অরুণালোক সম্মানিত রাজিব নূর
সহকারী সম্পাদক
বিভাগীয় প্রধান, সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতি বিভাগ
দৈনিক ইত্তেফাক; ৪০, কাওরান বাজার, ঢাকা- ১২১৫
ফোন : ০২- ৭১২২৬৬০ (চঅইঢ ২৩১)
সালাম জানবেন, আশা করি ভাল আছেন। আপনি ‘উল্কার মতো আবির্ভাব’ কথাটি বুঝতে পারেননি বলেই আমার এ লেখাটির অবতারণা। আমার গুরু নজরুল, কাজী নজরুল। মনের গভীরে কাজী নজরুল কখন যে আমার গুরু হয়ে ধরা দিয়েছেন, আমি তা নিজের জানি না। আমি যখনই কিছু লিখতে যাই, গুরু সামনে এসে মিটি মিটি হাসতে থাকেন, আমাকে কবিতার বাণী বলে দেন, আর আমি লিখে চলি।
আমি নজরুলের চ্যালা। আমি তাই উল্কা। আমার মনের গভীরে প্রচ- বিষ্ফোরক নিয়ে আমি পথ হাঁটি।
কাজী নজরুল যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ান তখন আমার ভাবনায় কবি’র দেখা তখনকার বাংলার সুষ্পষ্ট একটা ছবি ভেসে আসে। আর মনে হয় তার দেখা সেই ছবির সাথে বর্তমান ছবি’র খুব একটা অমিল নেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নজরুল সম্পর্কে এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার মানুষেরা এতো বেশি জানেন যে তার সম্পর্কে নতুন করে বলার অবকাশ নেই। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যে, সেখানে কাজী নজরুল ইসলাম বিচরণ করেন নি। কি গান, কি কবিতা, কি প্রবন্ধ, কি গল্প, কি উপন্যাস, কি নাটক, বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যের পরতে পরতে তাঁর দিপ্ত বিচরণ লক্ষ্যণীয়। আর সে বিচরণটি ছিল সফল বিচরণ। সে সময়ে রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে নজরুলের আবির্ভাব ছিল ধূমকেতুর মতো।
তিনি নিজেই ঘোষণা দিয়েছেনÑ, “আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পূণঃ মহাবিপ্লব হেতু----। স্রষ্টার রহস্যময় খেলায় তিতিবিরক্ত হয়ে স্রষ্টাকেও যিনি ধমকি দিয়েছেন তিনিই নজরুল যেমনÑ ‘ঐ বামন বিধি যে আমারে ধরিতে বাড়িয়েছিলো রে হাত/ মম অগ্নিদহনে জ্বলে পুড়ে তাই--’। যারা নজরুল সম্পর্কে পড়াশুনা করেছেন, তারা এ বিষয়টি বিলক্ষণ জানেন, তাই নজরুল সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু ভালবাসা ও ভক্তি এমন এক মোহনীয় অনুভূতি যে, যারা নজরুল চেতনার অনুসারী, নজরুল ভক্ত, নজরুল গবেষক তারা প্রতি বছর কবি’র জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে কিছু না কিছু নতুন ভাবে বলার চেষ্টা করেন। তখন খুব ভাল লাগে, দারুণ ভাল লাগে।
