্তু এভাবে বলা মানে ব্যাপক অর্থে ইঙ্গিত করা। তাই পররাষ্ট্রনীতি'র ভিত্তি গঠনে দেশসমুহ প্রধানত / সাধারনত কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে সেটাই বের করবো।
আলোচনা নিদৃষ্ট কোন দেশ ভিত্তিক নয়, বরং সামগ্রিক, তাই সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে আগে দেখি বিশ্বের প্রতিটি দেশের অভিন্ন চাহিদাসমুহ কি?
-নিরাপত্তা
-স্বায়ত্তশাসন
-জনকল্যাণ
-মর্যাদা
মূলত এই ৪টি উদ্দেশ্য পুরণই জনতার তরফ থেকে পাওয়া সরকারের দায়িত্ব। এবং এসব দায়িত্ব পূরনে পররাষ্ট্রনীতি অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে।
পরবর্তী আলোচনায়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব / উদ্বেগগুলো কি?
কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে তারা কিভাবে চাহিদাগুলোকে মোকাবেলা করে?
একটি সচল, পরিবর্তনশীল, নাকি নিদৃষ্ট পররাষ্ট্রনীতি গ্রহন করে? এগুলোই সংক্ষেপে দেখার চেষ্টা করবো।
নিরাপত্তা :
প্রতিটি দেশের সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখা। হুমকি নানা দিক থেকে আসতে পারে, হুমকি আসতে পারে অপর কোন রাষ্ট্রের তরফ থেকে, হুমকি আসতে পারে বেসরকারী সন্ত্রাসী সংগঠনের তরফ থেকে সরকারের প্রতি অথবা জনগণের প্রতি অথবা সামাজিক আদর্শের প্রতি।
নিরাপত্তা রক্ষায় দেশগুলো প্রথমত নিজ সামরিক শক্তির উপরই নির্ভর করতে পছন্দ করলেও একদম শীর্ষ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো বাদে অন্য সবার জন্য তা প্রায় অসম্ভব! তাই অনেকেই আইসোলেশন ( অন্তরণ নীতি ) পলিসি গ্রহন করে। যেমন অতীতে ভুটান ও জাপান আর বর্তমানে, মায়ানমার!
অনেক দেশই সুইজারল্যান্ড / অস্ট্রিয়ার মত সার্বজনীন নিরপেক্ষতা ঘোষনা করে, আমাদের মত দেশগুলো আবার (ব্যার্থ) জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহন করে!
তবে বেশীর ভাগ রাষ্ট্রই প্রতিবেশী বা আঞ্চলিক মিত্রদের সাথে স্ট্র্যাটেজিক ( কৌশলগত ) কারনে নানা রকমের সামরিক জোট গঠন করে! ভৌগলিক অবস্থান নির্ভর এমন একটি জোট : ন্যাটো ( নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন ) যা প্রাথমিকভাবে ঐ অঞ্চলের দেশগুলোকে সোভিয়েত সামরিক হামলা মোকাবেলার লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল।
অনেক সময় আবার বিবাদপূর্ণ সম্পর্কও গ্রহন করতে হয়! যেই সব চুক্তি জোটবদ্ধ দেশগুলোর জন্য মেনে চলা কঠিন কিন্তু ভেঙ্গে ফেলা আরো কঠিন, যেমন, যুক্তরাষ্ট্র - পাপীস্তান! শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র পাপীস্তানকে কখনোই সমর্থন করে নাই আবার কখনোই একদম খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় নাই!
নিরাপত্তার ইস্যুতে প্রতিটি দেশকে অবশ্যই পররাষ্ট্রনীতি গ্রহন করতে হয়। তা হতে পারে আক্রমনাত্মক যা সচল পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে অন্যান্য দেশকে সরাসরি প্রভাবিত করবে , আবার হতে পারে আত্মরক্ষামূলক যা অন্য দেশের প্রভাব মোকাবেলায় গৃহীত হবে এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে আলোচনার জন্য মনোনীত হবে!
