সময়ের সমুদ্রের পার--- কালকের ভোরে আর আজকের এই অন্ধকারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ব্যাপক গোলাগুলি হচ্ছে।
মুহুর্মুহু টাইপ গোলাগুলি। একপশলা গুলির পর বন্দুকবাজ আমার দিকে তাকাল। তাকানোর ভঙ্গী অদ্ভুত। চেহারার মাঝে একটা মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা ভাব এসেছে।
বন্দুকবাজের নাম প্রফেসর হুমায়ূন কবির। প্রফেসর মানুষ লেকচার গ্যালারীতে গিয়ে লেকচার দিবে। জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিবে। মুঘল শাসক বাবর কবে তার রাজ্য থেকে গুড়া কৃমির মহামারী দূর করেছেন সেই বক্তৃতা দিবে। ভদ্রলোক এতো রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কেন গোলাগুলি করছে বোঝা যাচ্ছে না।
বোঝার চেষ্ঠা করতে কাছে গেলাম। আমাকে কাছে যেতে দেখেই মুখে আঙ্গুল চাপিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘গাধা, একটু দূরে থাক। দেখছিস না কামান দাগানো হচ্ছে? কাছে আসলে নির্ঘাত গুলি খেয়ে মারা পড়বি। ’
পোলাও-কাচ্ছি-বোয়াল মাছ খেয়ে অনেকেই মরে। শুধু শুধু গুলি খেয়ে মরার কোন মানে হয় না।
গুলি খাওয়ার ভয়ে আমি দূরে গিয়ে মাটিতে বসে রইলাম। বোকার মতো গলা বাড়িয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘হুমায়ূন ভাই, এখানে কি হচ্ছে?’
‘কি হচ্ছে মানে? দেখতে পাচ্ছিস না? যুদ্ধ হচ্ছে যুদ্ধ। বাঙালী আর পাক বাহিনী। ’
‘ওহ! বুঝেছি। কিন্তু আপনার হাতে দেড় হাতি পাখি মারা বন্দুক কেন?’
‘পাখি মারা হবে কেন? ধরে নে এটায় একটা ছোট-খাটো কামান।
আমি কামান থেকে মিসাইল ছুড়ছি। ’
আমি দেড়হাতি পাখিমারা বন্দকটাকে একটা কামান ধরে নিলাম। প্রফেসর হুমায়ূন কবির আরেক পশলা মিসাইল ছুড়ল কামান থেকে। মিসাইলের আঘাতে আরো কয়েকটা পাকি সেনা কুপোকাত। হুমায়ূন আমার দিকে একটা হাঁসি ছুড়ে দিল।
যুদ্ধ জয়ের হাঁসি। মানুষের ঋণ বাচিয়ে রাখতে নেই। ঋণ শোধ করতে আমিও তার দিকে তাকিয়ে একটা হাঁসি দিলাম। হাসির বিনিময়ে প্রফেসর রেগে গেল। দাঁত চিবিয়ে বলল,
‘হারামী, সবকয়টা ময়লা দাঁত বের করে হাসছিস কেন? এখানে কি ক্লোজ-আপের বিজ্ঞাপন দিতে আসছিস? যুদ্ধ হাসির জায়গা না।
সিরিয়াস জায়গা। চোখে মুখে আগুনের হল্কা থাকবে। শত্রুসেনাদের দিকে তাকাবি আর হিসহিস করবি। নিশ্বাসে গুন বের হবে। দাঁত দেখাবি না।
দাঁত বন্ধ কর। ’
আমি দাঁত বন্ধ করলাম। সিরিয়াস হয়ে হিসহিস করছি। নাক-মুখ দিয়ে আগুনের হল্কা বের করতে হবে। প্রফেসর আমার দিকে তাকিয়ে হতভম্ভ হয়ে গেল।
চিৎকার করে বলল,
‘তুইতো বড়ই আচানক রে, রাজীব। নাকে মুখে এসব কি?
‘আগুনের হল্কা ভাই। আপনিই তো বের করতে বললেন। ’
‘হারামী নাক মুছে আয়। আগুনের হল্কা বের করতে গিয়ে নাক দিয়ে তো সর্দির তুফান ছুটিয়ে দিলি।
যা নাক মুছে আয়। ’
আমি নাকে হাত দিলাম। শুকনো। অদ্ভুত কিসিমের এই মানুষটা বিচিত্র সব কান্ড করে। শুকনো মুখে সর্দি দেখে আবার অন্ধকারে অত্যন্ত আবেগী হয়ে পাকিস্থানীদের মিসাইলে পুড়ে মারে।
আচানক! বড়ই আচানক!!
আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রফেসর ধুলোর উপর শুয়ে পড়ল। বুকের নিচে কামানটাকে নিয়ে আরো কয়েক পশলা মিসাইল ছুড়ল। শুয়ে পড়া দেখে আমি অবাক হলাম। দূর থেকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘কি ব্যাপার, শুয়ে পড়লেন যে?’
‘হুম, পজিশন নিলাম। ’
‘কিসের পজিশন?’
‘তুই একটা বুদ্ধু।
পজিশন নিবনা তো কি শত্রুসেনাদের ট্যাঙ্কের সামনে গিয়ে মিসাইল ছুড়ব?’
‘অবশ্যই ভাই। ’
‘তাহলে নির্ঘাত পটল তুলব। সাথে আলু-বেগুনও কিছু তোলা হয়ে যেতে পারে। ব্যাটা কখনো দেখেছিস মুক্তিযোদ্ধারা ট্যাঙ্কের সামনে গিয়ে যুদ্ধ করেছে? মুক্তিযোদ্ধারা পথে-ঘাটে ঝোপের আড়াল থেকে গুলি করেছে। পুট্টুস পুট্টুস করে।
সেজন্যই তো তাদের গেরিলা বলে। আমিও গেরিলা পদ্ধতিতে মিসাইল ছুড়ছি। ’
প্রফেসর হুমায়ূন আরো কিছু মিসাইল ছুড়ে আমার দিকে তাকাল,
‘না শুয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুভূতি বোঝা যেত না। ’
‘এখন বুঝতে পারছেন?’