হ্যাঁ, যে প্রসঙ্গ নিয়ে শুরু করেছিলাম, উনার যুগে বাংলার সামাজিক দৃশ্য আর বর্তমান বাংলার চলমান সামাজিক দৃশ্যের খুব একটা অমিল আমার চোখে ধরা পড়ে না। যেমন- নজরুলের কুলি মজুর কবিতাটি যখন মনের পর্দায় ভেসে উঠে তখন দেখিÑ, সেকালে মজুর, কুলি, খেটে খাওয়া মানুষেরা যেমন নিগৃহীত হতো ঠিক তেমনি আজও আছে। খেটে খাওয়া মানুষের মনের ব্যথা বেদনার ছবি এঁকেছেন নজরুল। তিনি যা দেখেছেন তাই লিখেছেন। তিনি লিখেছেনÑ, “রাজপথে তব চলিছে মোটর সাগরে জাহাজ চলে/রেল পথে চলে বাষ্প শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে/ বলতো এসব কাহাদের দান? তোমার অট্টালিকা/ কার খুনে রাঙা? ঠুলি খুলে দেখ প্রতি ইটে আছে লিখা/ তুমি জান নাকো কিন্তু পথের প্রতি ধুলিকণা জানে/ ঐ পথ, জাহাজ শকট অট্টালিকার মানে/ ----------বেতন দিয়েছো? চুপ রও যত মিথ্যেবাদীর দল/ কত পাই (পয়সা) দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল? অর্থাৎ কুলি মজুর, খেটে খাওয়া মানুষেরা তখন তাদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হতো, তথাকথিত এলিট শ্রেণীর কাছে নিগৃহীত হতো, লাঞ্ছিত হতো এবং এর সাথে বর্তমানের দৃশ্যটাকে যদি এবার দেখি তবে একই দৃশ্যেরই পূণরাবৃত্তি ছাড়া আর কি-ই বা বলার আছে।
শ্রমিক শ্রেণী তাদের ন্যায্য দাবী থেকে আজ বঞ্চিত, মানুষ হিসেবে অবহেলিত, নিস্পেষিত। তাইতো তাদের ন্যূনতম মজুরী ও মানুষের মতো বেঁচে থাকার দাবী আদায়ের জন্য রাস্তায় নামতে হয়, লাঞ্ছিত হতে হয়, জেলে যেতে হয়। আসলে মনে হয় কিছুই বদলায় নি। আজ আমরা বস্তুবাদ সভ্যতার চরম শিখরে অবস্থান করছি অথচ মানবিক মূল্যবোধ থেকে কত দূরে-----।
নজরুল তার কবিতায় ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বলে গেছেন, “গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা ব্যবধান/ নাই ভেদাভেদ হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ক্রিশ্চান----------।
তার মানে তখন ধর্মীয় রেষারেষি এতোটাই ছিলো যে, নজরুলকে ধর্মীর সম্প্রীতির গান গাইতে হয়েছে, ভেদাভেদ ভুলাতে সব ধর্মের মানুষের মাঝে তাকে আলো জ্বালিয়ে যেতে হয়েছে। আর বর্তমানেও একই দৃশ্যের পূণরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা আজও রয়ে গেছে। নইলে ভারতীয় হিন্দুরা বাবরী মসজিদই বা ভাঙবে কেন, আর এপার বাংলার মুসলমানেরা হিন্দুদের মন্দির ভাঙার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকবে কেন? বাবরী মসজিদ ভাঙার ঘটনাটি যদিও বেশ ক’বছর আগের, তবুও তার রেশ আজও রয়ে গেছে। নজরুলের দৃষ্টিতে তৎকালীন ধর্মীয় নেতাদের যে ছবি ফুটে উঠেছে, তা যেন আজও বর্তমান।
উল্লেখ্য যে, নজরুল তার কবিতায় বলেছেন, “পুজারী দুয়ার খোল/ ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে, পুজার সময় হলো/ স্বপ্ন দেখিয়া আকূল পুজারী খুলিল ভজনালয়/ দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হয়ে যাবে সে নিশ্চয়/ শীর্ণ গাত্র জীর্ণ বস্ত্র ক্ষুধায় কণ্ঠ ক্ষীণ/ ডাকিল পান্থÑ, দ্বার খোল বাবা, খাইনিতো সাত দিন/ সহসা বন্ধ হলো মন্দির ভিখারী ফিরিয়া চলে/ তিমির রাত্রি পথজুড়ে তার ক্ষুধার মাণিক জ্বলে/ ভুখারী ফুকারি কয়, ঐ মন্দির পুজারীর হায়, দেবতা তোমার নয়”। আবারÑ “মজজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোশত রুটি/ বাঁচিয়া গিয়াছে মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটোকুটি/ এমন সময় এল মুসাফির গায়ে আজাজির চিন/ বলে বাবা আমি ভূখা-ফাঁকা আছি আজ নিয়ে সাতদিন/ তেড়িয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা, ভ্যালা হলো দেখি ল্যাঠা/ ভূখা আছিস, মরগে ভাগাড়ে নামাজ পড়িস ব্যাটা---”। অর্থাৎ ধর্মীয় উপাসনালয়ের খেদমতগার যারা আছে তারা নিজেরাই সত্যিকারের মানুষ হতে পারে নি, তাই বুঝি তাদের কথায় কেউ আর ধর্মের শান্তির পথে এগুতে চায় না, ভয় পায়। ধর্মীয় নেতাদের বিলাস বহুল বাড়ি আর দামী গাড়ির নিচে পিষ্ট হয় মানবতা। যারা গায়ে সুগন্ধি মাখায়, তাদের কাছে নিরন্ন অসহায় মানুষের ঘামের গন্ধ তো দারুণ রকম অসহনীয়।
চলার পথে এ দৃশ্য আজো চোখে পড়ে। চোখে পড়ে অনেক দাঁড়ি ওয়ালা ভদ্রলোক অন্য একজন দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোককে ছাড়া কখনও দাড়িবিহীন কাউকে সালাম দেন না। অথবা সালাম এমন লোককে দেয় যে পয়সাওয়ালা। এ যেন টাকাকে সম্মান জানানো,মানুষকে নয়; দৌলতের শান্তি কামনা করা, মানুষের নয়। এমনকি অনেক মসজিদের ঈমাম সাহেব সালাম দিতে কার্পণ্য করেন, তারা ভাবেন, তারা কাউকে সালাম দেবেন না, সালাম নেবেন।
অথচ রাসুল (সাঃ) মানুষে মানুষে স¤প্রীতি তৈরির অন্যতম পন্থা হিসেবে সালামের রেওয়াজের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন।
নজরুলের কবিতায় ক্ষুধাক্লিষ্ট মানুষের সাথে ধর্মীয় নেতাদের অশোভন আচরণের চিত্র ফুটে উঠেছে, যে বিষয়টি মানবিকতাকে স্পর্শ করে যায়। তাইতো নজরুলকে গাইতে হয়েছেÑ, “আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা’ সে মুসলমান”! আর হিন্দুদের কথা কি বলবো? শুধু বলবোÑ, ব্রাহ্মণদের নিস্পেষণ থেকে ওরা আজও মুক্ত হতে পারেনি। বর্তমান ধর্মীয় নেতাদের দিকে চোখ পড়লে মনে হয়Ñ ওরা শুধুই পোশাকী। কি মুসলমান, কি হিন্দু।
খাড়া বড়ি থোড়, থোড় বড়ি খাড়া। যাহা পূর্বং তাহা পরং।
নজরুল বলেছেন, “মৌলোভী যতো মৌলবী আর মোল্লারা কন হাত নেড়ে/ দেব দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাঁজিটার জাত মেরে/ ফতোয়া দিলাম, ‘কাফের কাজী ও, যদিও শহীদ হইতে রাজি ও/ আমপাড়া পড়া হামবড়া মোরা এখনও বেড়াই ভাত মেরে/ হিন্দুরা ভাবে পার্শি শব্দে কবিতা লেখে ও পাত নেড়ে------------’। ধর্মীয় নেতাদের আক্রোশে পড়ে নজরুলকে এ কথা বলতে হয়েছে, নজরুল বলতে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমান সমাজে প্রগতির কোন কথা বলতে গেলে ধর্মীয় নেতারা যেভাবে তেড়ে আসেন তাতে মনে হয় নজরুলের যুগটাই রয়ে গেছে, পালটায়নি খুব একটা।
