আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তুরস্কে নির্বাচন: চতুর্মুখী চাপে ক্ষমতাসীন দল

সুমাইয়া সরোয়ার আগামী ১২ জুন তুরস্কে সংসদ নির্বাচন। আর মাত্র কয়েকদিন বাকী। নির্বাচনের মাঠ গরম। চলছে প্রার্থীদের জোর প্রচার-প্রচারণা। চলছে জল্পনা-কল্পনা।

পত্রিকার পাতায়, টিভির পর্দায়, ওয়েব পোর্টালগুলোতে প্রতিদিনই থাকছে নির্বাচনের খবর। থাকছে বিতর্ক অনুষ্ঠান। চা-কফির দোকানগুলোতেও জমে উঠছে নির্বাচনী আলোচনা। দেশি বিদেশী প্রচার মাধ্যমগুলো বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করছে কয়েকদিন ধরেই। প্রতিদিনই নতুন নতুন পরিসংখ্যান আসছে।

প্রায় সব পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে যে ক্ষমতাসীন আক পার্টি (AK Parti) আবারো ক্ষমতায় আসবে। তবে প্রধান বিরোধী দল প্রজাতন্ত্রী আওয়ামী পার্টি CHP (জেহেপে) ও যে এ নির্বাচনে ভোট বেশী পাবে তাতে সন্দেই নেই। সব দলই নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প, নতুন নতুন ওয়াদা দিচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশী উন্নয়ন প্রকল্প দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। তুরস্কের নির্বাচন কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের।

এখানে সংসদ সদস্য প্রার্থীর চেয়ে দলনেতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জনগণ কোন প্রার্থীকে ভোট দেয় না। সরাসরি পার্টি ও পার্টি প্রধানকে ভোট দেয়। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হিসেবে সংসদ সদস্য বণ্টন হয়। কোন দল যদি সারা দেশে প্রাপ্ত মোট ভোট শতকরা ১০ ভাগের কম পায় তাহলে সে দল কোন সংসদে যেতে পারে না।

অর্থাৎ সংসদে যেতে হলে অবশ্যই শতকরা ১০ ভাগের বেশী ভোট পেতে হবে। ক্ষমতাসীন ন্যায় ও উন্নতি দলের (Justice & Development Party) প্রধান রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এ বছর তার শেষ নির্বাচন করছেন। সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী তিনি এর পরের বার আর নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। আনকারা সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবার যদি তিনি জয় লাভ করেন তাহলে পর পর তিন বার সরকার প্রধান হওয়ার রেকর্ডটি তারই হয়ে থাকবে। তার সম্পর্কে বলা হয়: আসলেন, দেখলেন, জয় করলেন।

২০০২ সালে ক্ষমতায় আসার আগে তিনি ইস্তানবুলের মেয়র ছিলেন। ইস্তানবুলে তিনি এত ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসছিলেন যে সারা দেশে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ২০০২ নির্বাচনের সময় একটি কবিতা পড়ার কারণে জেলে গেলেন। দল তখন বিপুল ভোটে বিজয়ী। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল তখন প্রধানমন্ত্রী হলেন।

ছয় মাস পড়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন। আব্দুলাহ গুল হলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। সেই যে আসলেন আর যাওয়ার নাম নাই। গেল সাড়ে আট বছরে তুরস্কে চারটা নির্বাচন এবং দুইটি গণভোট হয়েছে এবং সবগুলোতে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। একটিতে শুধু ধারণার চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন।

২০০৯ সালের স্থানীয় নির্বাচনে। শতকরা ৪৭ আসা করছিলেন, পেয়েছেন ৪৩। সেবার অবশ্য অর্থনৈতিক মন্দা একটি প্রধান কারণ হতে পারে। আর দ্বিতীয় গণভোটের সময় তো ধারনার চেয়েও বেশী ভোট পেয়েছিলেন তিনি। এবারে অবশ্য আরো উচ্চাভিলাসী তিনি।

তার দল শতকরা ৫০ ভাগ ভোট পাবে বলে আশা করছে। অর্থাৎ প্রতি দুই জন ভোটারের একজন তাদের ভোট দিবে। খুবই উচ্চাভিলাসী একটা সংখ্যা এটা। তার সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সেনাবাহিনী এবং সংবাদ মাধ্যম। এ দুটোকেই তিনি বশে এনেছেন।

