~ ভাষা হোক উন্মুক্ত ~
আমি মনে মনে যত কথা বলি তার সিকি ভাগও মুখে বলিনা। ছোটবেলা থেকেই এই অভ্যেস। এমন দিনও গেছে যখন আমি সারাদিনে একটা কথাও বলিনি। অথচ সেই দিনটাতে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে গেছি নিজের সাথে। বন্ধুদের আড্ডায় সদা নির্বাক আমাকে সহ্য করে নিয়েছে সবাই।
বন্ধুরা জানে আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে মাথা নেড়ে অথবা ঘাড় কাত করে জবাব দেই আমি,আর খুব বেশী হলে মুচকি হাসি। নতুন কেউ এলে তো জিজ্ঞেস করেই বসে আমি বোবা কি না। চোখে কৌতুক আর ভাবলেশহীন হাসি দিয়ে আমি তাদের বিভ্রান্ত করি। বন্ধুরা অবশ্য খুবই মজা পায় এতে। হেসে গড়াগড়ি খায়।
আমারও ভালই লাগে।
বাসা আর স্কুলের চার দেয়ালের বাইরেও একটা জগত আছে,সেটা আমার চাইতে ভাল কেউ বোঝে বলে আমার ধারণা ছিলনা। কিন্তু কলেজে উঠে দেখলাম আমার ধারণাটা ভুল। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যা আমার অজানা। বাবু যেদিন সিগারেট দিয়ে বলল – “জীবনে সিগ্রেটের চাইতে আপন কেউ নাই রে পাগলা, টান দে, বুঝবি”, সেদিন কিছুটা ভয় আর আবিষ্কারের আনন্দে সিগারেট ঠোটে লাগিয়ে জোরে ধোঁয়া টেনে নিতে দিয়ে দম বন্ধ হয়ে মরার যোগার।
কাশতে কাশতে জীবন শেষ। চোখ দিয়ে পানিও পড়েছিল কিছুক্ষণ। কিন্তু পরদিন আস্তে আস্তে টান দিয়ে ধোয়া গেলাটা রপ্ত করে ফেললাম। এরপর থেকে নিয়মিতই খেতাম। বাসায় যাবার আগে লজেন্স খেয়ে নিতাম কয়েকটা।
মা তবুও কিভাবে যেন বুঝে গেছিল। আমার ভুবন ভোলানো রহস্যময় হাসি দিয়ে মাকেও ধন্দে ফেলে দিয়ে সে যাত্রা বেঁচে গেছিলাম। কিছুদিন পর যখন হোস্টেলে উঠে গেলাম, তখন থেকে আর লুকোচুরির দরকার পড়তো না।
রানাকে একদিন দেখলাম আমার টেবিলে বসে সিগারেটের তামাক বের করে একটা কাগজে রাখছে। এরপর ছোট্ট একটা কাগজের পুটলি থেকে শুকনো কিছু পাতার মত জিনিস বের করে ছোট্ট কাঁচিটা দিয়ে কেটে তামাকগুলোর সাথে মিশিয়ে চিকন চিকন সিগারেট বানাল।
তারপর টেবিলের ওপর পা তুলে বেশ আয়েশ করে সেই সরু সিগারেট ধরাল। প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছিল, কেন একটা বড় সিগারেট ভেঙ্গে ছোট ছোট সিগারেট বানাল? ওর কাছে সিগারেট নেই বলে? হায় রে, গরীব ঘরের ছেলে, মনে হয় টাকা শেষ হয়ে গেছে। আমাকে বললেই তো আমি সিগারেট কিনে দিতাম। কিছু বলিনি আমি, তবুও আমার চোখ দেখেই বুঝে নিলো রানা। সেদিন জানলাম এগুলো গাঁজা।
এসব খেলে নেশা হয়। আর রানা গাঁজা না খেলে পড়তে বসতে পারেনা, ওর না কি মনোযোগ আসেনা পড়ায়। পড়ায় মনোযোগ তো আমারও আসেনা, তাই ওর কাছ থেকে একদিন একটা নিয়ে টেনে দেখলাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো প্রথমে। মনে হল বিছানায় গড়িয়ে পড়বো।
কিন্তু বসেই থাকলাম শক্ত করে। একটু পর মাথাটা বেশ হালকা লাগতে শুরু করলো, একটা নির্ভাবনা আর ফুর্তি ফুর্তি ভাব আচ্ছন্ন করলো আমাকে। এ এক অদ্ভুত ধরণের আনন্দ। প্রচণ্ড ঘুম পেলে যেমন ঘোর ঘোর লাগে, তেমন কিছুটা। পরে অবশ্য একদিন অনেক বমি হয়েছিল, বেশী খেয়ে ফেলেছিলাম সেদিন।
কিন্তু বুঝে গেছিলাম আমি কতটা সহ্য করতে পারি।
সেদিন ছিল পহেলা বোশেখ। আমার জন্য বোশেখের প্রথম দিনটার আলাদা কোন গুরুত্ব ছিলনা, শুধু ছুটির দিন দেখে দেরী করে ঘুম থেকে উঠতাম, তারপর বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে পাঞ্জাবী পাজামা পড়া ছেলেগুলো আর বাসন্তী শাড়ীতে রাঙ্গানো পরিচিত মেয়েগুলোর হঠাৎ সুন্দর হয়ে ওঠা মুখগুলো দেখতাম। কোনদিন পাঞ্জাবী পড়ে সেই মিছিলে যোগ দেয়ার কথাও ভাবিনি। অথচ সেদিন আমার ঘুম ভাঙল বেশ সকালে।