নজরুলের চোখে নারী যেভাবে মূল্যায়িত হয়েছেন, বাংলা কবিতায় নারীকে এতোখানি সম্মান আর কোন কবি’র লেখায় মূল্যায়িত হয়নি একথা জোর গলায় বলা যায়। নজরুল উচ্চ কণ্ঠে বলেছেন, “কোন কালে একা হয় নিকো জয় পুরুষের তরবারী/ প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষ্মী নারী”। প্রশ্ন হলো, নজরুল কেন এত উচ্চ কণ্ঠে নারীর মহীমা ঘোষণা করেছেন? কারণ তিনি জানতেন “এ বিশ্বে যত মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর--”। অন্যদিকে নারী জাগরণের প্রতি এতো উচ্চকণ্ঠ ছিলেন এজন্য যে, তাঁর সময়েও নারী অবহেলিত ছিল, নিগৃহীত ছিল। আর আজ? আজও তো নারীর সেই একই চিত্র দেখা যায়।
পত্রিকার পাতা খুললেই নারী নির্যাতনের করুণ খবর চোখে জল বইয়ে দিয়ে যায়। নারীর বন্দিত্ব কি আমরা ঘুচাতে পেরেছি? না, পারিনি। আর পারিনি বলেই আজও অজস্র নারীর করুণ হাহাকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আছে। নারীর এ কান্না শুনার কান যার আছে তিনি সম্ভবত আমার সাথে একমত হবেন। আমরা নারী নির্যাতনের যথার্থ প্রতিবাদটুকুই করতে পারিনা, যাও করি, তা কেবলই ক্ষীণ প্রতিবাদ।
বর্তমানে যারা নারী মুক্তি আন্দোলনের সাথে জড়িত, যারা নারী স্বাধীনতার কথা বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তাদের অনেকের সাথে মিশে দেখেছি ভেতরে ভেতরে তারা কতোখানি নারী বিদ্বেষী। নারীকে নগ্ন করে কেবল ভোগের লালসা দেখেছি ওদের দু’চোখে। প্রগতির কথা বলে ওরা নারীকে ঘরের বার করে শুধু লাঞ্ছনাই করতে পেরেছে কিন্তু নারীর প্রতি সত্যিকারের সম্মানবোধ ওদের কাছে নেই, ছিলোও না। ওদের ভেতরে এক আর বাইরে আরেক রূপ দেখে সইতে না পেরে প্রতিবাদ করেছি। আর ওরা লেজকাটা শেয়ালের মতো দলে টানার জন্য জোরাজুরি করেছে কিন্তু পারেনি।
আর তাই একরাশ যন্ত্রণা বুকে চেপে ওদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি, পালিয়ে বেঁচেছি। বুঝে গেছি নারী স্বাধীনতা শুধু ওদের কাছে কথার কথা, শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। ওদের কার্যক্রম শুধু বিভিন্ন সভা-সেমিনারের লৌকিকতায় ভরা। যেন ‘মুমে শেখ ফরিদ, আউর বগলমে ইট”। সত্যিকারের প্রতিবাদী হওয়ার মত মন ওদের নেই।
অথচ নজরুল তো প্রতিবাদ করেছেনই এরই সাথে নারীকে সাহস যোগাতে আর নরকে সতর্ক করতে বলেছেন, “---মাথার ঘুমটা খোলে ফেল্ নারী, ভেঙে ফেল্ ঐ শিকল/ যে ঘুমটা তোমায় করেছে ভীরু উড়াও সে আবরণ/ দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ/ ধরার দুলালী মেয়ে-----------”। আবার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নির্যাতক পুরুষকে বলেছেন, “শোন মর্তের জীব/ অন্যের যত করিবে পীড়ন নিজে হবে তত ক্লীব”। পুরুষ আজ নারীকে যে পীড়ন করছে, একদিন নারীরা তা সুদে-আসলে ওসুল করে নেবে, এই হুশিয়ারী নজরুল আগে থেকেই দিয়ে গেছেন। আমরা আজও নারীর মনের ব্যথা-বেদনাকে গুরুত্ব দিয়ে উপলব্দি করতে শিখি নি। আর এর জন্য নারীরাও কম দায়ী নয়।
ওরা আজও ওদের সত্যিকারের চাওয়াটা নির্ধারণ করতে পারেনি। নিজস্ব স্বকীয়তা ধরে না রেখে যে যা বলে কেবল তোতা পাখির মতো ওরা তা আউড়ে চলেছে, এরচে’ বিড়ম্বনা আর কী আছে!
