Click This Link
তিস্তা এবং টিপাইমুখ নিয়ে কানামাছি খেলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে মাতিয়ে রেখেছিলেন ভারতশক্তির পাকা খেলোয়াড় সে দেশের মিষ্টভাষী প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠকে তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকা কথা দিয়েছিলেন, খুব শীঘ্রই পানিমন্ত্রী আর অন্যান্য পানি বিশেষজ্ঞ দলবল পাঠিয়ে তিনি তিস্তার পানি ভাগাভাগি চুক্তি সই করিয়ে ফেলবেন। বলেছিলেন, আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে দিলি্ল এখন দূরের বন্ধুর চেয়ে কাছের প্রতিবেশীদের সহযোগিতার ওপর ভর করাই প্রয়োজন মনে করছে। নিকট প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যে নয়া বৈদেশিক নীতি ভারত অবলম্বন করেছে, তারই একটা আবশ্যকীয় নমুনা পদক্ষেপ হিসেবে ভারত শেখ হাসিনাকে তিস্তা চুক্তি উপহার দিতে যাচ্ছে। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায়ও এভাবেই তিস্তা সম্পর্কে বলা হয়েছিল, সীমান্তে গুলি করে কাঁটাতারের বেড়ার এপারে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ হবে বলেও আশ্বাস মিলেছিল।
আরও আশ্বাস মিলেছিল টিপাইমুখ বাঁধে যাতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি না হয়, সে সম্পর্কে যথার্থ সমীক্ষা ও আলাপ-আলোচনা ছাড়া বাঁধ নির্মাণ হবে না (এ ব্যাপারে কথার কিছুটা ফাঁক অবশ্য রেখেছিলেন মনমোহনজি)।
সেই কূটনৈতিক সৌজন্যের উপহার আজও মেলেনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্যে। পুরো ২০১০ সালেও তিস্তা নিয়ে অগ্রগতি হয়নি। সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যায় গুলি তো বন্ধ হয়ইনি, অন্যান্য প্রক্রিয়ায় নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে 'উচিত শিক্ষা' দেওয়ার দাপট বজায় রেখেছে ভারতশক্তি। টিপাইমুখের কাজও যে বাংলাদেশে সম্ভাব্য পরিবেশনাশের সমীক্ষা ছাড়াই নেপথ্যে চালিয়ে গেছে দিলি্ল, সে কথা এখন ফাঁস হয়েছে।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে যখন মনমোহন বাংলাদেশ সফরে এলেন, বাংলাদেশকে বলা হলো এবং ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেরই পত্র-পত্রিকায় জোর প্রচার হলো_ এবার তিস্তা চুক্তি সই হবে, সব ঠিকঠাক। ঢাকায় আসার আগ মুহূর্তে আবার উছিলা খাড়া হলো_ পশ্চিমবঙ্গের নয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বেঁকে বসেছেন, চুক্তিতে দেরি হবে। ভারতীয় হাইকমিশনারকে বলা হলো, চুক্তি তো দিলি্লর সঙ্গে, মমতার তথা পশ্চিমবঙ্গের ওজর-আপত্তি আমলে নিয়েই তো দিলি্ল বাংলাদেশের সঙ্গে খসড়া চুক্তি চূড়ান্ত করেছে বলে ঢাকাকে জানিয়ে গেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিনিধি। দেখা গেল, কানে তালা লাগিয়ে বসে আছে দিলি্লর সাউথ ব্লক। শেষ পর্যন্ত তিস্তা চুক্তি ছাড়াই সই হলো দ্বিতীয় হাসিনা-মনমোহন যৌথ ইশতেহার।
এটুকু আশ্বাস মিলল যে, তিন মাসের মধ্যেই তিস্তা চুক্তি সইয়ের ব্যবস্থা হবে। যেমন আবারও আশ্বাস মিলল, সীমান্তে গুলি চালিয়ে হত্যা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুলি চালানো কমলেও ভারতীয় সীমান্তসেনার সন্ত্রাস কমল না_ এই সেদিন গুলি চালিয়েও হত্যা করা হয়েছে এক বাংলাদেশি সীমান্তবাসীকে।
ওদিকে তিন মাস প্রায় শেষ হতে চললেও ঢাকা-দিলি্ল পানিমন্ত্রী পানি বিশেষজ্ঞদের আসা-যাওয়ার ঘটা ছাড়া তিস্তা চুক্তির খসড়া পাকা হচ্ছে না দেখে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটি মাথা নুইয়ে হলেও ভারতে লোক পাঠিয়ে তদবির করার উদ্যোগ নিলেন, যেমন ভারতভুক্ত প্রদেশ বা রাজ্যগুলোর প্রধানমন্ত্রীরা করে থাকেন। অতীতে কলকাতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'মুখ্যমন্ত্রী' বলে মাইকে সম্বোধন করা হয়েছিল প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে।
