আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বারতা পেয়েছি মনে ... ২

~ ভাষা হোক উন্মুক্ত ~ সাদামাটা রঙচটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা আমার জীবনটা এরপর কিভাবে যেন পালটে গেল, জানেন। সময়ের সাথে সাথে পৃথিবী পালটায়, মানুষও পালটে যেতে থাকে। মেয়েদের সাথে মিশতে যে দ্বিধাটুকু ছিল, এই তিনটা সদা উচ্ছল মেয়ে সে দ্বিধাটা একেবারেই কাটিয়ে দিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠলো। রোজ বিকেলে ওদের সাথে দেখা না হলে ভাল লাগতোনা। অবশ্য আমার বন্ধুবান্ধব হাসাহাসি করতো।

বলতো আমার মত ছেলেই না কি মেয়েরা খোঁজে, আমি কথা বলি কম, শুনি বেশী, ওরা কথা বলে বেশী, শুনতে চায়না কিছুই। আমার কিন্তু ভাল লাগে ওদের কথা শুনতে। প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভরা মেয়েগুলোর আশে পাশে যে থাকবে, তার মন খারাপ করে থাকার কোন উপায়ই নেই। তবুও মাঝে মাঝে কেমন যেন একটা শুন্যতা অনুভব করতাম। একটা বয়সে সব ছেলেরাই বোধ হয় এমনটা অনুভব করে।

খুব ইচ্ছে করতো –কোমল একটা হাত আলতো করে ধরে রাখি, দিঘীর জলের মত শান্ত এক জোড়া চোখে আকাশের প্রতিচ্ছবি দেখি, মেলা থেকে নীল চুরি, নীল টিপ কিনে দেই। কিন্তু আমার এই শুন্যতাকে পূরণ করবে কে? সে কি জন্মেছে এই পৃথিবীতে? না, সে এই পৃথিবীর কেউ না। জন্ম তার পরীদের রাজ্যে। ভুল করে যেন নেমে এসেছিল ধুলোমাখা পৃথিবীতে, আনমনে, খেলার ছলে। সোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় পরীক্ষার হলে।

ও ছিল কমার্সের তুখোড় ছাত্রী। এক সাথেই সিট পরেছিল আমাদের। পরীক্ষার হলেও ওকে ঘিরে ছিল একটা জটলা। যেন সবার পরীক্ষা পাশের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে সে, গোটা হলটা আলো করে। একই কলেজে পড়ি, অথচ ওকে দেখিনি কোনদিন।

সেদিনের পরীক্ষায় কি লিখেছিলাম মনে নেই। কিন্তু তার পরের চারটা পরীক্ষাতে যে কিছুই লিখিনি, সেটা বেশ মনে আছে। কি করে লিখবো? আমি ছিলাম এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। চোখের সামনে সারাক্ষণই সোমাকে দেখতে পাই, চোখ বন্ধ করলেও দেখতে পাই। পড়তে পারিনি একটা অক্ষরও, লিখবো কি আমি? পরীক্ষার হলে গেছি শুধু সোমাকে দেখতে।

সে এক অদ্ভুত অবস্থা। এখনও মনে হলে হাসি পায়। পরীক্ষার চারটা দিন কেটে গেল। কিন্তু হাজার ছাত্রছাত্রীর মাঝেও আমি সোমাকে ঠিকই দেখে ফেলি, কখন ও কলেজে আসে, কখন বেরিয়ে যায়। বন্ধুরা যথারীতি ধরে ফেললো আমার উথাল পাতাল অবস্থা।

আমার সব চাইতে কাছের বন্ধু সজীব একদিন চা খেতে ডেকে নিয়ে এই প্রসঙ্গ তুললো, হয়তো অন্যরা ওকে সেই দায়িত্বটা দিয়েছিল। সেদিন জানলাম সোমা বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল একটা ছেলেকে। ছেলেটা ড্রাগ নিত, সোমা বিয়ের পর জানতে পারে। ছয় মাসের মাথায় সে তাই ফিরে এসেছিল বাবার বাড়ীতে। সজীব সাবধান করে দেয়, ওর দিকে এখনও কেউ আগ্রহী হলে ওর স্বামী সেই ছেলেকে শায়েস্তা করে।