সত্যিকারের কবি সাহিত্যিকরা যুগে যুগে আসেন, এসে মানুষকে সৎ পথে, ধর্মের পথে, আলোর পথে আহ্বান করেন। যে সেই আহ্বান শুনে, তার কাছে দুনিয়ার তাবৎ ধন দৌলত তুচ্ছ হয়ে যায়। লোভ, হিংসা, ঘৃণা ইত্যাদি থেকে সে মুক্ত হয়ে শুধু মানবতার জয়গানে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। যেমন নজরুল নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন আর অন্যকেও বিলিয়ে দেবার উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন।
ভোগে সুখ নেই ত্যাগেই সত্যিকারের সুখ। যারা মাওলানা নাসির উদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত যুগে নজরুল’ পড়েছেন, তারা আমার সাথে এক মত হবেন যে, নজরুল তার নিজের খাবারটিও দরিদ্র মানুষকে বিলিয়ে দিয়ে নিজে অভূক্ত থেকেছেন। বর্তমানেও নজরুল মানসিকতার মানুষ আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। যারা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে আলোর পথে আহবান করে চলেছেন। সে আহ্বান কেউ শুনে, কেউ শুনে না তাই নজরুল যুগের সামাজিক বৈষম্য আজও রয়ে গেছে।
হয়তো এ বৈষম্য পৃথিবী ধ্বংসের দিন পর্যন্ত থাকবে। সেই মহাপ্রলয়ের আগে বৈষম্যের পরিমাণটা যেন কমে আসে, সেই প্রাথর্না করা ছাড়া আর কী-ইবা করার আছে! কথাটা নজরুলের মতো করেই বলতে হয়, “হাত উঁচু আর হলো নাকো ভাই, তাই লিখি করে ঘাড় নিচু”। আবার- “যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্তে লেখা তাদের সর্বনাশ”। সামাজিক বৈষম্যের বিভিন্ন দিক নজরুলকে এতটাই ব্যথিত করেছিল যে, তার মুখ থেকে উল্লেখিত কথাগুলো কাব্যিক অভিশাপ হয়ে বেরিয়ে এসেছে।
নজরুল ভালবাসার এক মহাসমুদ্র, যার জল কখনো শুকাবে না, কোন দিন শেষও হবে না।
কারো কারো মনে আজও নজরুল জাগরুক হয়ে আছে। আজও কেউ কেউ নজরুলের চেতনা উজ্জীবিত হয়। নজরুল নিজেই বলে গেছেন, “ঐ নতুনের কেতন উড়ে কালবোশেখির ঝড়---” তাই শেষ করার আগে নজরুল স্মরণে এটুকু বলবো
“আজ নতুন সৃজন উল্লাসে
দুনিয়া হাসে- দুনিয়া হাসে।
হারিয়ে যাওয়া কবি’র বাঁশি সুর তোলে ভোর বাতাসে,
মধুর বেশে দুনিয়া হাসে। ।
মুগ্ধ ভোরে অরুণালোক
রাঙিয়ে তোলে সারা ভূ-লোক
হাসি কেবল তাঁর হাসে।
ফুলের নিযাস-স্রোতশীলায় সুগন্ধী-ঢেউ তাঁর ভাসে।
---------
জেগেছে এক নতুন কবি হঠাৎ আলোক পরশে
নতুন কবির কণ্ঠে এখন সেই সে কবি’র গান ভাসে
দ্যুলোক-ভূ-লোক সকল ছাড়ি
