সময় সকাল ছয়টা বেজে পনের মিনিট । প্রথম এলার্মটি বেজে উঠল । চেতনা আসতেই মাখন চোখ বন্ধ অবস্থায় মোবাইলটা হাতরিয়ে খুঁজে নিল এবং এলার্ম অফ্ করল । দ্বিতীয় এলার্ম বাজল ছয়টা ত্রিশ মিনিটে এবং তৃতীয়টি ছয়টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে । দ্বিতীয়টি অফ্ করলেও তৃতীয়টি অফ্ করে আর ঘুমানোর চেষ্টা করার সুযোগ নেই ।
সামনে ভর্তি পরীক্ষা । ভর্তি পরীক্ষা বলতে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাডমিশন টেস্ট । এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠে আমাদের দেশে । পরীক্ষার্থীদের স্বপ্ন- যাকে বলে এইম ইন লাইফ- যাই হোক না কেন, তাদের মা-বাবারাই যেন এর নির্ধারক । আমার সন্তান ডাক্তার হবে- ইঞ্জিনিয়ার হবে ! কিন্তু তারা এটা দেখতে চায় না যে তার সন্তান কি চায়, কিংবা চাইলেও তার সামর্থ আছে কিনা ।
এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিং গুলোতে চোখ বন্ধ করে ভর্তি করিয়ে দেয় ।
মাখন ছাত্র ভালো । ভালো বলতে পড়ালেখায়ও ভালো । তবে এইচ এস সি পরীক্ষা তার খুব একটা সুবিধার হয় নি । গ্রেড পয়েন্ট কত আসবে কে জানে ! তবুও তার বাবা তাকে চট্টগ্রাম শহরে ইঞ্জিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার জন্য খ্যাত সানরাইজ কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দেয় ।
খ্যাত বলতে নামে খ্যাত- অর্থাৎ-সুপরিচিত ।
আমি এখানে কোচিং সেন্টারগুলোর মান বিচার করতে বসিনি । তা আমার গল্পের বিষয়বস্তুও নয় । অনেকের মনে হতে পারে তবে কেন অনর্থল প্যাঁচাল । তাই বলি- ভাত তো খাব ।
কিন্তু সাথে একটু তরিতরকারি আবশ্যক নয় কি ?
মাখনের বাসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নং গেইট সংলগ্ন উত্তরা আবাসিক এলাকায় । এতদূর হতে শহরে আসা-যাওয়া - ভাগ্যিস বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন ছিল । আসা-যাওয়ায় ক্লান্তি কম, সাথে কিছু পয়সাও বাঁচে । মাখন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে । তাই তার কাছে এর গুরুত্বও বেশি ।
সমস্যা হল রেল স্টেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নং গেইট-সংলগ্ন । তাই রিক্সায় চাপতেই হয় ।
বিছানা ছেড়ে চোখের ময়লা পরিষ্কার করতে করতে বাথরুমে ঢুকে মাখন । বাথরুমে ঢুকলে আধা ঘণ্টার আগে সে বেরুতে পারে না । এজন্য বাসার কারও না কারও বকা শুনতে হয় ।
ব্রাশ করে একেবারে গোসল সেরে বেরুলো ও । বেরিয়ে ঘড়ি টা দেখে নিল । সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিট । বাপরে ! দেরি হয়ে গেল ।
মা-ও মা, তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও ।
আটটায় ট্রেন । জলদি কর- এক নিঃশ্বাসে বলে গেল মাখন ।
মা বললেন, নবাবের ঘরের নবাব, অত চেচাঁচ্ছিস কেন ? সেই কবে টেবিলে নাস্তা দেয়া আছে ।
মায়ের কথায় মুডটা অফ্ হয়ে গেল । খারাপ কিছু তো বলে নি ও ।