এমনকি সেনাবাহিনীর জাঁদরেল জেনারেলগণ এখন জেলে। সাংবিধানিক আদালত, তাদের পুরাতন পার্টিকে কয়েকবার নিষিদ্ধ করেছিল, এখন নিশ্চুপ। সংবাদ মাধ্যমে এখন সমানে সমান অবস্থা। এরদোয়ানের ছবিসহ পোস্টার বহন করছে এক মহিলা দেশের অবকাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রচুর কাজ করছে তার সরকার। স্থল, রেল, নৌ এবং বিমান পথে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসছে।

দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ১৭ তম অর্থনৈতিক দেশ এখন তুরস্ক। মাথা পিছু আয় ২৫০০ ডলার থেকে এখন ১০০০০ ডলারে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুরস্ককে একটা সম্মান জনক অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তাইতো প্রবাসী তুর্কীরাও বিমান ও বাস ভাড়া করে আসছে ভোট দিতে। তার সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন।

এবারের নির্বাচনে অনেক বড় বড় উন্নয়ন পরিকল্পনা দেখাচ্ছেন। নির্বাচনী ইশতেহার দেখে অনেকেই বলছেন যে বিলাসী ইশতেহার। তুরস্কের এগুলো করার ক্ষমতা নেই। যেমন ইস্তানবুলকে কেটে দুই ভাগ করা। পনামা খাল সুয়েজ খালের মত ইস্তানবুল খাল করা।

এটা করলে বর্তমান ইস্তানবুল হবে একটা দ্বীপ। বন্দর নগরী ইযমিরকে নিয়েও এ রকম বিশাল প্রজেক্ট দেখাচ্ছেন তিনি। সবচেয়ে বড় যে প্রজেক্ট তা হল বছরের পর বছর চলতে থাকা কুর্দি সমস্যার সমাধান করা। নির্বাচনের পর নতুন সংবিধান করার কথা জোর দিয়ে বলছেন তিনি। মনে করা হচ্ছে এ সংবিধানে তুরস্কের নাগরিকদের নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা হবে।

কুর্দিদের ভাষার স্বীকৃতি দেয়া সহ আরও অনেকগুলো মূল বিষয় সংশোধন করা হবে। এক কথায় বলতে গেলে তুরস্কের পরবর্তী সংবিধান হবে সম্পূর্ণ নতুন একটি সংবিধান। আজ থেকে আট বছর আগেও যদি এগুলো বলা হত। তাহলে হয়ত কেউই বিশ্বাস করত না। কিন্তু এখন সবাই বলছে, এরদোয়ান যদি বলে তাহলে সে করবে।

আক পার্টির নির্বাচনী স্লোগান হচ্ছে, ‌’লক্ষ্য ২০২৩, তুরস্ক হাজির‌’ ‘স্থিতিশীলতা চলবে, তুরস্ক বাড়বে হোক’ ‘সবকিছু তুরস্কের জন্য’। প্রায় সব পরিসংখ্যানেই আক পার্টির আবার ক্ষমতায় আসার কথা বললেও ক্ষমতাসীন দল তাতে সন্তুষ্ট নয়। তাদের দরকার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। নতুন সংবিধানের জন্য দুই তৃতীয়াংশ আসন। CHP সমাবেশ ৫৫০ আসন বিশিষ্ট সংসদের ৩৬৭ আসন দরকার।

সে জন্য তারা সবচেয়ে বেশী প্রচার চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে তিনটি দল তার প্রতি পক্ষ হচ্ছে। এক. প্রধান বিরোধী দল, প্রজাতন্ত্রী জনতা দল CHP (জেহেপে)। আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত দল। দলটি সেক্যুলারিজমের রক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিল।

কিন্তু নতুন দলনেতা কামাল ক্লিচদারোউলু তার দলকে সকলের দল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ‘সবার জন্য নতুন CHP জেহেপে’ স্লোগান নিয়ে মাঠে নামছেন তিনি। তিনি ‘সরকারের সব কাজেরই বিরোধিতা কর’ নীতি থেকে সরে এসে গঠনমূলক সমালোচনা নীতি অনুসরণ করছেন। চেহারা কিছুটা মহাত্মা গান্ধির মত হওয়ায় তাকে ‘গান্ধি কেমাল’ বলে সম্বোধন করা হয়। সব সময় কুর্দি সমস্যার বিরোধিতা কারী দলটি এবার কুর্দি সমস্যা সমাধানের ঘোষণা দিয়েছে।