এবার আমি দেবো পাড়ি নতুন সৃজন হরষে
অরুণালোক হাসবে আবার জ্বালবে আলো আকাশে।
আজ নতুন সৃজন উল্লাসে-
দুনিয়া হাসে দুনিয়া হাসে। ।
”
(আমার ‘হঠাৎ আলোক পরশে’ কাব্যগন্থের ‘নতুন সৃজন উল্লাসে’ কবিতা থেকে সংক্ষেপিত)
তাই বলছিলাম, যে নিজেকে নজরুলের চ্যালা দাবী করে বসে আছে, তার উল্কা না হয়ে উপায় কী? আর উল্কাই যদি সে হয়ে থাকে-----------, তবে দেখবেন সে উল্কা পৃথিবীর অনাচার অবিচার দেখে কোনদিন না আবার পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেয়। কেননা নজরুল বলেছেন- ‘ভেঙে আবার গড়তে পারে সে চির সুন্দর’।
আপনি আমাকে কবিতা পাঠাতে বলেছেন-----। তাই নিচের কবিতাটি পাঠালাম। আপনার ভাল না লাগলে আমার কিছু করার নেই।
আমি লিখতেই থাকবো--------------------
কবিতার কথা
(প্রথম তরঙ্গ)
কোন মহাকাল আগে,
আড়মোড়া দিয়ে গোপন কে যেন সহসা উঠলেন জেগে।
তখন সীমাহীন অন্ধকার,
গোপন সে জন স্বপ্ন দেখলেন সুন্দর কবিতার।
মন তাঁর স্থির-নিষ্কম্প-অচঞ্চল,
আপন গভীরে ডুব দিয়ে তিনি পাতলেন অঞ্চল।
এক ইশারায় আধেক আলোয় আধেক অন্ধকারে,
মহাকবিরূপী বাঁধলেন তিনি সুন্দর কবিতারে।
কবিতার প্রয়োজনে,
তাবৎ সৃষ্টি করলেন তিনি আপন খেয়ালী মনে।
গড়লেন তিনি ছকে বাঁধা করে সৃষ্টি-জগৎ সব-,
ছকের বাইরে একাকী করলেন উল্লাসে উৎসব।
সেই উৎসব শেষে
কবিতার পানে উজ্বল নয়নে চেয়ে র’ন নির্ণিমেষে।
‘এতো সুন্দর! এতো মনোহর! কবিতা, বল্ তো দেখি
সৃষ্টি জোড়া কোন সে হৃদয়! কার কাছে তোরে রাখি?’
কবিতার সাথে কথা কন আর প্রেমময় নয়নে-
সে হৃদয়খানি খুঁজে পেতে তিনি তাকান সৃষ্টিপাণে।
সহসাই কবিতাকে,
নীবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে আমাতে দিলেন ফুঁকে।
জাগে বিস্ময়; প্রেম কথা কয় প্রেমিক-প্রেমময়ে
আমার দু'ঠোঁটে ভাষা ফোটে উঠে কবিতা পাবার জয়ে।
সেই থেকে আমি কবি,
তাঁরই প্রেমের সৃষ্টি আমি বর্ণালী রঙ-ছবি।
আদিকাল থেকে তাই কবিতা আমার কণ্ঠভাষা,
কবিতার মাঝে সৃষ্টি-স্রষ্টার সীমাহীন ভালাবাসা।
কবিতার সাথে রোজ,
অভিসারে ফিরি গোপন বাসরে জ্বেলে প্রেম পিলসুজ।
বলি কবিতায় যতো কথা,
সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ তুমি সুন্দর কবিতা। ।
কবিতা তুমি তাঁর মায়া মাখা ফসলে সবুজ দোলা,
কবিতা তুমি চির বিস্ময় তাঁর খোঁজে পথ চলা।
কবিতা তুমি মানব জমিনে তাঁর আঁকা আল্পনা,
সর্বোযুগী সুন্দর তুমি- স্বপ্নের জাল বোনা।
