~ ভাষা হোক উন্মুক্ত ~
যা হোক, পরদিন সোমা কলেজে এসেই জেনে গেছিল ঘটনাটা। এরপরের কয়েকদিন আমার আশে পাশেই আসেনি সে। হয়তো লজ্জায় অথবা আমার ক্ষতি হতে দিতে না চাওয়ায়। আমিও কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বন্ধু বান্ধব আর সিনিয়রদের কাছ থেকে ক্রমাগত না না ধরনের কথা শুনতে হচ্ছিলো।
কেউ কেউ বলছিলেন যে ওই ছেলেটার দোষ। যে মেয়েটা ভালবেসে ওর হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল, তাকে সে নুন্যতম সম্মান দিতে পারেনি। না হলে একটা মেয়ে এত সহজে ঘর ছাড়েনা। আবার এখন সেই ছেলে এসেছে মাস্তানি দেখাতে। অনেকে আবার বলছিল যে আমারই ভুল।
আমি কেন সব জেনে শুনেও সোমার সাথে মিশতে গেলাম। সব কথাই আমার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমার কিছুই করার ছিলনা সেই সময়। ভালবাসার প্রথম সময়টা মানুষকে অনেক বেশী দুর্বল আর অসহায় করে দেয়। স্বাভাবিক চিন্তার অবকাশ থাকেনা তখন।
চোখের সামনে সব সময় ভালবাসার মানুষটার মুখ ঘুরতে থাকে। অকারণে মন ভাল হয়ে যায়, অকারণেই মেঘ ছেয়ে যায় মনের আকাশে।
আবার একটা রোদ ঝকমকে বিকেলে ওকে পাশে পাই। সেই ঘটনা নিয়ে সেও কিছু বলেনা, আমিও না। আমার কেমন যেন অসস্থি লাগে।
মনে হয় সোমা যদি দেখে ফেলে আমার বুকের মধ্যে আলোর নাচনটা! কিছুক্ষণ অপ্রাসঙ্গিক এলোমেলো কথা বলার পর স্বাভাবিক হয়ে যাই দুজনেই। একটু পরে আড্ডায় যোগ দেয় আরও কিছু বন্ধু। অনেকদিন পর ফুরফুরে একটা মন নিয়ে ঘরে ফিরি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মনটা ছেয়ে যায় বিষাদে। আমি চাই, আমি সোমাকে চাই, ভালবাসতে চাই, ভালবাসা পেতে চাই।
একবার মনে হয় ওকে একটা চিঠি লিখি। নিজেই হেসে ফেলি আবার। বড্ড হাস্যকর মনে হয় লাভ লেটার লেখার ধারণাটা। ওকে বলবো কিভাবে? সেটাও সম্ভব না। ভালবাসা এমন একটা জিনিস, যেটা লুকিয়ে রাখা যায়না।
যাকে ভালবাসি, সে কোন না কোন ভাবে সেটা বুঝে ফেলবেই। এর জন্য ঘটা করে প্রস্তাবনা পেশ করবার কিছু নেই। ও যদি কোন দিন বুঝে যায়, নিজে থেকেই আমাকে বুঝিয়ে দেবে সে আমাকে ভাল বাসে কি না। তবে এভাবেই চলুক, সিদ্ধান্তটা নিয়ে হালকা লাগে নিজেকে। মনের সুখে একটা সিগারেট ধরাই।
ঈদের ছুটি হয়ে যায় এর পরের সপ্তাহে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছেলে মেয়েরা যে যার বাড়ী চলে যায়। আমি থেকে যাই হোস্টেলে। বাবা তখন সিলেটে, ওখানে যেতে আসতেই দুদিন করে সময় লাগে। ঈদের পরেই আবার পরীক্ষা।
তাই হোস্টেলে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। আসলে ছোটবেলা থেকে বাড়ীর বাইরে আমি। পরিবারের সাথে থাকার অনুভূতিগুলো আমার মাঝে কমই কাজ করে। হোস্টেলের এই স্বাধীন জীবনেই অভ্যস্ত আমি। কিন্তু ... মিথ্যে বলবো না, সোমার কাছাকাছি থাকার একটা অনুভূতি অবশ্যই কাজ করেছিল সে সময়ে।
কোথায় যেন পড়েছিলাম – যে রিক্সায় চড়ে প্রেমিকা স্কুলে যায়, প্রেমিকের ইচ্ছে করে সেই রিকশাওয়ালাকে কোলে নিয়ে হাটাহাটি করতে। হাস্যকর ইচ্ছে, কৌতুক অর্থে বলা অবশ্যই। কিন্তু ভালবাসাটা তো একটা পাগলামোই।