চোখ মেলেই দেখলাম আমাদের ছোট ঘরটা ঝলমল করছে বাসন্তী রঙ্গে। নতুন রুমমেট মাহবুবের বান্ধবী আর তার দুই সখীর খিলখিল হাসির শব্দটাই জাগিয়ে দিয়েছে আমাকে। আমাকে চোখ মেলতে দেখে ওরা মুখে হাত চাঁপা দিলো। আমি হাতের ইশারায় বললাম – সব ঠিক আছে, আমি রাগ করিনি। এদিকে মাহবুব পড়েছে ভীষণ লজ্জায়।
ঘুমুতে গেলে মাহবুবের কাপড় ঠিক থাকেনা। বেচারা উঠতেও পারছেনা বিছানা থেকে। ওর লুঙ্গিটা পড়ে আছে বিছানার নিচে। হাসি চাপা কষ্টকর হয়ে গেল আমার জন্য। বেশ শব্দ করেই হেসে ফেলেছিলাম সেদিন।
কিন্তু মেয়েগুলো বুঝতে পেরেছিল মনে হয় সে কিছু একটা গড়বড় আছে, ওরা বাইরে চলে গিয়েছিল সাথে সাথেই। আর মাহবুব কোমরে চাদর পেঁচিয়ে উঠে এসে – “থ্যাঙ্কু বস্, আমার ইজ্জত বাঁচাইছেন” বলে জিহ্বায় কামড় দিয়ে কাপড় ঠিক করে হাতমুখ ধুতে চলে গেছিল বাইরে।
কিছু কিছু মানুষের উপকার করতে হয়না কোন ক্রমেই। মাহবুব সেই টাইপের মানুষ। ওর মাথায় সেদিন ঢুকে গেছিলো আমার এই উপকারের ঋণ তাকে শোধ করতেই হবে।
বাথরুম থেকে এসে পাঞ্জাবী পড়তে পড়তে সে আমাকে ওদের সাথে বাইরে যাবার অনুরোধ করতে লাগলো। আমার বিখ্যাত হাসিটা দিয়েও ওকে কাবু করা গেলনা, তখন বেশ বিরক্তি নিয়েই ওর দিকে তাকালাম। থতমত খেয়ে মাহবুব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আমি ভাবলাম বাঁচা গেছে এ যাত্রা। পাশ ফিরে আরেক প্রস্থ ঘুমের চেষ্টা করে যাচ্ছি, এমন সময় আবার দরজায় টোকা দিয়ে শর্মীর আগমন ঘটলো ঘরে। শর্মী মাহবুবের বান্ধবী, ছোটখাটো উচ্ছল টাইপের মেয়ে।
সারাক্ষণ হি হি করে হাসে। ওর আনন্দ দেখলেও ভাল লাগে। “ভাইয়া ... ওঠেন এখুনি। আজকে আপনি আমাদের সাথে ঘুরবেন সারা দিন। আপনি ঘর থেকে বের হননা কেন? এমন সুন্দর একটা দিনে কেউ ঘরে বসে থাকে? চলেন চলেন চলেন ...” - কে বলবে এই মেয়ে এই প্রথমবার আমার সাথে কথা বলছে।
আমি যথারীতি মুচকি হাসি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু শর্মী নাছোড় বান্দার মত মাহবুবের বিছানায় বসে পড়লো, আমাকে না নিয়ে যাবেই না। আজব যন্ত্রণা তো। হয়তো সেদিনের সকালটাই অন্যরকম ছিল। আমি ওর কথা মত গত ঈদে মা’র দেয়া খয়েরী রঙের পাঞ্জাবীটা পড়ে বের হলাম।
“ভাইয়া ... এ হচ্ছে রুমা আর ও চুমকি। আমার বান্ধবী আর রুমমেট” – শর্মী পরিচয় করিয়ে দিল ওদের সাথে। আমি হাসি হাসি মুখ করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খুব সাধারণ চেহারার দুটি মেয়ে, সুন্দর বলা চলে, কিন্তু অসাধারণ কিছুনা। রুমাই কথা বলল আগে “আপনার সাথে পরিচিত হইয়া বড়ই আহ্লাদিত হইলাম জনাব” – বলেই তিনজনে হেসে কুটিকুটি।
দুষ্টু টাইপের মেয়ে,বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু আমিও যোগ দিলাম ওদের হাসিতে,মাহবুব যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল,সহজ ভাবে হাসতে লাগলো। আমি রাগ করে আছি কি না বুঝতে পারছিলনা বেচারা।
আমরা এগুলাম কলেজের মোড়েরে দিকে,ওরা মেলায় যাবে,কলেজের মোড় থেকে রিক্সা নেয়া হবে। কিন্তু রিক্সা নেয়ার সময়েই সমস্যা।
