কিছুটা আমার কিছুটা তোমার.. মেলেনা তো কিছু এখন আর!
অনুরুদ্ধ আবেগ নিয়ে আজ কোথায় হারাচ্ছি...?
অসম্পূর্ন হাজারো কথা ভীড় করেছে
চারপাশে...
কোথায় হারাচ্ছি আমি...?''
কবিতার পরের লাইনটা কি হবে ঠিক করতে পারছিনা এখন আর!
কি হবে?খুব জটিল ভাষায় কিছু হবে নাকি সাবলিল ভাষায় কিছুই মিলাতে পারছিনা আর...
'ধূর...কবিতা লিখা এত কঠিন ক্যান?কত ঝামেলা...'বিরক্তি নিয়ে উঠে পড়লাম। চা বানানোর জন্য কিচেনে ঢুকছি,বুঝতে পেরে ওপাশ থেকে ছোটঁ ভাই তার জন্য চা বানাতে বলল। দু'কাপ চা বানিয়ে কাপে ঢেলে ভাইয়ার রুমে দিয়ে নিজের রুমে যাব এমন সময় আম্মু ডাকল,
--চা কয় কাপ বানিয়েছো?
--কেন?
--বেশি বানালে আমাকে এক কাপ দিও
--বানানোর সময় বললে কি হতো?
আম্মু হেসে বলল,
--এখন ইচ্ছে করছে তাই বললাম,আর তুমি তো সব কিছুই বেশি বানাও,তাই ভাবলাম বলি...
--হুম,ভালো,এই নাও খাও,আমি আবার বানাচ্ছি...
আম্মুকে চা দিয়ে এসে আবারো চায়ের পানি বসালাম,পানি প্রায় হয়ে এসেছে চা পাতা দিব,এমন সময় বুয়া কিচেনে ঢুকল,চা বানাতে দেখে বলল,
--আম্মাজান,আমার জন্যেও এক কাপ বানাও,গলাডা শুকায় গেল...
চায়ের বয়ামটা ঠাশ করে রেখে আবার পানি বসালাম,মনে মনে রাগে জ্বলতে লাগলাম!এক কাপ চা খাবো তাও শান্তিমতো খাওয়ার সুযোগ নাই...একে তো কষ্ট করে বানাতে হয় তারপর আবার বিলাইতে হয় তারপর আবার বানাতে হয়...''হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল...হায়রে!!!চা তো প্রায় হয়ে এলো কিন্তু মনে হয় এইবারেও খেতে পারব না,এক কাপ বুয়ার আর এক কাপ যে আসছে তার...
গেট খুলে দিয়ে বুয়া মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলল,
''আম্মাজান,সুখবর আছে,তিন জন খালাম্মা আইছে তাদের জন্যে চা বানাও...!!''
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রাগ হজম করার ট্রাই করছি,এমনিই সময় পাইনা,কতদিন পর ব্লগে বসছি কিছু লিখব তাও হইল না, মন ভালো করার জন্য চা বানাতে আসলাম খাবো বলে সেইখানেও এমন অবস্থা,উফফ...কই যাই...
ছোট ভাই চায়ের কাপ রাখার জন্য কিচেনে এসে বলল,
--কিরে?আমারে দিলি এক কাপ চা তাও ফুল না,আর এখন নিজে দুনিয়ার চা বানাচ্ছো আর খাচ্ছো?ভালো ভালো...
--এক পাতিল গরম পানি মাথায় ঢেলে দিব বলতেছি,এই খান থেকে যা...কখন থেইকা চা বানাইতেছি কিন্তু খাইতে পারলাম না এক কাপ ও আর আসছে আরেকজন খোচা মারতে...প্রতি দুই ঘন্টা পর পর বাসায় এই আন্টি সেই আন্টি আসতেই থাকে,মাঝে মাঝে মনে হয় বাড়িতে আম্মু থাকে আর তার ওমুক আপা তমুক আপারা থাকে আর কেউ না...
চা বানিয়ে ট্রেতে সাজিয়ে আম্মুর রুমে নিয়ে গেলাম,তহুরা আন্টিকে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল আমার। তহুরা আন্টি আমার খুব প্রিয় কিছু মানুষদের মধ্যে একজন। প্রচন্ড হাসিখুশী,আর সদালাপী মানুষ হিসেবে আন্টি পরিচিত।
আমাকে হেসে বললেন,
--কিরে কেমন আছিস?আজকাল তো দেখাই যায় না তোকে?
--আর বইলেন না আন্টি,পড়ার চাপে দিন পাড় করে দিলাম আপনার কি খবর?বাসার সবাই কেমন আছে?আপনার বাবুটা কেমন আছে?
