আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাইফ ইসমাইল এর গল্প ফেরেশতা

ফেরেশতা সাইফ ইসমাইল এক. অস্বস্তিতে ভুগছেন নেযামুদ্দিন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপরিসর ও অপরিচ্ছন্ন ওয়েটিং রুমে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোক বিগত চার বছর যাবৎ থাইরয়েড ক্যান্সারে ভুগছেন। শীর্ণকায়। বয়স ৪০ বছর হলেও ক্যান্সারের কল্যাণে বেশ বয়স্ক মনে হয়।

পেশায় প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নেযামুদ্দিন এসেছেন চকরিয়া থেকে। উপলক্ষ গিন্নির জন্ডিস সারানো। নিষ্ঠুর সময় আর স্বার্থপর দৈন্যতায় নাড়ীর বন্ধন ছিন্ন অনেকের সাথে, ফলে লালদীঘির পাড়ে চিলেকৌঠার বোর্ডিং এ উঠেছেন। গিন্নি সাজেদা বেগম আর দুই পুত্র হাসান ও হোসাইন তার শান্ত নীড়ের সদস্য। হাসানের বয়স আট আর হোসাইন চার এ পড়েছে গেল মাসে।

হাসান খানিকটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। অসুখটা বেশী জোরালো না হলেও মাঝে মধ্যেই মাথা চাড়া দেয়। যেমন আজ, এই মুহুর্তে। নেযামুদ্দিন ভেবে পাচ্ছেন না কী করবেন। অগ্নাশয়ের জ্বালা নিয়ে কাতর তার পোয়াতী গিন্নির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে কষ্ট কমাবেন না হাসান-হোসাইনের প্রতি খেয়াল রাখবেন।

এদিকে আজ ঘোর অমাবস্যা। প্রকৃতির রুদ্র কালিরূপ ঘোর অমাবস্যার কথা ক্রমাগত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে দেখে জনৈক অভিভাবকের কৌতুহলের জবাবে গাইনী ওয়ার্ডের বয় সুনীলের মুখেই শোনা। ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘর ছুঁতে না ছুতেই হাসপাতালের অপরিসর বারান্দা আর ওয়েটিং রুম কানায় কানায় পূর্ণ। অধিকাংশ রোগীই এসেছেন প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে। আর কপালটাই যেন খারাপ- একের পর এক ঝামেলায় আক্রান্ত নেযামুদ্দিনের মাথায় ঘুরছে কথাটা।

কারণ, কিছুক্ষণ আগেই আটমাসের পোয়াতী স্ত্রী'র 'রক্ত' ভাংতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়ছে নেযামুদ্দিনের রোগী ও সন্তানদের। অপেক্ষা, কখন ডাক্তারের ডাক আসে। এ অবস্থায়ও ধৈর্য্যের পরীৰা দিতে হচ্ছে। কারণ সব রোগীরই অবস্থা সাংঘাতিক।

ফলে কাউকে ডিঙিয়ে কেউ আগে পার হবে সে অবস্থা আৰরিক অর্থেই নেই। দুই. দুঃস্বপ্নে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় মাকসুদ মিঞার। ঘড়ির কাঁটা ভোর চারটায়। অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে ওঠে তার। চোখ কচলাতে কচলাতে বাথরম্নমে গিয়ে দ্যাখেন দরজা বন্ধ_অকুপাইড।

দু'জনের সংসারের অবশিষ্টজন গিন্নি কানন বেগম। অপেক্ষা করেন বেরুবার। এক মিনিট দু'মিনিট করে দশ মিনিট পেরিয়ে যায়। কানন বেগমের বেরম্নবার নাম গন্ধও নেই। বাথরুমের দরজায় কান পাততেই ভেতর থেকে গোঙ্গানীর শব্দ ভেসে আসে।

বুকটা ধ্বক করে ওঠে মকসুদ মিয়ার। মুহুর্তেই রাজ্যের ঘুম উবে যায়। চিৎকার করে ডাকতে থাকেন প্রিয়তমাকে। অবশেষে দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন কানন বেগম। ঘর্মাক্ত-বিধ্বস্ত মূর্তি।