মুখ ফসকে এমন ভুল হয়েছে ঠাউরে শেখ হাসিনা সেখানে মুখ বুঁজেই ছিলেন। এবার তিস্তার মীমাংসার জন্য তার শখের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে ধরনা দিতে পাঠিয়ে এ দেশের সার্বভৌমত্বের অমর্যাদা করলেন নিজেই। মমতা টলেননি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব আগেই বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বোঝাপড়া ভারত সরকারের নিজস্ব ব্যাপার, আমাদের বোঝাপড়া দিলি্লর সঙ্গে। সমতার ভিত্তিতে বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষার সেই নীতি থেকে সরে এসেও শেষ রক্ষা হলো না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
তিস্তা চুক্তি এ বছরও হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
এমন অবমাননার পর যখন টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে ভারত সরকারের অঘোষিত অনুমোদন নিয়ে দিলি্ল নিযুক্ত প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের চুক্তি সইয়ের খবর ফাঁস হলো, মনমোহনের এমন বেঈমানিতে সম্ভবত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
২২ অক্টোবর চুক্তিটি সই হয় দিলি্লতে। এ ধরনের চুক্তি করার আগে বাংলাদেশকে জানানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা মানেনি ভারত। মণিপুর সরকার এবং প্রকল্পের অন্যতম অংশীদারের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে ১৮ নভেম্বর খবরটি ফাঁস করেছে বিবিসি।
এভাবে চুক্তি সইয়ের খবর প্রকাশের চার দিনের মাথায় ২২ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাল বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলা হয়, ভারতের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশ অভিন্ন নদীতে অবকাঠামো তৈরির আগে ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনার ওপর জোর দিতে চায়। বর্তমানে দুই দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিবেচনায় বাংলাদেশ আশা করে, ভারত সরকার প্রস্তাবিত প্রকল্পের সব বিষয়ে এবং এ সম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে জানানো হবে। বাংলাদেশের উদ্বেগ কিংবা এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে এ ধরনের পদক্ষেপ জরুরি।
টিপাইমুখ নিয়ে দিলি্লর একতরফা পদক্ষেপ সম্পর্কে বিবিসির খবর পাওয়ার পর চার দিন পর্যন্ত প্রকাশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে ভারতকে চিঠি লিখেছিল।
একই দিন দুপুরে ভারতের পক্ষ থেকেও প্রথম প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। দিলি্লতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, টিপাইমুখে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। তথা, তিনি মনমোহন সিংয়ের পুরনো প্রতিশ্রুতিরই পুনরুল্লেখ করেন, নতুন কিছু বলেননি। বাংলাদেশের চিঠির জবাবে ভারত কোনো তথ্য দেয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যই সর্বশেষ নতুন তথ্য।
শুধু এ কথা বলেই মুখরক্ষা করছে দিলি্লর বাংলাদেশ হাইকমিশন ও ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। টিপাইমুখের ফলে পরিবেশনাশের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ জরিপ সাপেক্ষে দিলি্লতে টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশের বিরোধী দলনেত্রী খালেদা জিয়াও একটি চিঠি দিয়েছিলেন।
সে চিঠির জবাব মিলেছে ২৬ নভেম্বর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সংসদে বিরোধী দলনেতাকেও কোনো নতুন তথ্য দেননি, লিখেছেন_ প্রস্তাবিত প্রকল্পটিতে সেচ প্রকল্প নেই। বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ দিয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।