--আছে সবাই ভালো,এই চা কি তুই বানিয়েছিস?বাহ,ভালোই দেখি বানাস
--কই আর ভালো বানাই,শুধু শুধু প্রশংসা করে লাভ নাই,আমার মতো অকর্মার ঢেকি বানাবে ভালো চা?তাইলে চায়ের দোকানদার দুঃখ পাবে!হিহিহিহি
--হইছে হইছে,এত দিন তো করিস নাই এখন করা শিখ,না হলে পরে মা-খালাদের বদনাম হবে বুঝলি। ''
--আরে শিখলেও মা-খালাদের কথা শুনতে হবে না শিখলেও হবে...হাহাহা
সবাইকে চা দিতে দিতে নিজের চা খাওয়ার মুড শেষ!কাজ শেষ করে নিজের রুমে এসে বসলাম।
একটু পর তহুরা আন্টি আমার রুমে এলেন,পড়াশুনার কথা শেষ করে নিজেদের কথায় এলে আমি বলি,
--মেয়ে হয়ে কি যে ঝামেলা...কোন কিছু করে শান্তি নাই,এত এত দায়িত্ব হাসিমুখে করে যাও,নিজের কথা ভাবার সময় নাই...আজব নিয়ম!''চুপ করে রইলেন আন্টি। কিছুক্ষন পর অনেকটা আপন মনেই বলতে লাগলেন,
--বুঝলি রুমু,মেয়েদের জীবনটা অনেক কষ্টের,যত দিবি ততই ভালো,পাওয়ার আশা করতে পারবি না,এখন মেয়ে আছিস,এখন বাবা-মা,ভাই-বোনকে যত দিবি তত লক্ষী মেয়ে,ভালো বোন উপাধি পাবি,ক'দিন পর অন্যের ঘরে যাবি সেখানেও নিজের হিসেব না করে যত দিবি সেরা বউ উপাধি পাবি,তারপর মা হয়ে সন্তানদের নিজে না নিয়ে যত দিবি আদর্শ মা উপাধি পাবি...মাঝে মাঝে যখন নিজের কথা ভাববি,দেখবি চারপাশ একেবারেই শূণ্য,কিছুই নেই...
আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। ছয় বছর আগে আন্টি আমাদের শামীম মামার বউ হয়ে আমাদের পাড়ায় আসেন।
শামীম মামাদের সংসার বেশ বড়ই বলা যায়,ছয় ভাই দুই বোনের সংসারে এসে শ্বাশুড়ির সাহায্যকারী হতে হতে নিজের পড়াশুনা আর শেষ করতে পারেননি,এ জন্য মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অনেক কষ্ট পান আন্টি,কিন্তু সব চেপে সারাক্ষন হাসি মুখে সবার মন জয় করে চলেন।
আন্টি উদাস ভাবে কিছুক্ষন বসে থেকে এমনভাবে হেসে উঠলেন যেন,অনেকক্ষন পর আকাশে মেঘ কাটল।
কয়েকদিন পর,রাতে বাসায় এসে খাওয়া দাওয়া করছি আম্মু এসে বলল,''একটা খবর শুনেছিস?তোর তহুরা আন্টির ক্যান্সার ধরা পড়েছে,লাস্ট স্টেজ...''অসম্ভব রকমের শক খেলাম আমি!!
এ কি করে সম্ভব?!সে দিন তো খুব সূস্থ দেখলাম কিভাবে সম্ভব এটা!
শুক্রবারে আম্মুর সাথে আন্টিকে দেখতে গেলাম,আমাকে দেখে শোয়া থেকে উঠে বসলেন,অনেক শুকিয়ে গেছেন এ কদিনে,বোধহয় টেনশনে আরো বেশি কাহিল হয়ে গেছেন।
আমি কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইলাম,আন্টি আমার হাত তার হাতে রেখে বললেন,''কিরে?এমন চুপ হয়ে আছিস কেন?''
আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখে বললাম,''কোন কথা বলার নেই আন্টি''। আন্টি সেই সুন্দর হাসিটা দিয়ে বললেন,
''রুমু,চলে যেতে ইচ্ছে করছে না,কিন্তু আল্লাহ ডেকেছেন তাই চলে যাচ্ছি,বোধহয় সবাইকে দেবার সময় শেষ তাই চলে যেতে হচ্ছে''
কন্ঠে অভিমান টের পেলাম।
বাসায় আসতে আসতে কানে বাজতে লাগল,আন্টির শ্বাশুড়ীর কথা গুলো,''আমার এই বউটা,আমার সংসারের খুঁটি ছিল আজ সেই খুঁটিটা ভেঙ্গে যাচ্ছে,কিন্তু আমি জানলাম শেষ সময়ে টেরই পেলাম না আগে...''
ঝাপসা দৃষ্টিতে আম্মুর দিকে একবার তাকালাম,এই মানুষগুলো যে সংসারে যায় সেই সংসারের খুঁটি হয়ে যায়,কিন্তু সবাই সেটা বুঝতে পারে অনেক দেরি করে,কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না এরা শুধু দিতে চায়,নিতে চায় না...কখনো বউ,কখনো ভাবি,কখনো মা,কখনো বোন সব জায়গায় নিজেদের স্বার্থকতা দেয়ার মাঝেই খুঁজে নেয়...কিভাবে পারেন এরা?স্বামী কি পছন্দ করে তা মনে থাকে,স্বামী কখন ঔষধ খাবেন তাও মনে থাকে,ছেলে কখন কোন খাবার খেতে ভালোবাসে তাও মনে রাখে,অনেক বছর পর দেবর বেড়াতে এলে তার পছন্দের খাবার তৈ্রি করতে হবে তাও মনে থাকে,ছোট ভাই কোন পিঠা পছন্দ করে তাও মনে থাকে,শ্বাশুড়ী কিভাবে করা রান্না পছন্দ করেন তাও মনে থাকে ...সবার সব কিছু মনে থাকে কেমন করে?!একটা সময় নিজেকেও ঐ অবস্থায় যেতে হবে তখন আমাকেও কি শেষ সময়ে এমন করে বলতে হবে?''দেবার সময় শেষ তাই বোধহয় চলে অসময়ে চলে যেতে হচ্ছে...''সংসারে খুঁটি হয়ে থাকতে থাকতে কখন চলে যাওয়ার সময় হয় বলতেই পারেনা...
আবারো চোখ ভিজে উঠে আমার...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।