‘হুম, পারছি। বুঝতে পারছি মুক্তিযোদ্ধাদের নয়মাস কাদা মাটি, ঝোপ-ঝাড়, বর্ষা আর সাপখোপের সাথেও যুদ্ধ করতে হয়েছিল।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি। ’
‘কেমন অনুভূতি?’
‘আচানক আচানক। তোরে বোঝানো যাবে না। ’
‘বলেন না ভাই। বুঝি কি না।
’
‘চুপ কোন কথা বলবি না। একদম চুপ। ধেৎ, চোখে আবার কি পড়ল। তুই ওদিকে যাতো। বেঘোরে আমার মিসাইল তোকে লাগতে পারে।
’
প্রফেসর হুমায়ূন আরো কয়েকপশলা মিসাইল ছুড়ল। বিপরীত পক্ষ থেকে পাল্টা জবাব নেই। একাত্তরের পাকরা ২০১৩ সালে থাকার কথাও নয়। একপক্ষ মিসাইল ছুড়েই যাচ্ছে। অন্যপক্ষ যদি মানুষ হত, তাহলে ফিরতি মিসাইল আশা করা যেত।
অন্যপক্ষ মানুষ নয়, বেলুন। একটা কাঠের দেয়ালে সাজানো কিছু খুদ্র ক্ষুদ্র বেলুন। এই বেলুনগুলো দশটা ফাটানোর জন্য দশ টাকা। দেড়হাতি পাখিমারা বন্দুকে একশটা গুলি কিনেছে হুমায়ূন। অতি আবেগের বশে সে দাঁড়িয়ে না থেকে শুয়ে পড়েছে।
বাচ্চা ছেলেদের মতো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে। আমি অবাক হয়ে তার যুদ্ধপ্রীতি দেখতে লাগলাম। এতোটা যুদ্ধপ্রীতির কারন কি হতে পারে?
একটা কারন নিজে নিজে দাড় করালাম।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উজ্জ্বল অতীত কিছুক্ষনের জন্য হুমায়ুনের মাথায় ফিরে এসেছে। আশ্চর্য আবেগ আর তেজ নিয়ে ফিরেছে।
সোহরাওয়ার্দীতে বঙ্গবন্ধুর জ্বলাময়ী ভাষন অতি অলক্ষ্যে তার মস্তিষ্কের ভেতরে প্রবেশ করেছে। মস্তিষ্কের যুক্তির সকল নিউরন ছিড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। ছিন্নভিন্ন না করলে আজ প্রফেসর হুমায়ূন সোহরাওয়ার্দীর ধুলোতে রাতের বেলা মাখামাখি হতো না। শতমানুষের মাঝে এভাবে লাজ-লজ্জা বিলীন করতে পারত না।
আমার একাত্তরের কথা মনে পড়ে গেল।
মুক্তিযোদ্ধাদের কি লাজ-লজ্জা ছিল? অন্যদের সামনে ধুলো-কাদায় মাখামাখি হতে তাদের লজ্জা করত না?
আমার মস্তিষ্ক উত্তর করল,
‘না। ’
হুমায়ুনের দিকে তাকালাম। দেড়হাতি কামানটা দিয়ে এখনো মিসাইল ছুড়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য! অনেক আগেই একশ গুলি শেষ হয়ে গেছে। খালি গুলিতেই সে মিসাইল ছুড়ে যাচ্ছে।
কামানে নয়, তার মুখ শব্দ হচ্ছে,
“ঠা ঠা ঠা ঠা.........। ’
বাইশ বছরের একটা সুদর্শন তরুন শত শত মানুষের মাঝে মাটিতে শুয়ে গুলি করার মিথ্যা মিথ্যা অভিনয় করছে। এই দৃশ্য দেখলে এখনকার বাংগালীদের লজ্জা লাগার কথা। আমারও লাগছিল।
আমি হুমায়ুনের দিকে আরেকবার তাকালাম।
একটা আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম। আমার জীবনে যতগুলো আশ্চর্য ঘটনা দেখেছি সবগুলোর একটা লিস্ট আমার মাথায় আছে। এই ঘটনাটাকে সবার উপরে নতুন করে লিখতে হবে।
হুমায়ুনের দু চোখ বেয়ে জল ঝরছে।
রাতের অন্ধকারে ইলেক্ট্রিসিটির বাতিগুলো সে জলে প্রতিফলিত হয়ে আসছে।
আমি দেখতে পাচ্ছি প্রত্যেকটা জলকনা একটা করে মিসাইল। এইতো একটা জলকনা টুপ করে ঝরে পড়ল ধুলোভরা মাটিতে।
আশ্চর্য! জলকনাটা বিদ্ধস্ত হল শক্তিশালী মিসাইলের মতো। এই মিসাইলে পুড়ে ছিন্নভিন্ন হবে বাংলাদেশের বিপক্ষ শক্তিরা।
আমি মিসাইলের আঘাতের ভয়ে পাশের অন্ধকারে চলে গেলাম।
একটা ছোট্ট আমগাছের নিচে দাড়ালাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম।
আমার চোখেও জল ঝরছে। মুক্তোদানার মতো জল। আমার জলগুলো মিসাইলের মতো বিদ্ধস্ত হচ্ছে না।
কেন হচ্ছে না?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।