পানি প্রত্যাহার হবে না বলে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না, ইত্যাদি। বাংলাদেশের বরাকপুষ্ট সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা উপত্যকার মানুষ আর ভারতের বরাক উপত্যকার মণিপুরবাসী ও আসামবাসী সমস্বরে বলছে, সেচের পানি প্রত্যাহার ছাড়াই টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পে যে বন পরিবেশ ধ্বংস, ভূমিকম্পের নিয়ন্ত্রণহীনতা ও নদীপ্রবাহে অনিয়ম ঘটবে, মৌসুমের জীববৈচিত্র্যে, পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবনধারায় ও সমতলে বন্যা এলাকায় সমূহ ক্ষতি দেখা দেবে, সে কথা বিবেচনা করে মণিপুরের উজানের এবং ভাটি এলাকার জনগণ ও বাংলাদেশের জনগণ বাঁধ নির্মাণের ঘোর বিরোধী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এখন মুখ খুলেছেন। সংসদের ভেতরে এবং বাইরে স্পষ্ট করে বলেছেন, একতরফাভাবে ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ মেনে নেওয়া হবে না। বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন যে কোনো কাজে তিনি বা তার দল বাধা দেবে।
সংসদে বিরোধী দলনেত্রী আগেই বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধের প্রশ্নে বাংলাদেশের অধিকার রক্ষায় রুখে দাঁড়াতে সরকারকে সবরকম সহযোগিতা করবে তার দল। এর আগে বাংলাদেশের পানিমন্ত্রী রমেশ সেন ভারতভক্তিতে কাঁচুমাচু হয়ে বলে বসেছিলেন, দিলি্লতে যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পাঁয়তারা চলেছে সেটা তো ভারতের নিজস্ব ব্যাপার, আমাদের আগেভাগে জানাতে হবে কেন? এখন তিনিও বলছেন, দেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে; ভারত যদি বাংলাদেশকে উপেক্ষা করে তা হলে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে আমরা জাতিসংঘে সালিশ চাইব।
১ ডিসেম্বর সিলেটে সকাল-সন্ধ্যা হরতালসহ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের ভেতরে ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সংগঠন। জাতিরাষ্ট্রের অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় টিপাইমুখ ইস্যুতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য এ আন্দোলনকে বাস্তবিক সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাক, দেশবাসী সেটাই দেখতে চায়।
তিস্তা এবং টিপাইমুখ নিয়ে কানামাছি খেলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে মাতিয়ে রেখেছিলেন ভারতশক্তির পাকা খেলোয়াড় সে দেশের মিষ্টভাষী প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠকে তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকা কথা দিয়েছিলেন, খুব শীঘ্রই পানিমন্ত্রী আর অন্যান্য পানি বিশেষজ্ঞ দলবল পাঠিয়ে তিনি তিস্তার পানি ভাগাভাগি চুক্তি সই করিয়ে ফেলবেন। বলেছিলেন, আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে দিলি্ল এখন দূরের বন্ধুর চেয়ে কাছের প্রতিবেশীদের সহযোগিতার ওপর ভর করাই প্রয়োজন মনে করছে। নিকট প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যে নয়া বৈদেশিক নীতি ভারত অবলম্বন করেছে, তারই একটা আবশ্যকীয় নমুনা পদক্ষেপ হিসেবে ভারত শেখ হাসিনাকে তিস্তা চুক্তি উপহার দিতে যাচ্ছে। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায়ও এভাবেই তিস্তা সম্পর্কে বলা হয়েছিল, সীমান্তে গুলি করে কাঁটাতারের বেড়ার এপারে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ হবে বলেও আশ্বাস মিলেছিল। আরও আশ্বাস মিলেছিল টিপাইমুখ বাঁধে যাতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি না হয়, সে সম্পর্কে যথার্থ সমীক্ষা ও আলাপ-আলোচনা ছাড়া বাঁধ নির্মাণ হবে না (এ ব্যাপারে কথার কিছুটা ফাঁক অবশ্য রেখেছিলেন মনমোহনজি)।
সেই কূটনৈতিক সৌজন্যের উপহার আজও মেলেনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্যে। পুরো ২০১০ সালেও তিস্তা নিয়ে অগ্রগতি হয়নি। সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যায় গুলি তো বন্ধ হয়ইনি, অন্যান্য প্রক্রিয়ায় নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে 'উচিত শিক্ষা' দেওয়ার দাপট বজায় রেখেছে ভারতশক্তি। টিপাইমুখের কাজও যে বাংলাদেশে সম্ভাব্য পরিবেশনাশের সমীক্ষা ছাড়াই নেপথ্যে চালিয়ে গেছে দিলি্ল, সে কথা এখন ফাঁস হয়েছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে যখন মনমোহন বাংলাদেশ সফরে এলেন, বাংলাদেশকে বলা হলো এবং ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেরই পত্র-পত্রিকায় জোর প্রচার হলো_ এবার তিস্তা চুক্তি সই হবে, সব ঠিকঠাক।