কবিতা তুমি একাকী পথে তাঁর নামে জপমালা,
কবিতা তুমি বেহেস্ত হাওয়া গায়ে মেখে পথ চলা।
কবিতা তুমি দুনিয়ার বুকে তাঁর সুখ-অভিলাস
কবিতা তুমি চির বসন্ত; মৌসুম মধুমাস।
কবিতা তুমি তাঁর চোখে দেখা সফল বিশ্বরূপ,
কবিতা তুমি সর্বরূপী তাঁর রূপে অপরূপ।
কবিতা তুমি প্রথম সৃষ্টি কিছুই ছিলো না যখন,
কবিতা তুমি প্রথম আলো; তাঁর আলোয় আজীবন।
কবিতা তুমি তাঁর ইচ্ছায় প্রথম আদম হাওয়া,
কবিতা তুমি বেহেস্তি সুখে ধুলার পৃথিবী পাওয়া।
কবিতা তুমি ফের বিরহের ব্যথা-জ্বালা হয়ে হায়-
প্রার্থনা হয়ে ছুটে গিয়েছিলে স্রষ্টার দরজায়।
কবিতা তুমি আদম হাওয়ার ভুমিতে প্রথম মিলন,
কবিতা তুমি মানস কামনা সুকোমল-মধুক্ষণ।
কবিতা তুমি তাবৎ সৃষ্টি কীট থেকে মানবে-
প্রশংসা করো উচ্চকণ্ঠে তাঁর-ই নাম গৌরবে।
কবিতা তুমি সর্বোযুগী শান্তিকানুন বাণী,
কবিতা তুমি চির প্রকাশ্য কল্যাণ রওশনী।
কবিতা তুমি যুগে যুগে আসা তাবৎ নবী ও রাসুল,
কবিতা তুমি তাঁর রূপ ধরে একক আদী ও আসল।
কবিতা তুমি পরম প্রেমিক মানুষ মোহাম্মদ (সাঃ)
কবিতা তুমি মিরাজের রাত ঘড়ির হিসাব রদ।
কবিতা তুমি সৃষ্টি-স্রষ্টার একাকী কথোপকথন-
বিস্ময়কর আবেশে আবেশী মহারাজা-মহাজন।
সৃষ্টি জুড়ে যতো কিছু আছে-, সব কিছু কবিতা
কবিতা রূপী সবখানে তাঁর সমান আসন পাতা।
।
(দ্বিতীয় তরঙ্গ)
আমি কী লিখবো চির অক্ষম হয়ে?
আমি কি লিখবো ক্ষমতাবানদের নিয়ে!
আমার অক্ষমতা
প্রকাশ হয় না যদিও লিখি পাতার পরে পাতা।
‘কবিতা কী কলা-বনরুটি, যে বাজারে নিলেই বেচা হয়?’
নামী দামী এক প্রকাশক সে ; বলেছিল, তাই পাই ভয়।
কবিতাকে আমি বেচি কীভাবে
ও’ ব্যাটা বুঝবে কী
ও’ ব্যাটা তো শুধু টাকা খুঁজে মরে
ও’ কাব্য মাণিক খুঁজবে কি?
ও’ বলতেই পারে ও কথা।
সবাই কি জানে কবিতার জ্বালা? শূন্য-পূর্ণতা!
আমার কাছে কবিতা মানে জীবনের খোলা পাতা,
কবিতা কখনো প্রিয়নারী, বোন, কখনো দরদী মাতা।
কবিতা কখনো ভাইয়ের স্নেহ পিতার আশির্বাদ,
চিরদিন ঝরে ঝর্ণাধারায় কাওসার সওগাত।
কবিতা কখনো আমাকে ছোঁয়ায় স্রষ্টার সুখ ছোঁয়া,
কবিতা কখনো পবিত্র রাতে আগর বাতির ধোঁয়া।
কবিতা কখনো মেশ্ক-জাফরান গোলাব-বেলির বাস
কবিতা কখনো খোলা জানালার দক্ষিণা সু-বাতাস।
কবিতা আমার শীত বরষার অনাহারি রোজা রাত
কবিতা কখনো আল্লাহর পানে উর্ধ্বে উঠানো হাত
কবিতা আমার তসবিহদানা, মুখে পাক মধু নাম
কবিতাকে তবে কে কেনে বলো? কে দেবে তার দাম!