কোন ছেলের সাথে তাই সোমাকে গল্প করতেও দেখা যায়না। শুনে আমি হেসেছিলাম শুধু। প্রেম এমন একটা আজব অনুভূতি, যেখানে মানুষ অন্ধকারে আলো দেখা পতঙ্গের মত মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আত্মাহুতি দেয়। বন্ধুরা অবশ্য একটা বিষয় এপ্রিশিয়েট করেছিল। আমি না কি সাব হিউম্যান স্পিশিজ থেকে হিউম্যানে পরিণত হচ্ছি।

যেটাই হোক না কেন, আমার তখন প্রতিটা দিন কাটতো সোমাকে কল্পনা করে। কিন্তু ওর সাথে পরিচিত হবার কোন উপায় দেখছিলাম না। সুযোগটা এলো কলেজের একটা অনুষ্ঠানের দিন। সেদিন সন্ধ্যের পর অনুষ্ঠান শেষে মেয়েদের গ্রুপ করে করে বাড়ী পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেয়া হলো আমাদের। সোমা যে গ্রুপে যাবে, আমার কয়েকজন বন্ধু যাচ্ছে তাদের পৌঁছে দিতে।

আমাকেও ডেকে নিলো ওরা, হয়তো ইচ্ছে করেই। মেয়েগুলোকে সামনে দিয়ে আমরা হেটে যাচ্ছি, টুকটাক কথা হচ্ছে ওদের সাথে। আমি যথারীতি চুপচাপ। এমন সময় একটা মেয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো – এই যে কবি সাহেব, আপনি কি কথা বলতে পারেন? আকাশ থেকে পড়ার মত অবাক হলাম, আমি আর কবি? জীবনে এক লাইন কবিতা লিখিনি আমি। বিস্ময় গোপন করে হেসে বললাম – না তো, পারিনা।

সবাই ছেঁকে ধরলো আমাকে, তুই কবিতা লিখিস? আমি এদিক ওদিক মাথা নাড়াই। জানা গেল মেয়েরা অনেকেই আমাকে কবি ভাবে, কম কথা বলি দেখে। যাহ বাবা, আমাকে নিয়েও মেয়েরা আলোচনা করে তাহলে। সেদিন অবশ্য কোন কথা হয়নি সোমার সাথে। কিন্তু এরপর থেকে ওদের আড্ডার আশে পাশে গেলে কুশল বিনিময় হতো, মাঝে মাঝে আড্ডাও।

এভাবেই জেনে গেলাম আমার সাথে সোমার অনেক ব্যাপারে পছন্দের মিল আছে। আমার কালেকশনে কিছু গান ছিল, সোমার সেই গানগুলো দরকার। বললাম, আমি কপি করে দেবো ক্যাসেটে। খুব যত্ন করে কপিটা করলাম। সাথে আরও কিছু সুন্দর গান সাথে দিয়ে দিলাম।

ভালবাসায় ভরা প্রতিটা গান, আমি তো তখন যাকে বলে ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ক্লাস শেষে সোমাকে দিতে গেলাম ক্যাসেটটা। সে ক্যাসেটটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে হেটে চলে গেল। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন, জানেন। ভদ্রতা করে কি কিছুটা সময় আমার সাথে কাটাতে পারলোনা মেয়েটা? আরও কিছু কথা বলতে পারলোনা? না হয় গান নিয়েই কথা হতো কিছুক্ষণ।