ধরাধরি করে বিছানায় বসাতেই কান্না জড়িত কন্ঠে কানন জানায়, 'পানি ভেঙে গেছে'। মাথা ঘুরে ওঠে মাকসুদ মিঞার। অনেক দিনের পুরনো সংসারে নতুন মুখ আসবে এ আশায় বুক বেধে বিগত আট মাস ধরে টানাটানির সংসারেও দু'জনে সুখের স্বপ্ন দেখছিল। সংবিৎ ফিরে পেয়ে মাকসুদ মিঞা তাড়াতাড়ি প্রাকৃতিক কাজ-কর্ম সেরে কর্তব্য নির্ধারণের আশায় বাথরুমে ঢুকে। খটাস শব্দে কাননের বুক লাফিয়ে ওঠে।

কিছুক্ষণ পর স্বামী বেরুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। মকসুদ মিয়া জানায় বেখেয়ালে পা বাড়াতে গিয়ে ফ্লোরের কার্নিসে পড়ে গেছে। বউ চিন্তিত হবে ভেবে আঘাতের কথা চেপে যায়। তবে স্বামীর চেহারা দেখে ঠিকই আন্দাজ করেন কানন বেগম। বড় কিছু হয়নি এটুকু ভেবে আর কথা বাড়ান না।

হতবিহ্বল মাকসুদ মিঞা অবশেষে আন্দরকিল্লা রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদনে যাওয়ার চিন্তায় সকালের অপেক্ষায় থাকে। বাথরুমে পড়ে যাওয়া হাটুর আঘাতের সাথে যোগ হয়েছে ক্ষুধা। এমনই দুর্ভাগ্য যে, বিস্কুটের টিন কবে খালি হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। স্বামীর কষ্টের কথা ভেবে কাননও চুপ মেরে গেছে। গতরাত থেকে রান্নাঘরের লাইনে গ্যাসও আসছে না।

গেল দুপুরে ছোট ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত খেয়ে আসার পর আর খাওয়া হয়নি তার। কানন অবশ্য রাতে দেবরের সাথে এসেছে। স্বামীর জন্য ভাত চড়াতে গিয়ে আবিস্কার করে গ্যাস নেই। ঘরেও কেউ নেই যে, দোকানে পাঠাবে_ কিছু আনার জন্য। গাড়ী বন্ধ করে গভীর রাতে মাকসুদ মিঞা ঘরে এসে প্রাত্যহিক প্যাঁচালের সাথে পাঁচন শুনে মনে মনে রেগে গেলেও স্ত্রীর অসুস্থতার এ সময়ে তাকে কিছু বলে না।

দু'গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ে শ্রান্ত শরীর নিয়ে। ভোরের অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত-শ্রান্ত-আহত মাকসুদ মিঞা চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। বেখেয়াল আচরণের জন্য নিজের উপর রাগ করে কাননও স্বামীকে আর জাগায় না। মা হতে চাইলে নারীকে কষ্ট সইতেই হবে_ একথা ভেবে কানন সব যন্ত্রণা সহ্য করে যায়। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় মাকসুদ মিঞার তন্দ্রা ভেঙ্গে যায়।

চারদিক চোখ বুলিয়ে ফোন তুলে নেয়। দেখে ম্যাডাম ফোন করেছেন। তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করে ম্যাডামকে 'আসছি' বলে ফোন রাখে। লজ্জায় আর ঘরের কথা বলেনা। এমনিতেই তার দেরী হয়ে গেছে।

ভাবে সরাসরি সাহেবকেই বলবে। কোন মতে চোখে পানি দিয়ে কাননকে প্রস্তুত থাকার জন্য বলে সাহেবের বাসা অভিমুখে এগিয়ে যায়। তিন. চৌধুরী সাহেব আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিতে যাবেন এমন সময় কলিংবেলটা বেজে ওঠে। ঘরে কেউ নেই_ বউ অফিসে, বাচ্চাকে নিয়ে কেয়ারটেকার স্কুলে, বুয়া এসে চলে গেছে কারণ মেয়ের অসুখ। ফলে কোনমতে একটা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে দরজা খুলে দেখেন তার ড্রাইভার মাকসুদ মিঞা।