এভাবে বকা দেয়ার কোন মানে হয় । যদিও সৎ মা- তবু মাখন তাকে আপন মায়ের মতই মানে, কিন্তু মা তাকে নিজের ছেলের মত দেখে না ।
মনটা খারাপ হয়ে গেল । আস্তে আস্তে রুমে গেল সে । জামা কাপড় পড়ে তৈরি হয়ে নিঃশ্বব্দে বাসা থেকে বেরিয়ে এল ।
ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল । ভাবতে লাগল, আমি তো কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করি না । আমার সাথে কেন সবাই খারাপ ব্যবহার করে ? আমি কি কারও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না ? ভাবতে ভাবতে নিজের পুরনো জামাটার দিকে তাকালো । ভেবেছিল আজ মাকে বলবে একটা নতুন জামার জন্য । কারণ ওর কোন আবেদন মায়ের কাছে পাশ না হয়ে বাবা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না ।
আর বলা হল না কথাটা । দুঃখে-অভিমানে মনটা ভরে গেল ।
রিক্সা স্টপে পৌঁছে দেখল একটি মাত্র রিক্সা ।
কি মামা- আপনি একা কেন ? আর রিক্সা দেখছি না যে ? মাখন জিজ্ঞেস করল ।
রিক্সাওয়ালাটি বিড়ি খাচ্ছিল ।
বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, আজ মামা রিক্সাওয়ালাগো হরতাল । আমি আইছি শুধু পেটের দায়ে মামা। জানবার পারলে খবর আছে, ভীত কণ্ঠে বলল রিক্সাওয়ালা ।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোখ পড়ল অদূরে, একটি মেয়ে আসছে এদিকে । পরনে লাল-সবুজ সালোয়ার কামিজ ।
মেয়েটি ওর কলেজের সহপাঠি । নাম তনয়া । সেও কোচিং এ ভর্তি হয়েছে, তবে মেডিকেল কোচিং-এ । মেয়েটি সম্পর্কে ভালোই জানে মাখন । মেয়েটিকে স্কুল থেকেই ওর ভালো লাগে ।
কিন্তু কখনও মুখ ফুটে কথা বলতে পারে নি ওর সাথে । তনয়া একটু চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে । তবে ওর মধ্যে খারাপ কিছু কখনও দেখেনি মাখন ।
তনয়াকে এদিকে আসতে দেখে মাখন একটু বিব্রত বোধ করল । সে কিন্তু প্রথমে বুঝতে পারে নি যে ও তনয়া ।
সে ভাবছিল একটা মেয়ে আসছে, দেখেই বোঝা যায় ও শহরে যাবে । কিন্তু রিক্সা তো একটা । স্টেশনে যাবার এটাই একমাত্র সম্বল । আটটা বাজার দশ মিনিট বাকি । পায়ে হেঁটে গেলেও পনের মিনিটের মত লাগবে ।
ততক্ষণে ট্রেন মিস্ হয়ে যাবে । কখনও কোন মেয়ের সাথে মাখন একসাথে রিক্সায় চড়ে নি । একটা মেয়েকে এভাবে ফেলে যাওয়া কী ভদ্রতা হবে ? রিক্সায় উঠতে গিয়ে থেমে গেল মাখন ।
মেয়েটি কাছে আসতেই মাখন বুঝতে পারল ও তনয়া । ফলে সে আরও বেশি বিব্রত হয়ে পড়ল ।
রিক্সাওয়ালা ব্যাপারটা বুঝতে পারল । কিন্তু মুখ খুলল না , কারণ একজন গেলেই তার সুবিধা, কষ্ট কম । তনয়া এসেই রিক্সায় উঠে পড়ল । রিক্সাওয়ালাকে বলল, চলুন । মাখনের মুখ বিস্ময়ে ভরে গেল ।
মৃদুস্বরে বলল, তনয়া... রিক্সা তো একটাই...
তনয়া মাখনের মুখের দিকে তাকালো । ততক্ষণে রিক্সা চলতে শুরু করেছে । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।