ঈদের দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে এলাকার কয়েকজনের ডাকে। ওরা আমাকে নিতে এসেছে নামাজ পড়তে যাবে বলে।
ঈদের নামাজ পড়বো কি না সে ব্যাপারে অলসতাটুকু ঝেড়ে ফেলি। মানুষের ভালবাসা অগ্রাহ্য করতে নেই। ঈদগায় গিয়ে দেখি জুম্মাঘরের পরিচিত মাঠটাকে লাল নীল ঝালর দিয়ে ওরা সাজিয়েছে। খুব সাধারণ ভাবে সাজানো ময়দানটাই যেন ঝলমল করছে আনন্দে। ছোট ছোট বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে চারিদিকে।
একেই বোধহয় উৎসব বলে। শহরের বড় বড় ঈদগায় এই আনন্দ দেখিনি কখনও। বড় ভাল লাগে আমার, ঈদের দিনটা শুরু হয় সুন্দরভাবে।
নামাজের পর পরিচিত কয়েকজনের বাসায় যেতে হয়। সেমাই আর মিষ্টি খেয়ে পেট ভরে যায়।
এমন সময় শহরের কয়েকজন বন্ধু আসে বাইক নিয়ে। ওদের সাথে ঘুরতে যেতে বলে। কেন যেন ইচ্ছে করেনা যেতে। পড়ার কথা বলে ঘরে ফিরে আসি। কিন্তু বই খুলে বসার বদলে বিছানায় শুয়ে পড়ি।
বিকেলের দিকে আবার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আসে। ওদের সাথে যাব কি না ভাবতে ভাবতে এক সময় বেড়িয়ে পড়ি। অনেক মজা হয় সারাটা বিকেল, সন্ধ্যে। রাতের বেলা এক বন্ধুর বাসায় খেয়ে ঘরে ফিরবো, মানে হোস্টেলে আমার রুমে, এমন সময় প্রথম বারের মত মাথা ব্যথাটা আরম্ভ হয়। ঘরে ফিরে এসে গোসল করে শুয়ে পড়ি, কিন্তু ব্যথায় ঘুমোতে পারিনা।
ক্রমেই ব্যথা বেড়ে যাচ্ছিল। এক সময় দুটো পেইন কিলার খেয়ে নেই, ব্যথা কমেনা। মাঝ রাতের দিকে যখন ব্যথাটা অসহ্য হয়ে যায়, তখন কোন রকমে উঠে গিয়ে নীচের কয়েন বক্স ফোন থেকে বাঁধনকে ফোন করি। তারপরে আর ঘরে ফিরে আসতেও পারিনি। বাঁধনরা এসে আমাকে পায় দোতালার সিঁড়ির কাছে।
সেখান থেকে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সেই বার হাসপাতালে ছিলাম কয়েকদিন। ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারেননি। শুধু ব্যথার ওষুধ দিয়ে আধা অচেতন অবস্থায় ফেলে রেখেছিলেন আমাকে। এর মাঝে সোমা প্রতিদিন একবার আসতো।
বাকি সময়টা সুখ স্মৃতি কল্পনায় কাটিয়ে দিতাম। একদিন সকাল থেকেই আমার বাম হাতটায় জোর পাচ্ছিলামনা। পানির গ্লাসটা নিতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে দিলাম। বুঝলাম কোন একটা সমস্যা হয়েছে। ইশারায় নার্সকে ডাকার পর উনি এসে কিছুক্ষণ হাতটা মালিশ করলেন।
কিন্তু আমি কোন পার্থক্য দেখলাম না। পরে ডাক্তারকে ডেকে আনলেন উনি। ডাক্তার শুধু – এটা কিছু না, ভাল হয়ে যাবে গোছের একটা মন্তব্য করে চলে গেলেন। এদিকে আমার হাতে তখন একেবারেই জোর নেই। মনে হচ্ছে এটা আমার হাত নয়।
বিকেলে সোমা এলে বাঁধন বলে দিল যে আমি হাতে জোর পাচ্ছিনা। কেন যেন সেদিন সোমা ওর হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল আমার দিকে। মুখে বলেছিল – হাতটা ধরো তো।
নাটক সিনেমায় এমন হলে দেখা যেত নায়ক প্রচণ্ড কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত নায়িকার হাতটা ধরতে পারলো, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এমন কিছুই হলো না। আমি পারিনি সেদিন সোমার হাত ধরতে।
চলমান ... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।