মলিন মুখ, উস্কো-খুস্কো চুল, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গোফ, পরনে সাদা শার্ট আর লুঙ্গি। সমস্যার গন্ধ পেয়ে ড্রাইভারকে ভেতরে বসান চৌধুরী সাহেব। কিছু খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই 'না' সূচক জবাবে ভেতরে যান তিনি। ডাইনিং টেবিলে পাওয়া রুটি-ভাজি-ডিম আর চা নিয়ে বসার ঘরে আসেন। বসার ঘরের কোনায় পানির জার আর গ্লাস থাকে তাই ওগুলো আনেননি।

বললেন, খান। মাকসুদ মিঞা প্রথমে ইতস্তত করলেও খাওয়া শুরু করে। : কী হয়েছে, সকালে আসেননি? : জে না। : ম্যাডামের সাথে দেখা হয়েছে? : জে। : কী বলেছেন? : আপনের সাথে কথা কইতে।

আমেনার মা'র অসুখ : কানন ভাবীর কী হয়েছে? : 'পানি ভাঙছে'। : এখন কোথায়? : ঘরে। : হাসপাতালে নেননি?! : জে না। অহন যামু। আপনের লগে দেখা করতে আইছি।

আহারপর্ব যত দ্রম্নত সম্ভব শেষ করেন, মাকসুদ মিঞা। চৌধুরী সাহেব যা বুঝার বুঝতে পেরে মাকসুদ মিঞার খাওয়া শেষ হলে কী করতে হবে, কোথায় নিতে হবে বুঝিয়ে দেন। টাকা-পয়সা লাগবে কি না জিজ্ঞাসার উত্তরে 'না' সূচক জবাব দেয়। সাহেবকে সালাম দিয়ে মাকসুদ মিঞা বেরিয়ে পড়ে_ চৌধুরী সাহেব আবারও কোন সমস্যা হলে নির্দ্বিধায় তার সাথে যোগাযোগের জন্য তাকে মনে করিয়ে দেন। ঠান্ডা কাপ হাতে নিয়ে সকালের দৈনিকে চোখ বুলান চৌধুরী সাহেব।

আজ বেশ দেরী হয়ে গেছে। পেশায় ডিজাইনার চৌধুরী দেরী করে ঘুমিয়েছেন। ক্লায়েন্টের তাড়া আর বেশ কিছু জমে থাকা কাজ সারতেই রাত জাগা। আরো দু'একটা রাত জাগতে হবে ঈদের আগেই কাজগুলো গোছানোর জন্য। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই চৌধুরী সাহেব বিগত ক'দিন পেশার প্রয়োজনে বাইরে ছিলেন।

ফলে অনেকগুলো ডিজাইন জমে গেছে। কাজের মান ঠিক রাখার জন্য ডিজাইনের শেষ টাচ্ সাধারণত তিনিই দিয়ে থাকেন। যদিও দক্ষ লোকবল তাঁর যথেষ্ট আছে। তাঁর কথা_ 'ক্লায়েন্ট আমার উপর আস্থা রেখেই আমাদের কাজ দেন। সুতরাং আমাদেরও তাঁদের আস্থার যথাযথ মূল্যায়ন ও মর্যাদা দেয়া উচিত'।

বুধবারে চৌধুরী সাহেবের জন্য তার নিয়মিত দৈনিকে দৈনন্দিন খবরাখবর ছাড়া পড়ার মত তেমন কিছু থাকে না। ফলে তাড়াতাড়িই কাগজ পড়া শেষ হয়ে যায়। ধোপ দুরস্ত হয়ে অফিস অভিমুখে রওয়ানা দেন। হাঁটা দূরত্ব। অফিসে পৌঁছেই দৈনন্দিন কাজগুলো সারতে থাকেন।

ঘড়িতে সময় ১২টা। ইতোমধ্যে লাঞ্চ নিয়ে বেয়ারা হাজির। এমনিতেই দেরী করে অফিসে এসেছেন ফলে সকালের ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য যোহরের নামায শেষ করেই কাজে বসে গেলেন_ আজ আর বিশ্রামের সুযোগ নেই। হঠাৎ ফোন বেজে উঠে। ড্রাইভার মাকসুদ মিঞা।

কান্না জড়িত কন্ঠে জানায়, মাতৃসদনের ডাক্তার আপা বলেছেন রোগীর অবস্থা ভালো না। বাচ্চার নড়াচড়াও পাচ্ছেন না। যতদ্রুত সম্ভব মেডিকেলে নিয়ে যেতে। আদ্যোপান্ত শুনে আধা ঘন্টার মধ্যে মেডিকেলের ইমার্জেন্সীতে রোগীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাকসুদ মিঞাকে বলেন চৌধুরী সাহেব। তিনি আসছেন বলে ফোন ছাড়েন।

