আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার "ক্রিসমাস ডে"

অপ্রয়োজনে অনেক কথা বলে যাই, কিন্তু বলা হয়না আরো অনেক বেশী কথা- অনেক আপন মানুষদেরকে। তাইতো, এই খোলা চিঠি। হয়তো কারোর চোখে পরবে কোনদিন, যখন আমি থাকবোনা..... বহু বছর আগের কথা, কোন এক মফস্বলের ছোট্ট শহরে, ক্রিসমাস ডে'র সন্ধ্যায় আমার আগমান এই পৃথিবীতে, জায়গাটা ছিল আমার নানা বাড়ি। তাই হয়তো আজও নানা বাড়ি আর তার সাথে জড়িয়ে থাকা সময়গুলো, মানুষগুলো আমার কাছে খুব আপন। আর আপন মানুষগুলো সবসময় কেনজানি বেশি কষ্ট দেয়, অথবা তাদের দেয়া ছোট ব্যাথাও যেন বড় বেশী কষ্ট দেয়।

সেই থেকে, কোননা কোনভাবে প্রতিটা "ক্রিসমাস ডে" আমার জন্য বিশেষ হয়ে থাকে। মনে পড়ে, ৮৯, ৯০,৯১ সালের কথা, ৯-১০ বছর বয়স। যখন নিজের নামে চিঠি পাওয়া ছিল, সারা বছরের শ্রেষ্ঠ চমক। প্রথম যেবার সেঝ মামা (মামা, তখন চা বাগানের এ্যসিস্টন্ট ম্যানেজার), আমার নামে জন্মদিনের কার্ড পাঠালেন - ডাক পিওন বাসার গেটে দাড়িয়ে আমার নাম উচ্চারন করলো , নিজের নামটাকে যেন সেদিন অচেনা লাগলো। চিঠিটা ধরে দাড়িয়ে ছিলাম আমি, বুঝতে পারছিলামনা কিছুই।

সাথের বন্ধুরা ডাকলো যখন , তখন দেখি ওদের চোখে, কি এক আশ্চর্য অবিশ্বাস। চিঠিটা নিয়ে সারা দিন ঘুরে ছিলাম, খুলিনি। পরে যখন আম্মু কলেজ থেকে ফিরে (আমার মা কলেজের প্রভাষক ছিলেন) শুনলেন সব কিছু, খুলে দেখালেন। আজ আমার নামে মেলবক্সে প্রতি সপ্তাহে অনেক চিঠি আসে, আজ আমার মামা এ্যসিস্টন্ট ম্যানেজার থেকে ম্যানেজার হয়েছেন, মা প্রভাশক থেকে অধ্যাপক হয়েছেন তাই হয়তো আজ মামাও আর জন্মদিনের কার্ড পাঠায়না , মা ও আজ খুলে দেয় না। তাই হাজারও চিঠির ভীড়ে অনেক চিঠি খুলেও দেখা হয়না।

পরের এক জন্মদিনে, মেঝ মামা । আমার এই মামাটা স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেনা , পড়াশোনা করেনি বেশিদূর, তাই ছোট চাকুরি করতো। সে তার অল্প বেতন দিয়ে , আমার জীবনের প্রথম ঘড়িটা দিয়ে ছিল। সেকি আনন্দ । আমার এই মামাটা হয়তো, সবার মত অনেক বেশী বোঝেনা বলেই, আজও আগের মতোই আছে।

বড় মামাকে সবচেয়ে ভয় পেতাম ছোটবেলায়, তবে বুঝতাম মামা আমাকে খুব আদর করে। বড় মামা প্রতিদিন আমার জন্য "কাপ কেক" নিয়ে আসতো, আমার পরের দিনের স্কুলের টিফিন। মামা ভাত খেতে বসলে আমি বসতাম তার পাশে, ছোট্ট একটা চেয়ারে। মামা মাছের কাটা- মাংসের হাড় খুব অপচ্ছন্দ করতো। আর আমি হলাম বিড়ালের স্বভাব- যাবতীয় উচ্ছিসটাংসে আমার আর্কশন।

