পর পর পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার-সমর্থিত পাঁচজন প্রার্থীই পরাজিত হয়েছেন। গণতন্ত্রে নির্বাচনে হারা স্বাভাবিক একটি বিষয় এবং অবশ্যই শেষ কথা নয়। আজকের পরাজিত প্রার্থীরাই আগামী দিনের বিজয়ী। গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মূলমন্ত্রই এটি। তথাপি, প্রতিটি নির্বাচন শেষে হার-জিতের নানা বিশ্লেষণ হয়, যা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিজয় ও পরাজয়ের প্রধান কারণগুলো নির্ণয়ের চেষ্টা চালান।
গণতন্ত্রে এটি একটি স্বাস্থ্যকর চর্চা।
সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনের ফলাফলের কারণগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। শাসক দল আওয়ামী লীগ মনে করে, তারা জনগণের কাছে প্রদত্ত বেশির ভাগ প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পেরেছে এবং বাকিগুলোতেও খুব একটা পিছিয়ে নেই। অন্যদিকে, বিরোধী দলের মতে, সরকার তাদের প্রতিটি প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা যা করছে সবই খারাপ। আবশ্যিকভাবে কোনো পক্ষের দাবিই পুরোপুরি সঠিক নয়।
সরকারের ব্যর্থতা যেমন থাকে, তেমনি সফলতাও থাকে। এর মাত্রা কমবেশি হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আপনি আপনার ভোটারদের কাছে সঠিক বার্তাটি কীভাবে পৌঁছাবেন, যাতে করে ভোটকেন্দ্রে ভোট প্রদানের আগ পর্যন্ত ভোটাররা সেটি স্মরণ রাখবেন?
সাধারণত, গণমাধ্যম জনগণকে অবহিত করার গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে থাকে এবং ভোটারদের মতামতকেও তারা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রভাবিত করে। অবশ্য অপ্রপ্রচারের মাধ্যমেও জনমত তৈরি করা যায়। আমেরিকার বিখ্যাত ভাষাবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কির ভাষায়, অপপ্রচারের মাধ্যমেও জনমত তৈরি করা যায়।
অপর দিকে, নাগরিক সমাজও তার স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে জনগণকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সচেতন করে তোলার ভূমিকা পালন করে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর সর্বাধিক কার্যকর ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মীরা। চূড়ান্ত বিচারে তাঁরাই কিন্তু ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নির্বাচনী কৌশল অনুযায়ী নিজেদের বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সঠিক (অথবা ভুল) তথ্যগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরেন এবং তাঁদের নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। সুতরাং, তৃণমূল পর্যায়ে জনমতকে প্রভাবিত করায় তাঁরাই প্রধান নিয়ামক।
বলা হয়ে থাকে, তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা সবচেয়ে শক্তিশালী।
এর প্রধান কারণ, তাদের রয়েছে একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এ ক্ষেত্রে খুব একটা পিছিয়ে নেই। ১৯৯১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই দুবার করে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল (আওয়ামী লীগের বর্তমান মেয়াদসহ) এবং ভোটাররা এই দুই দলেরই সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে অবগত আছেন। তাদের উভয়ের বিরুদ্ধেই ব্যাপক দুর্নীতি, সরকারি সম্পদের অপব্যবহার ও অপশাসনের অভিযোগ রয়েছে। মাত্রা কমবেশি হতে পারে, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই মনে করে, অভিযোগগুলোর যৌক্তিকতা রয়েছে।
সুতরাং, এসব বিবেচনায় ভোটাররা এ দুই দলের কারও প্রতি বেশি আকৃষ্ট হওয়াই অস্বাভাবিক। তারা যতই ভালো সাজার চেষ্টা করুক, জনগণের হাতে তাদের দুই দশকের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান রয়েছে। পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্লেষণ করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনাস্থার এই পরিস্থিতিতে এটা ধারণা করা অমূলক নয় যে কাকে ভোট দেওয়া হবে, সেটি নির্ধারণে দল বিবেচনায় না নিয়ে ভোটাররা বরং প্রার্থীদের যোগ্যতা ও তাঁদের সাফল্য-ব্যর্থতাকেই বিবেচনায় নেবেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিটি নির্বাচনে বিষয়টি এভাবে কাজ করেনি।
তাঁরা বিপুল ভোটে এমন লোকদের নির্বাচিত করেছেন, যাতে এটা প্রতীয়মান হয় যে তাঁরা প্রার্থীদের গুণাগুণ বিবেচনা না করে দলীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে এ ধারণা পাওয়া যায় যে শাসক দলের পরাজিত প্রার্থীরা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চেয়ে তুলনামূলক ভালো ছিলেন এবং তাঁদের পারফরম্যান্সও উল্লেখযোগ্য। এখানেই প্রশ্ন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে কোন বিষয়টি দোদুল্যমান ভোটারদের বেশি প্রভাবিত করেছে? উত্তরটি সম্ভবত ধর্মের (অপ)ব্যবহার। নির্বাচনী ফলাফল থেকে প্রতীয়মান হয় যে দুটি ধর্মীয় সংগঠন শাসক দলকে ইসলামবিরোধী শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করতে ‘স্বতন্ত্র’ ভোটারদের একটি বড় অংশকে সফলভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে।
তাহলেও প্রশ্ন থাকে, সে ক্ষেত্রে শাসক দল তাদের ভাষ্যমতো এই ‘অপপ্রচার’কে কেন প্রতিহত করতে পারেনি? এই প্রশ্নের উত্তরই ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রচারণা আপাতদৃষ্টিতে কেন সফল হয়েছে, আমাদের সেটি খুঁজে বের করতে সহায়তা করবে।