স্বায়ত্তশাসন :
আপনার-আমার যেমন অধিকার আছে কোন বহিঃশক্তি'র চাপের মুখে বাধ্য না হয়ে স্ব-ইচ্ছায় নিজ পছন্দের গান,আদর্শ অথবা প্রযুক্তি ব্যাবহারের, তেমনই প্রতিটা স্বাধীন রাষ্ট্রেরও স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে নিজেদের লক্ষঅর্জনের অধিকার রয়েছে। তবে, অবশ্যই তা গ্রহনযোগ্য চাহিদা হতে হবে, যেমন, "কোন রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এমন কোন চুক্তি সম্পন্ন করতে পারবে না!"
আমাদের মত গরিব দেশগুলোর জন্য এটি একটি কষ্টসাধ্য পলিসি! কারন বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর মত বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে টাকা ধার করে চলতে বাধ্য হওয়া আমাদের অনেক প্রকারের শর্ত মেনে নিয়ে টাকা নিতে হয়! এবং সেই সব শর্ত হয় বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া।
যা পরিষ্কারভাবে আমাদের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করে। ( যেমন পদ্মাসেতু ঘটনার পর টাকা পাওয়ার জন্য আমাদের মন্ত্রীসভার মন্ত্রী বদল )
এই স্বায়ত্তশাসন পলিসি সমুন্নত রাখতে হলে সংস্থাগুলোর কাছ থেকে "লোন" নেয়া বন্ধ করা ছাড়া কোন উপায় নেই!
ধনী দেশগুলোও এমন সমস্যা মোকাবেলা করে, যেমন ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে গৃহীত নানা সিদ্ধান্ত তার সদস্য দেশগুলোকে মানতে হয়!
অনেক দেশই হয়তো তার নিরাপত্তা অথবা জনকল্যাণের মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বিবেচনা করে স্বায়ত্তশাসনে ছাড় দিতে পারে।
মোটাদাগে বলা যায়, বহিঃশক্তির চাপের মুখে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া কোন সিদ্ধান্ত প্রতিহত করার ক্ষমতাই হচ্ছে স্বায়ত্তশাষন!
আর বহিঃশক্তির চাপ বা দাবী প্রতিহত করার জন্যই পররাষ্ট্রনীতি সচল রাখতে হয়। উদাঃ রাজাকার বিচারের বিষয়ে সরকারের উপর যেই চাপ আসছে মার্কিন বা ইউরোপীয়ানদের কাছ থেকে! সেসব মোকাবেলার জন্য আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এর কর্মচারীদের ব্যাবহার করবে।
জনকল্যাণ :
জনকল্যাণ বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের মূল দাবী।
এবং এটা পররাষ্ট্রনীতির উপর বর্তমান যুগে বিশেষ নির্ভরশীল। একটি সাধারন ও প্রচলিত তথ্য হচ্ছে, "সামাজিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাণিজ্যই মূল মন্ত্র"! যত বেশী বাণিজ্য তত বেশী সমৃদ্ধি! যেহেতু অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কই বেশী বাণিজ্যের নিশ্চয়তা দেয় তাই রাষ্ট্রগুলো সচল ফরেন পলিসি গ্রহনে বাধ্য!
রাষ্টগুলোকে দেখা যায় ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী মুক্তবাণিজ্য প্রমোট করার জন্য "গ্যাট" চুক্তি স্বাক্ষর করতে! কিন্তু সেখানে কাঙ্খিত ফল না পেয়ে সীমিত অঞ্চল জুড়ে কয়েকটি দেশ মিলে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গঠন করে যেমন : "নাফটা" ( নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এ্যগ্রিমেন্ট চুক্তি'র অধীনে যুক্তরাষ্ট-কানাডা ও মেক্সিকো নিয়ে একটি ত্রিদেশীয় মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল) !