আমি বেড়াতে খুব পচ্ছন্দ করতাম তাই, মামা বন্ধুদের বাসায় গেলে, আমাকে সাথে নিয়ে যেত। এমনকি মামার বিয়ের কার্ড দিতেও আমাকে সাথে নিয়ে বেরিয়েছে সারা শহর। মনে পরে, কোন একদিন মামার সাথে বেড়াতে বেড়িয়ে আমি ঘুমিয়ে পরেছিলাম। পরদিন সকালে, নানু বলেছিল মামা নাকি আমাকে সারা পথ কোলে করে নিয়ে এসেছিল। আচ্ছা, মামার কি মনে আছে- এসব।

ছোট মামা ছিল, সবচেয়ে আপন। যার আদর, আবদার মেটানো, সবছিল সবথেকে আলাদা। মনে হতো- ও বুঝি আমারকে বোঝে। আমার উঠতি বয়সের অনেক চাওয়ার কথা , আম্মুকে বলার সাহস হতো না। অথচ মামা পূরন করে দিত সেসব।

আমার ছোট ভাইটার অভিযোগ ছিল- ছোট মামা নাকি আমাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসে। হয়তো তাই। কিন্তু আজ সারাটা দিন আমার অনেক অপেক্ষার শেষে মনে হলো- ভালোবাসাটাও বুঝি "সময়ের এক চাহিদা"। আজ সময় বদলেছে, তাই চাহিদাও বদলেছে। মনে পড়ে, কোন এক ডিসেম্বারের প্রথম কি দ্বিতীয় সপ্তাহে, ছোট চাচা রংপুরের তার চাকুরীস্থল থেকে একটা শাড়ি এনেছিল।

হয়তো আমার জন্য কিছু আনেনি বলেই বলেছিল - শাড়িটা আমার জন্য, জন্মদিনের উপহার। একবারও ভাবিনি শাড়ি দিয়ে আমি কি করব? ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ,সেদিনই আমি নানা বাড়ি চলে যাই। মহা আনন্দে আমার "জন্মদিনের উপহার- শাড়িটা" নিতে ভুলিনা। আমার নানীআপা শাড়িটা খুব পচ্ছন্দ করে , আর আমার নানী হচ্ছে আমার সবচেয়ে আপন (মায়ের চেয়েও)। জানিনা , চাচা শাড়িটা কার জন্য এনেছিল (চাচা তখন অবিবাহিত ছিল- তাই হয়তো আমার আম্মুর জন্যই এনেছিল)।

কিন্তু আমি শাড়িটার মালিকানা স্বত্ব অনুসারে নানীআপাকে দিয়ে এসেছিলাম। আজও মাঝেমাঝে নিজের মনেই হাসি- ছোটবেলায় আমরা কত আশ্চর্য আচরনই না করি। এবারের জন্মদিনটাও অনেকদিক থেকে আলাদা। গতকাল, বহুবছর পর আবার জন্মদিনের কার্ড পেলাম (ভাইয়া পাঠিয়েছে), আম্মু স্কাইপেতে কেক কাটলো আমার জন্য, আব্বু আমাকে ছাড়া কেক খাবার জন্য দুঃখ করলো। আর এই সাতশ মাইল দূরের আমার একলার জীবনে, ভীনদেশী একতরুনীর (আমার রুমমেট) কেক আর প্রান ঢালা ভালোবাসা আমার সম্বল।

তবু ছোটবেলার সেই দিনগুলোই যেন- কত সুন্দর। কেও তখন ভূল ধরতোনা, দোষারপ করতোনা। তারপরও কেবল প্রতিটা বছর ২৫শে ডিসেম্বর আসে- মনে করিয়ে দেয় আমাদের নানা স্মৃতি। আবার অনূভব করায় দিনদিন কেবল সুন্দর সময়গুলো দূরে সরে যাচ্ছে- আর সময় ফুরিয়ে আসছে। হয়তো এই জন্মদিনটাই আমার শেষ জন্মদিন, হয়তো বা এটাও শেষনা , আরো আছে সামনে।

চলতে হবে অনেক পথ, দেখা হবে নতুন অনেক দৃষ্টির সাথে, কথা হবে নতুন অনেক জোড়া চোখের সাথে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।