আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাঙ্গা পথের রাঙ্গা ধুলায়...

কিছু মানুষ সব মিলিয়ে খুব গুছিয়ে বাঁচে। তারা সময়মত ঘুম থেকে জাগে, যা করতে হবে তা কাল করব ভেবে ফেলে না রেখে তক্ষুনি করে ফেলে, তাদের লিস্টিতে থাকা কাজগুলোর পাশে ঠিক করে টিক পরে। আমি তাদের দলে পড়ি না, বরং অন্য কোন গ্রহের প্রাণী বলে মনে হয় তাদের। তারাও আমাকে এলিয়েন ভাবে হয়ত। যাকগে, তাতে কিছু যায় আসে না আমার।

আমি একলা একলা বেশ ভাল থাকি। আজ সকালে ঘুম থেকে জাগতে ভারী কষ্ট হচ্ছিল। মা তবু ঠেলে তুলে পাঠিয়ে দিত ভোরবেলার ক্লাস ধরতে। কি হবে ওইসব ক্লাস করে? একটা অক্ষরও মাথায় ঢোকে না আমার। আমি জানালার পাশে বসি।

বাইরে একটা গাছের ডালে পাখির বাসায় সংসার পাতা পাখিদের দেখি। আমি জানি না কোন পাখির কি নাম! কেউ শেখায়নি আমাকে। আমিও আর নিজে শিখে নিইনি। শুধু চড়ুই পাখিরা এসে আমার বাসার বারান্দায় দিনরাত কিচিরমিচির করে বিরক্ত করে ফেলার পর আমি তাদের নাম জেনেছি রহিমা বুয়ার কাছে। পাখিগুলো ভারী বাচাল।

রাতজাগা আমাকে ঠিকমত ঘুমাতে দিত না এরা। তবু এদের কিছু বলিনি আমি। বরং ভোরে জেগে এদের ঝগড়াঝাটি, আদর দেখতে দেখতে একসময় অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। একদিন হুট করেই এরা যে কোথায় চলে গেল! নাকি রহিমা বুয়া মায়ের কথায় এদের বাসা ভেঙ্গে দিল আমি ঠিক জানি না। এরপর পাখিদের সাথে আমার আর কোন বন্ধুত্ব হয়নি! শুধু ক্লাসরুম থেকে দেখতে পাওয়া পাখিদের আমার কেমন চেনা চেনা মনে হয়! মনে হয় আমার বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পর এরা এখানে এসে সংসার পেতেছে।

প্রকৃতি কখনও এদের তাড়িয়ে দেবে না। প্রকৃতি কখনও তার সন্তানদের তাড়িয়ে দেয় না। আজকাল আমি প্রতিটা ক্লাসেই ওই একই চেয়ারে বসি। ওখানে না বসলে পাখিদের দেখতে পাব না বলে রোজ আগে আগে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। অন্য কেউ ওখানে বসে পড়লে এত খারাপ লাগে আমার! আমি সেদিন ক্লাস করি না।

বেরিয়ে পড়ে এলোমেলো হেঁটে বেড়াই। কোনদিন একা একা ক্যাফের কোণার দিকের একটা টেবিলে বসে বই পড়ি, কার্জন হলের পুকুর পারে বসে থাকি, কোনদিন শহীদ মিনারে বসে আড্ডায় মশগুল সবাইকে দেখি, কোনদিন পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে ওয়ান ডিরেকশনের গান শুনি, 'you don't know you're beautiful'....................আমিও তো মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটি, মাঝে মাঝে একা একা হাসি। আমিও কি সুন্দর? আমিও কি সেটা জানি না বলেই বেশি সুন্দর? কে জানে? সেদিন ক্লাসে একটা টেস্ট ছিল। কেউ আমাকে জানায় নি। হুট করে ১২ মিনিট লেইট করে ঢুকে দেখি সবাই পরীক্ষা দিচ্ছে।

স্যার মহা বিরক্ত হয়ে আমার হাতে খাতা আর প্রশ্ন ধরিয়ে দিলেন। আমি অবাক হয়ে ক্যালকুলাসের ম্যাথগুলোতে নজর বুলিয়ে তাকালাম বাইরে গাছের দিকে। পাখির বাসায় কেউ নেই আজকে। বাচ্চাগুলো উড়তে শিখে গেছে হয়ত। ওদের নিজস্ব জীবন তৈরি হয়ে গেছে।

আমি খাতা ভর্তি করে ইচ্ছেমত ম্যাথ করলাম এরপর। বেশ সোজাই মনে হল। নিজের মত করে কোন কিছু সমাধান করার আনন্দই অন্যরকম। এরপর বের হতে যাব, তখন ক্লাসের এক মেয়ে, নাম মনে নেই আমাকে এসে বলল, এত ভাব না নিলে হয় না তোমার? কারো সাথে কথা বল না, কি ভাব নিজেকে? আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও আমাকে ফেলে চলে গেল। আমি সেদিন সারা বিকেল রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম।

তারপর রাতের আঁধার এসে শহরটাকে ডুবিয়ে না নেয়া পর্যন্ত হাঁটলাম আর মানুষ দেখলাম। তারপর হঠাৎ গায়ের উপর দিয়ে একটা বাস চলে গেল আমার। আমি কি রাস্তা পার হচ্ছিলাম? আমি কি ভাবছিলাম? কিচ্ছু মনে নেই আমার আর। কাউকে কিছু বলা হল না আমার। কারো গল্প শোনা হল না, কাউকে আমার গল্প বলাও হল না।

আমি যে ছবি আঁকতে ভালবাসতাম, ক্লাসের প্রতিটা মুখের পোরট্রেট করে যে লুকিয়ে রেখেছিলাম বইয়ের তাকের পেছনে, সেগুলো যে তাদের কোনদিন দেবার ইচ্ছা ছিল কেউ জানল না। আমি ইঞ্জিনিয়ার হতে পারব না জেনেও আমার কোন দুঃখ ছিল না, আমার নিঃশব্দ পথচলার গল্প কেউ জানল না ভেবেও না, শুধু একটাবার মায়ের মুখটা ঠিক করে আঁকা হল না, মা সেই ছবি দেখে বলল না, 'দারুণ আঁকিস তো তুই। থাক বাদ দে। তোর ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে না। তুই চারুকলায়ই পড়' সেই দুঃখ কেন যে আমাকে ছেড়ে যায় না! একটা জীবন, একটা মানবজন্ম পেয়েছিলাম।

কিছুই করা হল না আমার। ... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.