ক্বারী’র মুখে কোরআনের বাণী কবিতায় রূপ তার
চির অম্লান, চির কল্যাণ স্রষ্টার উপহার।
কবিতা আমার রাসুলের বাণী, তাঁর-ই আদর্শ মানি, তা-ও মানি
ক্ষণিকের এই জীবনের জ্যোতি সবটুকু কবিতা
আমি বলে যাই মুক্ত কণ্ঠে আমার অক্ষতা।
কবিতা আমার কলা-বনরুটি কেন নয়! কে বলে?
কবিতা-ই তো আহার হয়ে রূপ নেয় ফুলে-ফলে।
কবিতা আমার ক্ষুরধার বাণী বিদ্রোহী নজরুল
হাফিজ-রবী-ফররুখ-জসীম মহাকবি আলাওল।
ওদের যতো না বলা কথা আমার কণ্ঠে এসে
সুঁড়সুড়ি মারে, গুতোগুতি করে, নিশিদিন কাঁদে-হাসে।
কবিতা আমার ক্ষোভ-অভিমান-অনুরাগ ও নীতিকথা
সর্বহারার হারানোর ভয়! কবিতা-ই তাঁর গাঁথা।
কবিতা প্রেমিক আর কেউ নেই এ অনন্ত চরাচরে
অমূল্য মণি কবিতা তাহলে কে কেনে কড়ি-জোরে!
কবিতা কখনো আসমানে ঘন এলোকেশী মেঘপরী
কবিতা কখনো সুনীল সাগরে স্বপ্ন প্রমোদ তরী।
কবিতা আমার তারার মালা বর্ণালী নভঃফুল
কবিতা কখনো সবুজ বনানী পাড় সাজা উপকূল।
কবিতা আমার প্রিয় সিগারেটে আখেরী সুখটান
কবিতা আমার বাথরুম গাওয়া শান্তি সুখের গান।
কবিতা কখনো বোম-ভোলানাথ গাঁজায় কল্কি ভরা
চির ঋষিমনে কবিতা কখনো দেহ হৃদে ভাঙা-গড়া।
আমি কবিতাকে ভালবাসি
কবিতার প্রেমে চির যাযাবর পথ হাঁটি ; কাঁদি হাসি।
কবিতায় আমি গাইছি নিতি আল্লাহর গুণগান
দুই চোখে যাঁর দেখেছি চেয়ে রং রূপ অফুরান।
ভরা জলরাশি-মরু-পর্বত, কী অপূর্ব সমগ্র জগৎ
তাঁর আমিত্ব সুন্দরে ভরা সুন্দর তাঁর নাম
কবিতায় গাঁথা গ্রন্থ কোরান তাঁর পবিত্র কালাম।
বাণী যেন তাঁর কবিতার বীণা বিস্ময় সুরে ভরা
কিছু শুনে হাসি, আর কিছুতে ভয়ে জাগে বুকে খরা।
কিছু বাণী জাগায় হৃদয়ে পুলক, আর কিছু তাঁর বর্ণ ঝলক
বুক কেঁপে ওঠে ও কার ছোঁয়ায় ! সুন্দর কে ও হাসে!
এতো মায়াময় এতো মনোহর! ও কারে ভালবাসে?
সত্য পথের ন্যায় সেনানী বয়ে ফেরে তাঁর বাণী
কে কোথা’ আছো? কে নেবে আমারে? সে করে কানাকানি।
যে সুন্দর শুধু তারে খোঁজে, কে যে তাঁরে পাবে কিছু বুঝি না যে
পাগলের মতো পদ্যে ফোটাই সুন্দর তাঁর রূপ
শুধু এই জানি আমার কবিতা কখনো হবে না চুপ।
(কবিতাটি আমার ‘নেশাখোর’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত)
তৈয়ব খান ঃ কবি, লেখক
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক- পাক্ষিক তৃতীয় বাংলা
গ্রাফিক ডিজাইনার- ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা পোস্ট ও নিহাল পাবলিকেশন
ঠিকানা ঃ ক ৫৪/১ বারিধারা নর্থ (নদ্দা), গুলশান, ঢাকা-১২১২।
ফোন ঃ ৮৪১০২৭২, মোবাইলঃ ০১১৯-১১৫৬৮৭৬
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।