সমর্থনও যে পাচ্ছে না তা নয়। ভালই সারা পাচ্ছেন তিনি এই নতুন কৌশলে। ভোটের হার বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন ক্ষমতায় গেলে পরিবার ইনস্যুরেন্স এর মাধ্যমে তিনি সব দরিদ্র পরিবারকে সর্বনিম্ন ৪৫০ ডলার করে দিবেন। CHP প্রধান কেমাল ক্লিচদারোউলু দুই. দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পার্টি MHP।

এরা সবসময়ই তুর্কী জাতীয়তাবাদের ঘোর সমর্থক। মেহেপের নির্বাচনী প্রচারের প্রধান বিষয়ই হচ্ছে পেকাকা কুর্দি গেরিলা। অর্থাৎ কুর্দি সমস্যা। দলটি কুর্দি সমস্যার সমাধান চায় না। এরা যদি সংসদে যায় তবে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কুর্দি সমস্যার সমাধান অনেকটা কঠিন হয়ে পড়বে।

এ জন্য আক পার্টি (AK Parti) এই দলটিকে সংসদের বাইরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। অর্থাৎ দলটির মোট ভোট যেন শতকরা দশের নিচে হয়। গেল কিছু দিন আগে দলের ভিতর থেকে একটা গ্রুপ স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের যৌন কেলেঙ্কারির ভিডিও চিত্র ইন্টারনেটে ছেড়ে দিলে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে কমিটির দশ জন সদস্য দল থেকে পদত্যাগ করে এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। যার কারণে এ দলটির ভোট অনেক কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে দশের নিচে নাও নামতে পারে। তিন. কুর্দি গেরিলা পেকাকা (PKK) সমর্থনপুষ্ট দল শান্তি ও গণতন্ত্রী পাটি BDP (বেদেপে)। গেল কয়েক বছরে পূর্বাঞ্চলে দলটির সমর্থন বেড়েছে। এ দলটি কুর্দি জাতীয়তাবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি দল। তাই কুর্দি সমস্যার সমাধান দলটির পক্ষে নয় বরং বিপক্ষেই যাবে।

ফলে দলটি সরকারের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগছে। এমনকি পুরো ভিন্ন মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত দুটি দল (BDP) এবং (MHP) পুর্বাঞ্চলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে যাওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। যদিও সরকার কুর্দি ভাষায় টিভি চালু করছেন। কুর্দি ভাষা কোর্স চালু করছেন। ওই এলাকায় অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় করছেন।

কিন্তু তারপরও তা যথেষ্ট নয়। তাদের সাংবিধানিক ভাবে তেমন কোন অধিকার নেই। তাই পূর্বাঞ্চল থেকে ক্ষমতাসীন দলের ভোট কমতে পারে। তাছাড়াও অন্য দলগুলো এরদোয়ান ঠেকাও আন্দোলনে নামছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই ধারণা করা হয় যে, পূর্বাঞ্চলে অন্য দলগুলো বেদেপে কে অ-প্রকাশ্যভাবে হলেও সমর্থন দিতে পারে।

এগুলোর সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে বিদেশী সংবাদ মাধ্যম। আমেরিকা এবং ইউরোপের একাধিক সংবাদপত্র সরাসরি ক্ষমতাসীন আক পার্টির বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। দি ইকোনমিস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, ডয়চে ভেলে এবং খুবই নগ্নভাবে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। এ রকম দেশী-বিদেশী, চতুর্মূখী চাপের মধ্যে এরদোয়ান কতটুকু সফল হতে পারেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। আর সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১২ জুন রাত্র পর্যন্ত।

পরবর্তী লেখায় দলগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত লেখার আশায়..... প্রধান পার্টিগুলোর মূল নাম AK Parti: Adalet ve Kalkınma Partisi / Justice and Development Party CHP: Cumhuriyet Halk Partisi / Republican People's Party MHP: Milliyetçi Hareket Partisi / Nationalist Movement Party BDP: Barış ve Demokrasi Partisi / Peace and Democracy Party  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.