ঢাকায় আসার আগ মুহূর্তে আবার উছিলা খাড়া হলো_ পশ্চিমবঙ্গের নয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বেঁকে বসেছেন, চুক্তিতে দেরি হবে। ভারতীয় হাইকমিশনারকে বলা হলো, চুক্তি তো দিলি্লর সঙ্গে, মমতার তথা পশ্চিমবঙ্গের ওজর-আপত্তি আমলে নিয়েই তো দিলি্ল বাংলাদেশের সঙ্গে খসড়া চুক্তি চূড়ান্ত করেছে বলে ঢাকাকে জানিয়ে গেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিনিধি। দেখা গেল, কানে তালা লাগিয়ে বসে আছে দিলি্লর সাউথ ব্লক। শেষ পর্যন্ত তিস্তা চুক্তি ছাড়াই সই হলো দ্বিতীয় হাসিনা-মনমোহন যৌথ ইশতেহার। এটুকু আশ্বাস মিলল যে, তিন মাসের মধ্যেই তিস্তা চুক্তি সইয়ের ব্যবস্থা হবে।
যেমন আবারও আশ্বাস মিলল, সীমান্তে গুলি চালিয়ে হত্যা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুলি চালানো কমলেও ভারতীয় সীমান্তসেনার সন্ত্রাস কমল না_ এই সেদিন গুলি চালিয়েও হত্যা করা হয়েছে এক বাংলাদেশি সীমান্তবাসীকে।
ওদিকে তিন মাস প্রায় শেষ হতে চললেও ঢাকা-দিলি্ল পানিমন্ত্রী পানি বিশেষজ্ঞদের আসা-যাওয়ার ঘটা ছাড়া তিস্তা চুক্তির খসড়া পাকা হচ্ছে না দেখে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটি মাথা নুইয়ে হলেও ভারতে লোক পাঠিয়ে তদবির করার উদ্যোগ নিলেন, যেমন ভারতভুক্ত প্রদেশ বা রাজ্যগুলোর প্রধানমন্ত্রীরা করে থাকেন। অতীতে কলকাতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'মুখ্যমন্ত্রী' বলে মাইকে সম্বোধন করা হয়েছিল প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে। মুখ ফসকে এমন ভুল হয়েছে ঠাউরে শেখ হাসিনা সেখানে মুখ বুঁজেই ছিলেন।
এবার তিস্তার মীমাংসার জন্য তার শখের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে ধরনা দিতে পাঠিয়ে এ দেশের সার্বভৌমত্বের অমর্যাদা করলেন নিজেই। মমতা টলেননি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব আগেই বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বোঝাপড়া ভারত সরকারের নিজস্ব ব্যাপার, আমাদের বোঝাপড়া দিলি্লর সঙ্গে। সমতার ভিত্তিতে বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষার সেই নীতি থেকে সরে এসেও শেষ রক্ষা হলো না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিস্তা চুক্তি এ বছরও হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
এমন অবমাননার পর যখন টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে ভারত সরকারের অঘোষিত অনুমোদন নিয়ে দিলি্ল নিযুক্ত প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের চুক্তি সইয়ের খবর ফাঁস হলো, মনমোহনের এমন বেঈমানিতে সম্ভবত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
২২ অক্টোবর চুক্তিটি সই হয় দিলি্লতে। এ ধরনের চুক্তি করার আগে বাংলাদেশকে জানানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা মানেনি ভারত। মণিপুর সরকার এবং প্রকল্পের অন্যতম অংশীদারের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে ১৮ নভেম্বর খবরটি ফাঁস করেছে বিবিসি। এভাবে চুক্তি সইয়ের খবর প্রকাশের চার দিনের মাথায় ২২ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাল বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলা হয়, ভারতের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশ অভিন্ন নদীতে অবকাঠামো তৈরির আগে ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনার ওপর জোর দিতে চায়। বর্তমানে দুই দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিবেচনায় বাংলাদেশ আশা করে, ভারত সরকার প্রস্তাবিত প্রকল্পের সব বিষয়ে এবং এ সম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে জানানো হবে। বাংলাদেশের উদ্বেগ কিংবা এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে এ ধরনের পদক্ষেপ জরুরি।