পেশাগত কারণে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিছু ডাক্তারের সাথে সখ্য গড়ে উঠেছিল তবে তাঁদের প্রায় সকলেই এখন চট্টগ্রামে নেই। কার সাহায্য নেয়া যায়_ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বড় আপার মেয়ে রুম্পার কথা মনে পড়ে যায় চৌধুরী'র। চার. সাদিয়া ফারহানা রুম্পা, বেশ চট্পটে মেয়ে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এ থার্ড ইয়ারে পড়ে। বাবার চরিত্রের ছটফটানো স্বভাব পেলেও সবাইকে আপন করে নেয়ার চমৎকার গুনটি পেয়েছে মা চৌধুরী সাহেবের গিন্নির বড় বোনের কাছ থেকে।

ছোট-বড় সবাই তাকে পছন্দ করে। আংকেলের ফোন আর মাকসুদ মিঞার বউয়ের কথা শুনে দ্রুততার সাথে 'এপ্রোন' জড়িয়ে মা'কে পুরো ঘটনা জানিয়ে চমেক হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে রুম্পা। বেলা তিনটা। চমেক হাসপাতালের ৩৩নং ওয়ার্ড। গাইনি বিভাগ।

রোগী আর স্বজনদের পদভারে এমনিতেই মুখর থাকে এ ওয়ার্ড। আজ আরো বেশী। চৌধুরী সাহেব ইতোমধ্যে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে মাকসুদ মিঞা আর তার স্ত্রীকে গাইনি ওয়ার্ড পর্যন্ত এনেছেন। এখন অপেক্ষা প্রাথমিক চেক-আপ পর্বের। অনেক রোগী।

মাত্র দু'জন ইন্টার্নী ডাক্তার। এক এক করে চেক-আপ করতে করতে গলদঘর্ম হচ্ছেন। অভিজ্ঞ ওয়ার্ড বয় 'সুনীল দাদু' বলেছেন আজ নাকি আরো অনেক রোগী আসবে। কারণ, ঘোর অমাবস্যা। সাথে হিন্দুদের 'কালী পূজা'।

ইতোমধ্যে ডিউটি রোস্টার পাল্টেছে। নতুন দু'জন এসেছেন_ ডা. ফাতিমা এবং ডা. শেফালী। নতুন ডাক্তার নবোদ্দ্যমে কাজ শুরু করলেন। গতি বাড়লো। সিরিয়ালও কমছে।

রুম্পা তার আংকেল ও মাকসুদ মিঞাকে নিয়ে ডিউটি ডাক্তাররের রুমের সামনে অপেক্ষা করছে। কানন বেগম ওয়েটিং রুমে, অন্য রোগীদের সাথে। হঠাৎ একটি রোগীর এটেনডেন্টকে দেখিয়ে চৌধুরী বলেন, 'দ্যাখ রুম্পা, লোকটা কেমন যেন! অসুস্থ বউকে পেছনে রেখে দু'টো বাচ্চাকে নিয়ে আগে আগে চলে যাচ্ছে। আর বেচারী বউটা হাঁটতেও পারছেনা। ' আংকেল চৌধুরী সাহেবের কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায় বউটি।

'ইবার অসুখ। মাথাত সমস্যা আছে। "- বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বউটি লেবার রুমের দিকে হাঁটতে থাকে। পরিধেয় কাপড়ের নিম্নভাগ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। মহিলাটি'র কথা শুনে কিছুটা লজ্জিত কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়_ রুম্পা এবং তার আংকেল।