মুক্তবাণিজ্য অনাগ্রহী দেশগুলো দ্বিপাক্ষিক নানা রকমের চুক্তি করে। এছাড়াও প্রতিবেশী দেশসমুহের মাঝে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি প্রচলিত।
আবার স্বার্থ সংরক্ষন বা বৃদ্ধির জন্যও আন্তর্জাতিক জোট গঠন হয়, নিদৃষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী দেশগুলোকে দেখা যায় স্বার্থ সংরক্ষনে জোট গঠন করতে। যেমন, তেল সমৃদ্ধ দেশগুলো "ওপেক" এর মাধ্যমে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রন করে।
এছাড়াও একটি রাষ্ট্র জনকল্যাণের লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহন করতে পারে যা অপর কোন রাষ্ট্রের চোখে হুমকি স্বরুপ হতে পারে, তখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারী দেশ বা সংস্থার দ্বারস্থ হতে হয়। যেমন, ভারতের টিপাই বাঁধ নিয়ে আমাদের আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হতে পারে, অথবা আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক জাতিসংঘেও বিষয়টা উত্থাপিত হতে পারে।
জনকল্যাণের মত আভ্যন্তরীন বিষয়টাও পররাষ্ট্রনীতির সাথে গভীর সম্পর্কিত! সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য দেশগুলো নীতি গ্রহন করে, কোন কোন রাষ্ট্র স্বয়ংসম্পুর্নতা অর্জনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু যেহেতু একটি রাষ্ট্রের পক্ষে সব রকমের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং উপযুক্ত কর্মী বাহিনী পায় না তাই সবাইকেই সমঝোতা করতে হয়!
মর্যাদা :
প্রতিটি দেশই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ গ্রহন করে। প্রাথমিক মর্যাদা অর্জনের পদ্ধতি হচ্ছে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি! দেশে দেশে সামরিক কুচকাওয়াজ এর একটি উদাহরন, যেখানে রাষ্ট্র তার সামরিক শক্তির শো ডাউন করে।
প্রায়ই খবর আসে চীন সর্ববৃহত কুচকাওয়াজ আয়োজন করেছে! ভারত বর্তমানের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের ক্রেতা!
আমাদের সময়ে মর্যাদা অর্জনের বৃহৎ মাধ্যম হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সামর্থ প্রমান, যার জন্য মহাকাশে যাওয়া নিয়ে প্রতিযোগীতা হয়!
আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো শিল্পায়নকেও মর্যাদা অর্জনের উপায় হিসেবে দেখি, উদাঃ গার্মেন্টস, সিমেন্ট, জাহাজ!
খেলাধুলা আরেকটি বড় মাধ্যম, অলিম্পিকের পদক তালিকার শীর্ষ অবস্থান আর শক্তিশালী দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী দেশগুলো একই থাকে! যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ইদানিং ভারতকেও দেখা যায়! জ্যামাইকা, কেনিয়া তাদের দৌড়বিদ, ম্যারাথন চ্যাম্পিয়নদের জন্যই বিশ্বে নাম করা!
পররাষ্ট্রনীতি গ্রহনের জন্য দেশে দেশে সরকারগুলোকে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয়, সরল এবং সহজ ভিত্তি প্রদান করে।
অন্যান্য :
এর বাইরেও ভিন্ন উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্রনীতি গৃহীত হয় যেমন, জাতি-আদর্শ বা ধর্মের কারনে রাষ্ট্রের নীতি প্রভাবিত হয়! আরব দেশগুলোর ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন, সোভিয়েত ও চাইনিজ পলিসি ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা, ইদানিং পশ্চিমাদের দেখা যায় গণতন্ত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অন্যান্য দেশের উপর চাপ প্রয়োগ করতে!
বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের স্বপ্ন দ্বারাও রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হতে পারে, যেমন হয়েছিল, নেপোলিয়ানের ফ্রান্স কেন্দ্রিক ইউরোপীয়ান সাম্রাজ্য তৈরীর স্বপ্ন, নাৎসি হিটলারের জার্মান কেন্দ্রিক নতুন ইউরোপ, সোভিয়েতরা তো বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য কয়েক দশক ধরে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়েছে দেশে দেশে, ইরানের মত দেশের সাংবিধানিক অগ্রাধিকার হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশগুলোর সাথে একাত্ববোধ প্রকাশ করা!
তবে, প্রতিদিনের বিশ্বে বাস্তবতা বড় খেলোয়াড়, তাই শুধু ইচ্ছা থাকলেই হয় না, বরং তা বাস্তবায়নের উপযোগীতা যাচাই করে সেই অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহন করাই সরকারগুলোর কাজ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং কোস্টারিকা'র পররাষ্ট্রনীতি'র প্রাথমিক চাহিদা ভিন্ন হলেও তাদের সকল পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে উপরোক্ত বিষয়গুলো। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।