প্রথম আলো: সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে (ডিসিসি) দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সাদেক হোসেন খোকা: সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক চতুর্দশ শতকে অযাচিতভাবে দিল্লি থেকে ৭০০ মাইল দক্ষিণের দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করে সে সময়ে লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছিলেন। বর্তমানে সরকার সেই রকম তুঘলকি সিদ্ধান্তই নিয়েছে। কারও দাবি বা প্রত্যাশা ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোনো মানদণ্ডেই পড়ে না। আসলে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে কোনো দলেরই মাথা ঠিক থাকে না।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার কারণেই সরকার উল্টাপাল্টা কাজ করে যাচ্ছে। অতীতে বিএনপিও তা করেছিল।
প্রথম আলো: ডিসিসির কাউন্সিলর, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিষয়টিকে কীভাবে নিয়েছেন?
সাদেক হোসেন: ডিসিসির বোর্ডের সভায় সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিবাদের মাধ্যমে তাঁদের ভাষাও এরই মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
প্রথম আলো: সরকার কী উদ্দেশ্যে কাজটি করতে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
সাদেক হোসেন: ভালো কোনো উদ্দেশ্য নেই।
ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গর্বকে দুই টুকরো করার নকশামাত্র। আসলে ক্ষমতাসীন দল মনে করে, মেয়র হিসেবে আমি সরকারবিরোধী বলয়ে বড় ভূমিকা রাখছি। মূলত আমাকে কাবু করার জন্যই সরকার ঢাকাকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই ভাগ করা হলে আমার জায়গায় প্রশাসক নিয়োগ করা সম্ভব হবে। এর একটাই অর্থ হতে পারে—সরকার নির্বাচনের আগেই আমাকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে।
ভেবে ভালো লাগছে যে আমি সরকারের কাছে ফ্যাক্টর। বিষয়টি আমার জন্য একদিকে যেমন বিজয়ের, অন্যদিকে হতাশার। কারণ আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে। আমার চোখের সামনেই একসময়ের ছোট শহর ঢাকা এখন বিশাল মহানগরী। ৪০০ বছরের পুরোনো এই শহর কেবল বাংলাদেশের রাজধানীই নয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের লীলাভূমিও বটে।
অথচ এখন আমার কারণেই সেই শহরকে ভেঙে দুই ভাগ করা হচ্ছে। সে জন্যই আমি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছি, প্রয়োজনে আমি নির্বাচন করব না। তবুও সরকার যেন এ ধরনের হীন কাজ থেকে বিরত থাকে।
প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন, অখণ্ড ঢাকাতে নির্বাচন হলে আপনিই জিতবেন?
সাদেক হোসেন: এটা সত্য, ডিসিসি নির্বাচনে আমাকে পরাজিত করার মতো কোনো প্রার্থী বা জনমত আওয়ামী লীগের নেই। সে জন্যই তারা রাজধানীবাসী, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজধানী শহরকে দ্বিখণ্ডিত করার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পুরো বিষয়টিই রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত।
প্রথম আলো: বিদ্যমান আইনে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ থাকলে সরকার কি রাজধানীকে ভাগ করার চিন্তাভাবনা করত?
সাদেক হোসেন: প্রশ্নই আসে না। প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ থাকলে সময় নষ্ট না করে তারা আমাকে সরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসক নিয়োগ করে দিত। মূলত আমাকে সরিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করার জন্যই ডিসিসিকে দুই ভাগ করা হচ্ছে। এটা হলো একধরনের স্থূল রাজনৈতিক কৌশল।
প্রথম আলো: ঢাকাকে ভাগ করা হলে কী ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন?
সাদেক হোসেন: দেখুন, ঢাকার কোনো প্রাকৃতিক সীমানা নেই, যা দিয়ে ভাগ করা যায়। কোন মানদণ্ডে ভাগ করা হবে? রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পানি, গ্যাস, বিদ্যুত্সহ অন্যান্য সেবা খাতের জন্যই কি দুটি করে কর্তৃপক্ষ হবে? রাজধানীতে যেসব যানবাহন আছে, তাদের নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ কে হবে? সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদে আছে, বাংলাদেশের রাজধানী হবে ঢাকা। রাজধানীর সীমানা আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। কিন্তু এখন দুই ভাগ হলে কোন অংশটি রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত হবে? সুতরাং এ নিয়ে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা আছে। সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বঙ্গভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভবনগুলো কোথায় থাকবে? এ নিয়ে যদি রাজধানীর উত্তর এবং দক্ষিণের বাসিন্দাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আরও যা ঘটতে পারে, ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ বাড়বে। কৃষিজমি, জলাশয়, খাল, নদী ভরাট হবে। তারপর একসময় রাজধানী বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে—সবই আশঙ্কা। ভবিষ্যত্ই বলবে, কী ঘটতে যাচ্ছে। তবে পরিণতি যে ভয়াবহ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রথম আলো: ঢাকা ভাগ না করে সরকারের কী করা উচিত ছিল বলে আপনি মনে করেন?
সাদেক হোসেন: আওয়ামী লীগের নেতা মেয়র হানিফ সাহেব যা চেয়েছিলেন, আমি তা-ই চেয়েছি। কিন্তু করতে পারিনি। আমরা চেয়েছিলাম ওয়াসা, রাজউক ও ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ডিসিসির অধীনে নিতে। এতে প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমে যেত। জনগণের জন্য দেওয়া সেবার মান বাড়ত।
এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ কাজটি করলে তাতে রাজধানীবাসী উপকৃত হতো। এ সরকার আরও যা করতে পারত, সিটিকে একাধিক অঞ্চলে ভাগ করে একাধিক ডেপুটি মেয়রের পদ তৈরি করতে পারত। তাতে সিটি করপোরেশন অনেক বেশি শক্তিশালী হতো।
প্রথম আলো: সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিএনপি থেকে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন কর্মসূচির করার চিন্তাভাবনা আছে কি?
সাদেক হোসেন: এখনই তো ঢাকাবাসী বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। কাউন্সিলররা মানববন্ধন করছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো কর্মসূচি নেওয়া যায় কি না, সেটা দলীয় পর্যায়ে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। একই সঙ্গে ঢাকাবাসীদের নিয়েও আন্দোলন-কর্মসূচি গ্রহণের সম্ভাবনার বিষয়টি আমি এবং আমাদের কাউন্সিলরদের চিন্তাভাবনায় রয়েছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।