ওয়ার্ড বয়ের ডাকে সম্বিত ফিরে আসে_ : কানন বেগম কন, কানন বেগম? হন্তদন্ত হয়ে রুম্পা কানন বেগমকে নিয়ে ডিউটি রুমে প্রবেশ করে। দীর্ঘক্ষণ ধরে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডা. ফাতিমা বলেন, 'রুম্পা রোগীর অবস্থা ভালো না। ভর্তি করতে হবে। এই টিকিট আর কাগজগুলো নিয়ে লেবাররুমে যাও আর ঔষধগুলো আনিয়ে রেখো যদি লেবাররুম থেকে বলে'_ এই বলে একটি ঔষধের তালিকা ও কাগজপত্র তার জুনিয়র রুম্পার হাতে বুঝিয়ে দেয় আর কানন বেগম তার জা'কে (দেবরের বউ) ধরে হাঁটতে হাঁটতে লেবার রুমের দিকে অগ্রসর হয়। বড় জা'র কথা শুনে রাশিদা কিছুক্ষণ আগে তার স্বামী পুত্র সমেত এসেছেন।

লেবাররুমে আবারও সিরিয়াল আবারও অপেক্ষা। অবশেষে ডিটেইল চেক-আপের পর লেবাররুমের ইনচার্জ ডা. জমিলা রুম্পার হাতে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে বাইরের ল্যাব এ গিয়ে কিছু পরীক্ষা করিয়ে আনতে বলেন। রুম্পা তার এপ্রোনের মর্যাদা বুঝতে পেরে আনন্দিত হয়। পরীক্ষার জন্য বের হয়। ইতোমধ্যে চৌধুরী সাহেব তার ড্রাইভারকে একপাশে ডেকে নিয়ে কী কী করতে হবে বুঝিয়ে দেন এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দিকে রওয়ানা হন।

ঘড়ির কাঁটায় বিকেল সাড়ে চারটা। ভালোয় ভালোয় পরীক্ষাদি শেষ করে আবারও হাসপাতালে পৌঁছে যায় সবাই। ইতোমধ্যে মাকসুদ মিঞার খাওয়া আর চৌধুরী সাহেবের নামাজ পর্বও শেষ। ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর লোকগুলোর অমায়িক ব্যবহার ও করিৎকর্মা চেহারায় সকলে মুগ্ধ। রিপোর্টগুলো লেবাররুমের ডাক্তার এর কাছে জমা দেয়ার কিছুক্ষণ পরই চৌধুরী সাহেবের ড্রাইভার মাকসুদ মিঞার স্ত্রী কানন বেগমের এ্যাডমিন পর্ব শেষ হয়ে চূড়ান্ত্ চিকিৎসা আরম্ভ হয়।

রুম্পা তার আংকেলকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হতে ওয়ার্ডের দরজার দিকে রওয়ানা হয়। দু'জনে খেয়াল করে, একটি বয়স্কা মহিলা দুপুরে দেখা অদ্ভুত সেই লোকটাকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ভৎর্সনা করছে। ঘড়ির কাঁটা সাতটার ঘরে। পাঁচ. কৌতুহল নিয়ে চৌধুরী সাহেব এগিয়ে যায়। মহিলার কথার সারমর্ম হলো, সেই দুপুর থেকে লোকটির স্ত্রী লেবাররুমে বিনা চিকিৎসায় পড়ে আছে।

অনেকক্ষণ তালাশ করেও স্বজনদের কাউকে পাওয়া যায়নি। এখন ঔষধ এবং রক্তের অভাবে রোগীর অবস্থা শংকটাপন্ন। যায় যায় অবস্থা। তাড়াতাড়ি রক্ত দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। মহিলার মুখে সবকিছু শোনার পর নেযামুদ্দিন হতাশায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।

এদিকে সারাদিনের ক্ষুধা-পিপাসা-ক্লান্তিতে হাসান-হোসাইনের অবস্থাও তথৈবচ। চৌধুরী সাহেব এগিয়ে যান। সবকিছু শুনে বোঝার চেষ্টা করেন। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। রুম্পার দিকে তাকালেই 'হা' সূচক জবাব মেলে।

দু'জনে নতুন যুদ্ধে নেমে পড়েন। রুম্পার এপ্রোন আজ এতটুকু কাজে লাগবে একথা রুম্পা কিংবা তার আংকেল কল্পনাও করেননি। রুম্পার প্রত্তুৎপন্নমতিত্ব এবং চৌধুরী সাহেবের সংকল্পে সাজেদা বেগমের চিকিৎসা আরম্ভ হয়। ডাক্তার জমিলা আবারও রুম্পাকে লেবাররুমে দেখে জিজ্ঞেস করেন কী ব্যাপার। সবকিছু শোনার পর তিনি অবাক দৃষ্টিতে রুম্পার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