ধরে নেওয়া যাক, শাসক দল বা জোট ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বে গেল না, সে ক্ষেত্রে কী হতো? একটি সম্ভাব্য চিত্র হচ্ছে, সরকারের বিরুদ্ধে অপশাসনের অভিযোগ সত্ত্বেও তাদের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থাকতেন এবং যেসব প্রার্থীর ভালো ভাবমূর্তি রয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগ নির্বাচিত বা পুনর্নির্বাচিত হতেন। এর অন্যতম কারণ, দল হিসেবে প্রধান বিরোধী দলের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি ও অপশাসনের সীমাহীন অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা বিগত সরকারের সময় রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তৎকালীন শাসক দলের প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনুর নির্বাচিত হওয়ার উদাহরণকে তুলে ধরতে পারি। সে সময়ের চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, জঙ্গিবাদের উত্থান, বিরোধী নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের ওপর জঘন্য অত্যাচার-নির্যাতনের অভিযোগ কাঁধে নিয়েও সরকারদলীয় প্রার্থী
ফজলে হোসেন বাদশার মতো একজন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত জিতেছিলেন
(যদিও ফলাফল নিয়ে সে সময় কারচুপির অভিযোগ ছিল, তথাপি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাত্রাটাই এই আলোচনার মুখ্য বিষয়)।
রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটি একটি শিক্ষা যে তারা যদি তাদের দলের দুর্বৃত্তদের সামলে রাখতে না পারে এবং সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের উচিত হবে, ধর্মীয় বা যেকোনো মতাদর্শীদের সঙ্গে ঝগড়ায় না জড়ানো। কারণ, এটি কেবল তাদের নির্বাচনী পরিণতিকে আরও খারাপই করবে।
বর্তমান শাসকগোষ্ঠী এ ক্ষেত্রে দুই দিকের যুগপৎ আক্রমণের শিকার। বিগত রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলের তুলনায় অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকে তাদের ভালো করার পরও এই ধর্মীয় প্রচারণা তাদের সম্ভাবনাকে সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দৃশ্যত, বর্তমান বিরোধী দলের রাজনৈতিক সাংগঠনিক শক্তি শাসক দলের তুলনায় শক্তিশালী নয়।
এ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগেও বিরোধী দল শাসক দলের চেয়ে পিছিয়ে নেই এবং তাদের দলের নেতা-কর্মীরা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় রাজনৈতিকভাবে ততটা উদ্বুদ্ধ কর্মী বাহিনী নয়। এসব কারণে স্বভাবতই প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো কেউ কারও তুলনায় পিছিয়ে থাকত না, বরং সমানে সমানে লড়ত এবং তখন যে দলের তুলনামূলক ভালো প্রার্থী, তাঁরাই সম্ভাবনার বিচারে এগিয়ে থাকতেন।
কিন্তু বিরোধী দল তাদের নিজস্ব দুর্বলতার কারণে শাসক দলের অপশাসনের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা বলার নৈতিক অবস্থানে না থাকলেও ধর্মীয় দল বা গোষ্ঠীর অনুসারীরা, যারা ব্যাপকভাবে তৃণমূলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, শাসক দলের বিরুদ্ধে একটি ভয়ংকর নেতিবাচক প্রচারণা চালানোর যোগ্যতা রাখে এবং তাদের সে প্রণোদনাও (পরকালের পুরস্কারপ্রাপ্তির মুলা প্রভৃতি) রয়েছে। এসব ধর্মীয় দল তাদের স্বীয় আদর্শ প্রচার করে নিজেদের পক্ষে ভোট টানতে না পারলেও তারা বিবদমান পক্ষগুলোর একটির পক্ষে ও অন্যটির বিপক্ষে কার্যকর প্রচারণা চালানোর যোগ্যতা রাখে। জনগণও তুলনামূলক বিচারে এসব গোষ্ঠীর কথা বিশ্বাস করবে।
কারণ, তারা আদৌ ক্ষমতার অংশ ছিল না বা তৃণমূলে তাদের বিরুদ্ধে অপকর্মের খতিয়ানও শাসক দল বা বিরোধী দলের বখে যাওয়া কর্মীদের মতো নয়। শাসক দলের কর্মী ও বিরোধী দলের কর্মীদের সঙ্গে সমানে সমানে লড়তে পারলেও এই উদ্বুদ্ধ ধর্মীয় গোষ্ঠীর ব্যাপক প্রচারণাকে জোর গলায় প্রতিহত করার নৈতিক ও মানসিক জোর তাদের নেই।
ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর এই আশঙ্কাজনক উত্থান ও সাফল্যের দৃষ্টান্ত উদারনৈতিক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি বড় শিক্ষা ও সতর্কবার্তা। যদি সুশাসন প্রদানে দলের নেতৃত্বের সদিচ্ছা বা যোগ্যতা না থাকে, অথবা যদি দলের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণহীনতা, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলতা সুশাসন প্রদানের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কিংবা সুশাসন প্রদানে তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকে, তাহলে সততা ও সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধের মতো (রাষ্ট্র ও সমাজে ধর্মের ন্যূনতম অবস্থান ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি) বড় বড় কথা বলে ভোটারদের বিগড়ে যাওয়া ঠেকানো যাবে না এবং অতীতের কলঙ্কিত অধ্যায় সংশোধনের (যুদ্ধাপরাধের বিচার) নৈতিক জোরও তখন থাকবে না। কোনো দলের ওপর জনগণের আস্থা একবার নষ্ট হয়ে গেলে, বড় চেতনার কথা বললে (ধর্মনিরপেক্ষতা, নৈতিকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা—যার প্রতিটিই উৎকৃষ্ট ও ন্যায়সংগত) কেবল সেই মহৎ চেতনাগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জাতীয় মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়।
সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া: শিক্ষক, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ঢাকা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।