দুদিন পর লাইব্রেরীতে বসে নোট করছি, সোমা এসে পাশের চেয়ারটায় বসলো। ব্যাগ থেকে একটা ক্যাসেট বের করে দিয়ে বললো – “এটা তোমার জন্য। সুমনের রবীন্দ্র সঙ্গীত, আমার খুব প্রিয়”। স্যরি বললো ওর সেদিনের ব্যাবহারের জন্য। বললো ওর মনটা অনেক খারাপ ছিল সেদিন।

অনেক কথা হলো সোমার সাথে। ওর বাড়ী যাবার সময় হলে আমরা একসাথে বেড়িয়ে এলাম লাইব্রেরী থেকে। পাশের ক্যান্টিনে চা খাবার সময় আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এসে জুটলো। খুব সুন্দর একটা বিকেল কাটিয়ে ফিরে এলাম হোস্টেলে। তার পর দিন কলেজ ছুটি ছিল।

সকালে দেরী করে ঘুম থেকে উঠলাম। নাস্তা করে কলেজের মোড়ে গেলাম চা খেতে। এমন সময় চার পাঁচটা মটর বাইক এসে থামল আমার পাশে। বেশ কয়েকটা ছেলে নেমে এসে ঘিরে ধরলো আমাকে। ওরা শকুনের মত তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

কিছুক্ষণ পর একটা ছেলে বললো – “তুই জানসনা যে সোমার দিকে তাকানো নিষেধ আছে? যে তাকায় হ্যার চোখ আমরা তুইলা নেই”। আমি চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। ওরা কয়েকজন মিলে আমাকে নানা রকম ভাবে গালিগালাজ করতে থাকে। হটাত এক সময় টের পাই যে আমাদের চারপাশে আরও অনেক মানুষ। হোস্টেলের প্রায় সবাই এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছে আমাদের।

পরিচিত মুখগুলো চারপাশে দেখতে ভয়টা কেটে যেতে থাকে। এমন সময় ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ায় রিপন ভাই, আমাদের কলেজের বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। এই এলাকায় উনার একচ্ছত্র আধিপত্য। উনি এসে সামনের ছেলে গুলোকে লক্ষ্য করে খুব শান্ত ভাবে বললেন যেন এই এলাকায় ওদের মুখ আর না দেখা যায়। এরপর আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন – এইটা আমার ছোট ভাই, ওর যা ইচ্ছে ও তাই করবে, এই শহরে কেউ ওর কোন ক্ষতি করবার চেষ্টা করলে, তাকে নিজে ট্যাকেল করবো।

ছেলেগুলো মাথা নিচু করে চলে গেল। রিপন ভাইয়ের ক্ষমতা অনেক, সেটা সবাই জানে। ওরা চলে গেলে রিপন ভাই আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটু সাবধানে চলার পরামর্শ দিলেন, আর দুষ্টুমি করে বললেন – “মিয়া, কলেজে এত সুন্দরী মেয়ে থাকতে তোমার সোমাকেই পছন্দ হলো? যা হোক, চালায় যাও, কোন সমস্যা হলে আমাকে জানিও”। আমি মনে মনে বললাম – চালিয়ে যাবার মত তো কিছুই এখনও হলোনা ভাইয়া। মুখে কিছু বললামনা, শুধু হাসলাম।

নার্স মেয়েটা এসে অভ্যস্ত হাতে ইনজেকশন দিয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট সহ্য করছিলাম, চোয়াল শিথিল হয়ে এলো আস্তে আস্তে। বুঝতে পারছি ঘুমিয়ে পড়ছি আমি। আহ্‌ ... ঘুম, শান্তির ঘুম। কবে যে চির শান্তির ঘুম ঘুমোবো, এই কষ্ট আর সহ্য হয়না।

মাথার ভেতর দানা বেধে থাকা শুকিয়ে যাওয়া রক্তের পিণ্ডটা আমার সমস্ত জীবনটা এলোমেলো করে দিলো। সব কিছু কেড়ে নিলো আমার কাছ থেকে। সব কিছুই। এখন শুধু এই যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে থাকা। মুক্তির উপায় জানা নেই।

টু বি কন্টিনিউড  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.