আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বারতা পেয়েছি মনে ... শেষ পর্ব

~ ভাষা হোক উন্মুক্ত ~ সোমা ছুটে বের হয়ে গেছিল সেদিন ঘর থেকে। মেয়েরা তাদের চোখের জল সবাইকে দেখাতে চায় না। এত অসহায় লাগছিল তখন, জানেন। একটু পরে নার্স এলে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আমার ভাল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটুকু। নার্স কিছু বলতে পারেনি।

এরপর থেকে আমার জীবনটা বদলে যেতে থাকে। বাবা মা খবর পেয়ে এসে আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো। সবার মুখ দেখে বুঝলাম যে রিপোর্ট ভাল না। একদিন ডাক্তার আমার বেডের পাশের টেবিলে সিটি স্ক্যান রিপোর্ট রেখে চলে গিয়েছিলেন।

স্লাইডগুলো দেখে যা বোঝার বুঝে গেলাম আমি। আমার মাথার ভেতর দানা বেঁধেছে ছোট্ট একটা টিউমার। স্ক্যান রিপোর্টে লাল দাগ দেয়া সেই চিহ্নটাই আমার বেঁচে থাকার সময় নির্ধারণ করে দিলো। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় ছাদ থেকে পড়ে যাবার ঘটনাটা। সে সময় দেশে এত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিলনা।

আমি প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা অজ্ঞান ছিলাম। মাথা ফাটেনি, কিন্তু ইন্টারনাল ব্রেন হ্যামারেজ হয়েছিল। সেই রক্তটা রয়ে গেছিল ভেতরেই। টিউমারের কারণ সেটাই। বাবা তার গ্রামের জায়গা সম্পত্তি বিক্রি করে আমাকে নিয়ে এলেন সিঙ্গাপুরে।

অনেক রকম ট্রিটমেন্ট করা হলো আমার। এর মাঝেই ডাক্তার একদিন বুঝিয়ে দিলেন যে টিউমারটা অপারেশন করে ফেলে দেবার উপায় নাই। মগজের এত ভেতরে চলে গেছে ওটা, যে অপারেশন সফল হবার সম্ভাবনা খুব কম। এভাবে থাকতে থাকতে একসময় শেষ হয়ে যাবো আমি। সময় বেঁধে দিলেন নয় মাসের মত।

নিজেকে ফাঁসির আসামীর মত লাগে এখন, যে জানে কবে তার ফাঁসি হবে। একটা একটা করে সেকেন্ড চলে যায়, আমি একটু একটু করে এগিয়ে যাই মৃত্যুর দিকে। সিঙ্গাপুরে আসার কিছুদিন পর আমার চোখের আলোটাও নিভে গেল। সেদিন দুপুরে ঘুম থেকে উঠে দেখি সব অন্ধকার। খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম হাসপাতালে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল না কি।

তারপর বুঝলাম যে আমি কিছু দেখতে পারছিনা। চিৎকার করে কেঁদেছিলাম সেই দিন, এই প্রথম। মরে যাবার কষ্ট আর আতঙ্কটার চাইতেও কিছু দেখতে না পাবার কষ্টটা বেশী অনুভব করেছিলাম। সব চাইতে বেশী দেখতে ইচ্ছে করতো মা'কে। মা অবশ্য এসেছিলেন কয়েকদিন পড়েই, আমাকে জডিয়ে ধরে সে কি কান্না তার।

কষ্টের একটা পর্যায় আছে, যখন মানুষ কাঁদতেও ভুলে যায়, আমার তখন তেমন অবস্থা। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। মা'র সেই কান্না আমাকে স্পর্শ করছিলোনা। ভাবছিলাম - আমি চলে গেলেও মা এভাবে কিছুদিন কাঁদবেন, এক সময় সে কান্নাও থেমে যাবে। আস্তে আস্তে সয়ে নেবেন কষ্টটা।

ব্যস্ত হয়ে যাবেন দৈনন্দিন জীবনে। এছাড়া উপায় কি? কিন্তু উনি তো আমার মা। গভীর রাতে, হয়তো সবার অজান্তে বালিশে মুখ ঢেকে কাঁদবেন অনেক দিন। যত দিন না মা আমার কাছে চলে আসেন। আমি মনে মনে মা'র দ্রুত মৃত্যু কামনা করতাম।