রিক্সা আছে দুটো, মাহবুব আর আমি এক রিক্সায় বসলে মেয়ে তিনটা এক রিক্সায় বসতে পারবে। কিন্তু ওরা মাহবুব আর শর্মীকে এক রিক্সায় দেবে, কেউ কাবাব মে হাড্ডি হবে না। কাজেই আমরা তিনজন উঠে বসলাম এক রিক্সায়। রিক্সার সিটের ওপরে বসেছে রুমা, সেখান থেকেই অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে চুমকির সাথে। রিকশাওয়ালা একটু বেশী জোরে চালানোর চেষ্টা করছিল।
যত দ্রুত প্যাসেঞ্জার পৌঁছে দিতে পারবে তার গন্তব্যে, তত দ্রুতই আরেকটা ভাড়া মারতে পারবে। এদিকে প্রায় অপরিচিত দুটা মেয়ের সাথে রিক্সায় বসতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল আমার, বেকায়দায় বসেছিলাম। মেয়েদুটোর এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই দেখে আমাকেই বলতে হল – “এই রিক্সা আস্তে চালাও”।
প্রচণ্ড ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে যায় আমার। হাসপাতালের কেবিনে একা একা এই আঁধারে শুয়ে ব্যাথায় কুঁকড়ে যায় আমার শরীর।
কদিন থেকেই এমন হচ্ছে। অন্ধের মত হাতড়ে ইমারর্জেন্সি বাটনটা খুঁজে নিয়ে চেপে ধরি। জানি একটু পর নার্স এসে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়ে যাবে আমাকে। তারপর কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা ঘুমিয়ে পড়ার। এই সময়টুকুই কাটতে চায়না আমার।
মনে হচ্ছে মাথার মধ্যে কেউ গরম ধারালো একটা ছুরি দিয়ে একটু একটু খুঁচিয়ে চলেছে আমার মস্তিষ্ক।
“ওরা খুব অবাক হয়ে গেছিলো সেদিন তোকে কথা বলতে শুনে” – কৌতুক ঝরে পরে বাঁধনের গলায়। “ওরা ভেবেই নিয়েছিলো তুই কথা বলতে পারিস না। আচ্ছা, তুই অনেক মজা করেছিলি সেদিন, না?”। “হুম ... অনেক, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন ছিল সেই দিনটা” – সত্যি তাই।
ওদের সাথে সারাটা দিন ঘুরেছিলাম, মাটির শানকিতে পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ভাজা খেয়েছিলাম কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। মাহবুবটা আবার ছোট মানুষের মত করে ভাত খায়। খেতে বসে ওর থুতনিতে লেগে গিয়েছিল একটা ভাত। টের পেয়ে শর্মী সেটা ফেলে দিয়ে ওর মুখটা মুছে দিয়েছিল। বড় ভাল লাগছিল ওদের ভালবাসাবাসি দেখতে।
ওদিকে রুমা আর চুমকি তো হেসেই খুন। মাহবুবও লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল খুব।
সেদিনের পর আবার আমি ফিরে গিয়েছিলাম আমার একান্ত জগতে। সকালে উঠে ক্লাস, দুপুরে ল্যাব না থাকলে ঘরে এসে ঘুমানো, বিকেলে ঘরে বসে গান শোনা অথবা লাইব্রেরীতে বসে নোট করা। এক সময় প্রায় ভুলতে বসেছিলাম ওদের কথা,সেই দিনটার কথা।
কিন্তু হটাতই একদিন রাস্তায় দেখা হয়ে যায় ওদের সাথে। সকাল বেলায় কলেজের মোড়ে টং দোকানে আয়েশ করে চা খাচ্ছিলাম, ওরা তিনজন এসে নামলো দোকানের সামনেই। নেমেই কি একটা নিয়ে তিনজন ঝগড়া শুরু করে দিল। আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম ওদের ঝগড়ার বিষয়টা কি, কিন্তু ওরা এত দ্রুত কথা বলছিল, এক সাথে তিনজন, কেউ কারোটা শুনছিল না, ফলে আমিও কিছুই বুঝতে পারলাম না। ইশারায় দোকানের ছেলেটাকে বললাম তিন কাপ চা ওদের দিয়ে আসতে।
ওরা চা খেয়ে ঝগড়া করতে করতেই কলেজের দিকে চলে গেল, যাবার আগে রুমা একবার বলে গেল – “চায়ের জন্য থ্যাঙ্কস, ঝগড়ার সময় চা না হলে ঝগড়া জমেই না”। কি আজব মেয়ে রে বাবা। এতদিন জানতাম চা ছাড়া আড্ডা জমেনা, এখন দেখি ঝগড়াও জমেনা।
চলমান ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।