টিপাইমুখ নিয়ে দিলি্লর একতরফা পদক্ষেপ সম্পর্কে বিবিসির খবর পাওয়ার পর চার দিন পর্যন্ত প্রকাশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে ভারতকে চিঠি লিখেছিল। একই দিন দুপুরে ভারতের পক্ষ থেকেও প্রথম প্রতিক্রিয়া জানানো হয়।
দিলি্লতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, টিপাইমুখে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। তথা, তিনি মনমোহন সিংয়ের পুরনো প্রতিশ্রুতিরই পুনরুল্লেখ করেন, নতুন কিছু বলেননি। বাংলাদেশের চিঠির জবাবে ভারত কোনো তথ্য দেয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যই সর্বশেষ নতুন তথ্য। শুধু এ কথা বলেই মুখরক্ষা করছে দিলি্লর বাংলাদেশ হাইকমিশন ও ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
টিপাইমুখের ফলে পরিবেশনাশের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ জরিপ সাপেক্ষে দিলি্লতে টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশের বিরোধী দলনেত্রী খালেদা জিয়াও একটি চিঠি দিয়েছিলেন।
সে চিঠির জবাব মিলেছে ২৬ নভেম্বর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সংসদে বিরোধী দলনেতাকেও কোনো নতুন তথ্য দেননি, লিখেছেন_ প্রস্তাবিত প্রকল্পটিতে সেচ প্রকল্প নেই। বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ দিয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। পানি প্রত্যাহার হবে না বলে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না, ইত্যাদি।
বাংলাদেশের বরাকপুষ্ট সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা উপত্যকার মানুষ আর ভারতের বরাক উপত্যকার মণিপুরবাসী ও আসামবাসী সমস্বরে বলছে, সেচের পানি প্রত্যাহার ছাড়াই টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পে যে বন পরিবেশ ধ্বংস, ভূমিকম্পের নিয়ন্ত্রণহীনতা ও নদীপ্রবাহে অনিয়ম ঘটবে, মৌসুমের জীববৈচিত্র্যে, পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবনধারায় ও সমতলে বন্যা এলাকায় সমূহ ক্ষতি দেখা দেবে, সে কথা বিবেচনা করে মণিপুরের উজানের এবং ভাটি এলাকার জনগণ ও বাংলাদেশের জনগণ বাঁধ নির্মাণের ঘোর বিরোধী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এখন মুখ খুলেছেন। সংসদের ভেতরে এবং বাইরে স্পষ্ট করে বলেছেন, একতরফাভাবে ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ মেনে নেওয়া হবে না। বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন যে কোনো কাজে তিনি বা তার দল বাধা দেবে। সংসদে বিরোধী দলনেত্রী আগেই বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধের প্রশ্নে বাংলাদেশের অধিকার রক্ষায় রুখে দাঁড়াতে সরকারকে সবরকম সহযোগিতা করবে তার দল।
এর আগে বাংলাদেশের পানিমন্ত্রী রমেশ সেন ভারতভক্তিতে কাঁচুমাচু হয়ে বলে বসেছিলেন, দিলি্লতে যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পাঁয়তারা চলেছে সেটা তো ভারতের নিজস্ব ব্যাপার, আমাদের আগেভাগে জানাতে হবে কেন? এখন তিনিও বলছেন, দেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে; ভারত যদি বাংলাদেশকে উপেক্ষা করে তা হলে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে আমরা জাতিসংঘে সালিশ চাইব।
১ ডিসেম্বর সিলেটে সকাল-সন্ধ্যা হরতালসহ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের ভেতরে ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সংগঠন। জাতিরাষ্ট্রের অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় টিপাইমুখ ইস্যুতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য এ আন্দোলনকে বাস্তবিক সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাক, দেশবাসী সেটাই দেখতে চায়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।