এখনও করি। সোমার সাথে যোগাযোগ ছিল বেশ কিছুদিন। চিঠি লিখত খুব সুন্দর করে। কি সব আবেগী কথা, কত দুষ্টুমি। আমি জানতাম লেখার আগে পড়ে কেঁদে আকুল হতো সে।

সিঙ্গাপুরে আসার আগের দিন এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। বলেছিল - আমি জানি তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। কেন যেন হেসে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম - তুমি জানতে? বলে - "হু, আমরা মেয়েরা আগেভাগেই অনেক কিছু টের পাই।

পরীক্ষার হলে তোমাকে বার বার আমার দিকে তাকাতে দেখেই বুঝেছিলাম যে আরও একটা উপদ্রব তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমি নিজে কখন তোমাকে ফলো করতে শুরু করেছিলাম বুঝতে পারিনি। কলেজে এসে তোমাকে খুঁজতাম। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি, নিজেকে বুঝিয়েছি এটা ঠিক না। এক সময় হেরে গিয়ে সব ছেড়ে দিয়েছি সময়ের হাতে।

জীবন তার নিজস্ব গতিতে চলে। মানুষ জীবনের রাশ টেনে ধরে ভাবে সে তার জীবনের গতিটাকে বদলে ফেলেছে। আসলে সেটাই জীবনের গন্তব্য ছিল। আমরা সব খেলার পুতুল। আমি যখন একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম তোমার ওপর, সে সময়েই তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে।

আমি যে কি কষ্ট পেয়েছিলাম। মনের মাঝে যেটুকু দ্বিধা ছিল, এক নিমিষে কেটে গিয়ে বুঝেছিলাম তোমাকে কত ভালবাসি। আর তুমি কত খারাপ, আমার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরতে পারলেনা সেদিন। " হেসে ফেলেছিলাম সেদিনও। সোমা আমার হাতটা নিয়ে খেলা করছিল অনেকক্ষন, আমি কিছুই অনুভব করিনি।

শুধু দেখছিলাম। ভালবাসার সার্থকতাকে যারা বিয়ে বলে মনে করেন, তারা ভুল করেন। ভালবাসা ভালবাসাই। সেটা একতরফা হোক অথবা দুতরফা। কাউকে মন থেকে ভালবাসতে পারাটাই ভালবাসার সার্থকতা।

না হয় এই জীবনে আমার সোমাকে পাওয়া হলো না। কিন্তু মরে গিয়েও আমার চেতনাটা, আমার আত্মাটা যদি বেঁচে থাকে, তখনও আমি সোমার কথা ভাববো। জানবো সোমা নামের এই অসাধারণ রূপবতী মেয়েটি আমাকে অনেক ভালবাসত। এখন আমার জীবন এই অন্ধকার ঘরের চার দেয়ালে বন্দি। ঘড়ির কাটার নিরন্তর টিক টিক শব্দটাই আমার সব চাইতে আপন।

একটা একটা করে টিক টিক শব্দ করে সে জানিয়ে দিচ্ছে তোমার চলে যাবার সময় এগিয়ে আসছে, তৈরি হও। সবাইকেই এভাবে চলে যেতে হয়, চলে যেতে হবে। কেউ থাকেনি, থাকবেওনা এই পৃথিবীতে। শুধু রয়ে যাবে একরাশ মায়া আর মায়া ভরা স্মৃতিগুলো। রয়ে যাবে শত সহস্র ভালবাসার জানা অজানা কাহিনী।

একটা গান শুনতে খুব ভাল লাগে আজকাল। অনেক সময় শুনতে শুনতে কাঁদি, একা একাই ... আমি তোমায় না দেখি ... তুমি আমার না হও ... আমি যত দূরে যাই ... তুমি কাছে রও ... আমি স্বপ্নে তোমায় দেখি ... ঘুমিয়ে যখন রই ... স্মৃতিতে এসো তুমি ... যদি দিশেহারা হই ... একা হয়ে যাই আমি ... স্বপ্ন স্মৃতি ছাড়া ... তুমি ছাড়া মনে হয় ... আমি তো আমি নই ... ----------------------O--------------------  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.