সম্ভবত: মনে মনে দোয়াও করেন। রুম্পা আর তার আংকেল ইতোমধ্যে পুরো ওয়ার্ডে পরিচিত মুখ হয়ে গেছেন। রুম্পার এপ্রোন এরই মধ্যে এক ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে ফেলেছে। রোগীকে রক্ত দেয়ার কাজও শুরু হয়ে গেছে। ঘড়িতে রাত নয়টা।

রুম্পা তার আংকেলকে বলে, 'সন্ধানী থেকে তো এক ব্যাগ রক্ত ব্যবস্থা করা গেল কিন্তু আংকেল রোগীর জন্য তো প্রচুর রক্ত লাগবে। রাতের মধ্যে কমপক্ষে আরো চার ব্যাগ। সন্ধানীকে রিকোয়েস্ট করেছি। রুম্পার ভাষায়, 'কিন্তু ওরা রাতের মধ্যে স্টক না থাকার কারণে দিতে পারবেনা বলে জানিয়ে দিয়েছে। এখন কী করি, অবশ্য আমার রক্তের গ্রুপ 'এ পজিটিভ'।

আমি দিতে পারবো। তবে, এখন দিলে তো মনে হয় বেহুশ হয়ে যাব। চলেন আগে কিছু খেয়ে নিই। রুম্পার কথায় চৌধুরী সাহেবের খেয়াল হয়, দুপুরের স্বল্পাহারের পর একটা দানাপানিও পেটে পড়েনি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।

দ্রুত হোটেলের দিকে রওয়ানা দেন তার ভাগ্নি রুম্পাকে নিয়ে। এদিকে মাথায় ঘুরছে শুধু একটি কথা, 'চার ব্যাগ রক্ত। রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ'। খাবার খেতে খেতে হঠাৎ চৌধুরীর মাথায় আসে, আচ্ছা এসএমএস এর মাধ্যমে বন্ধুমহলে আবেদন করা যায় না? যেই ভাবা সেই কাজ। খাবার শেষ হয়নি হঠাৎ ফোন বেজে উঠে।

: এডভোকেট জিয়া হাবীব বলছি। 'এ পজেটিভ' রক্ত লাগবে বলে একটা এসএমএস পেলাম। কখন কোথায় দিতে হবে? : আসুন, এক্ষুনি লাগবে, চমেক ব্লাড ব্যাংকে_ আমরা আছি। ফোন কাটতে না কাটতেই আবারও ক্রিং ক্রি... : চৌধুরী গোলাম রব্বানী বলছি। রক্ত কোথায় দিতে হবে? অনার্স পরীক্ষার্থী আমার এক ভাই রক্ত দেবেন।

তাঁর জন্য শুধু একটু দোয়া করবেন। : হ্যালো, অধ্যাপক তানবীর মুহাম্মদ বলছি, .... .... .... : ডা. মিজান বলছি, .... মিনিট দশেকের মধ্যে চারজন ব্লাড ডোনার রেডী। স্বেচ্ছায় স্বখরচে রক্ত দিতে হাসপাতালে আসছেন। হোটেল থেকে হাসপাতালের দূরত্ব ৩০০ গজের বেশী নয়। কিন্তু এ দূরত্বও যেন শেষ হয় না।

কোনমতে হাসপাতালে এসে পৌঁছানোর পর এক এক করে চারজনের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ শুরু করে মামা-ভাগ্নি। ঘড়িতে রাত সাড়ে নয়টা। ডাক্তারদের অবাক চোখের সামনে পৌঁ ছে দেয়া হয় রক্ত। নেযামুদ্দিন আর হাসান-হোসাইনের জন্য অল্প খাবার এনে তাদেরকে খাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে বাসার পথ ধরে দু'জনে। ঘড়ির কাঁটায় ভর করে সময় তখন রাত সাড়ে এগারটা।

গাইনী ওয়ার্ডের দরজা পেরিয়ে বেরুবার সময় দুইজন রোগীর কথোপকথন রুম্পার কানে আসে। চৌধুরী সাহেব ও রুম্পাকে দেখিয়ে একজন জিজ্ঞেস করছে, : ইতারা কন? [এরা কারা] : ফেরেশতা। : ফেরেশতা!? : আল্লায় ফেরেশতা পাঠাইয়্যে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।