আরে ভাই বল্লামিতো আমি একজন স্বঘোষিত মফিজ
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দায়ের করা আপত্তির মুখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের ওই পদে থাকা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দিয়েছে। চেয়ারম্যান ১৯৯৪ সালে গণআদালতের গণতদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েট সদস্য ছিলেন—এই অভিযোগ এনে তার প্রত্যাহার চেয়ে ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদী একটি আবেদন করেছেন। আগামী ১৩ নভেম্বর এটির শুনানির দিন নির্ধারিত আছে।
দেশি-বিদেশি আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যদি কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে বিচারাধীন বিষয়ে পূর্বসংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে কোনোভাবেই তার ওই বিচারকের চেয়ারে থাকা ঠিক হবে না। একজন বিতর্কিত ব্যক্তি কোনোদিন বিচারপতির আসনে বসতে পারেন না।
এটা হবে বিচারক নীতিমালা পরিপন্থী। বিচারপতি নাসিম একজন ডিফেন্স সাক্ষী বা রাজসাক্ষী। তার এই পক্ষপাতিত্বে প্রমাণিত হয়েছে, প্রসিকিউশনের দাখিল করা দলিল-প্রমাণ থেকেই। তাই এই ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা বলে কিছুই নেই। তাদের মতে, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের পরেও যদি ওই ট্রাইব্যুনালে থাকেন তাহলে তা হবে অনৈতিক।
তাদের মতে, তিনি সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ লঙ্ঘন করেছেন। বিচারপতিদের কোড অব কন্ডাক্টের ধারা (ক্লজ) ১, ২, ৩ (৬) (এ), ৩ (৬) (ডি) (৪)-এর লঙ্ঘন। এছাড়া সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১০ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। তার স্বেচ্ছায় চলে যাওয়াই উত্তম; না হলে দেশে ন্যায়বিচার নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হবে।
স্টিভেন কে কিউসি : বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী স্টিভেন কে কিউসি বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গঠিত এক তদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন।
তিনি এই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তও করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন, এই ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা বলে কিছুই নেই। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের বাংলাদেশের সংবিধান, সাক্ষ্য আইনে প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ দেশের সব নাগরিক এই অধিকার পেয়ে থাকে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে কিউসি আরও বলেন, বলা যায় বিচারপতি নাসিম একজন ডিফেন্স সাক্ষী বা রাজসাক্ষী।
তার এই পক্ষপাতিত্বে প্রমাণ হয়েছে প্রসিকিউশনের দাখিল করা দলিল প্রমাণ থেকেই। তাই এই ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা বলে কিছুই নেই। তিনি বলেন, বিচারের নামে যদি এই ন্যায়বিচার পরিপন্থী ও পাতানো বিচার করা হয়, তাহলে এটি ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকবে। আর একটি বিষয় হলো, এটা শুধু যুদ্ধের একটি পক্ষের বিচার করা হচ্ছে, যারা যুদ্ধের আরেকটি পক্ষ তাদের অপরাধের কোনো বিচার করা হচ্ছে না। এটি ন্যায়বিচার পরিপন্থী একটি বিচারব্যবস্থা।
গত ২৯ অক্টোবর আলজাজিরা টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে স্টিভেন কে কিউসি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, এই ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করতে চাচ্ছে, যদিও এটি একটি জাতীয় ট্রাইব্যুনাল। বাংলাদেশ সরকার অভিযুক্তদের সব ধরনের সাংবিধানিক ও জাতীয় আইনের অধিকার এবং সাক্ষ্য আইন থেকে বঞ্চিত করেছে। সাংবিধানিকভাবে সব বাংলাদেশী নাগরিক সুষ্ঠু বিচারের অধিকার রাখে। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং যারাই এ বিষয়ে পড়াশোনা করেন, তারা সবাই বলছেন এটি একটি ন্যায়বিচার পরিপন্থী ট্রাইব্যুনাল।
লর্ড অ্যাভেবুরি : আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ, চিটাগাং হিলট্র্যাক্টস কমিশনের কো-চেয়ারম্যান লর্ড অ্যাভেবুরি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে বৈঠককালে বলেছিলেন, যারা এখন ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে জড়িত, তারাই ১৯৯৪ সালে গণআদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে এখন যাদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে, তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন। লর্ড অ্যাভেবুরি আরও অভিযোগ করেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন সদস্য গণতদন্ত কমিশনের (গণআদালত) সদস্য ছিলেন। ওই কমিশন যাদের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল তাদের বেশ কয়েকজন এখন বন্দী। ওই সময় এদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে তাদের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়।
তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল দেশীয় হবে, নাকি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী হবে তা ঠিক করতে হবে। দেশীয় হলে দেশীয় আইন আর আন্তর্জাতিক হলে আন্তর্জাতিক আইন পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে। বর্তমানে কোনোটিই নেই। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে ২০টি সমস্যা চিহ্নিত করে বলেন, বিচার হতে হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী। এর জন্য বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ, আন্তর্জাতিক মনিটরিংকে অনুমোদন দেয়া এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আইনগত সংশোধন করতে হবে; যার মাধ্যমে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা হবে।
গত ২৮ জুলাই লন্ডনের ফ্লিডেন রোডে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। আইনমন্ত্রী গত ২৩ জুলাই যুক্তরাজ্য সফরে যান ।
খন্দকার মাহবুবুব হোসেন : সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, বিচারপতি নাসিমের প্রতি মাওলানা সাঈদী যে অভিযোগ করেছেন তা বিচার বিভাগের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। চেয়ারম্যান নাসিম ১৯৯৪ সালে তথাকথিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির (ঘাদানিক) আহ্বানে গণআদালতের গণতদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন, তা অস্বীকার করার নয়। গণআদালতের ভূমিকা কী ছিল, তা দেশবাসী জানেন।
নিজামুল হক নাসিমকে গণআদালতের ১৬ বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এ নিয়োগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশে করা হয়েছে। তাই কোনো অবস্থাতেই তিনি ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এটি সম্পূর্ণ অনৈতিক। বিচারকদের আচরণ পরিপন্থী।
খন্দকার মাহবুব হোসেন মনবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রসঙ্গে বলেন, মানবাধিকার সংগঠন, ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল বিচারকে গ্রহণযোগ্য করতে পরামর্শ দিয়েছে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র্যাপের মতামতের ভিত্তিতে বর্তমান সরকার যেন মানবতাবিরোধী অপরাধ কার্যক্রম নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানের হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন। নয়তো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কোনো বিচার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে দেশে সংঘাতময় অবস্থা দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে চেয়ারম্যানের ওই পদে বহাল রাখার যোগ্যতা ও নৈতিকতা নিয়ে মাওলানা সাঈদীর আবেদন করা আছে।
তা আগামী ১৩ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য আছে। আশা করব, একজন বিচারক হিসেবে ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য স্বেচ্ছায় ওই পদ থেকে তিনি সরে দাঁড়াবেন। খন্দকার মাহবুব আরও বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের ওপর যে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করেছে নিঃসন্দেহে তা যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৯৫ হাজার সদস্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যাচাই-বাছাই করে সুস্পষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
তাদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার চিহ্নিত ওই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল ত্রিদেশীয় চুক্তির আওতায় পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। বিচার না করে ফেরত পাঠানোর এ সিদ্ধান্ত দেশবাসী সুন্দরভাবে দেখেনি। এরপর দালাল আইন করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার দায়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের তত্কালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে দালাল আইনে অভিযুক্ত চারটি অপরাধ ছাড়া (হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগ) বাকিদের ক্ষমা করে দেন।
১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে হত্যা, ধর্ষণের সঙ্গে অভিযুক্ত আসামি না থাকায় অন্যান্য অপরাধ দণ্ডবিধির ধারা অনুসারে বিচারযোগ্য হওয়ায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে দেন। দীর্ঘ চার দশক পর বর্তমান সরকার আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রতিহিংসার মাধ্যমে ঘায়েল করার পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক : সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বিশিষ্ট আইনবিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে আস্থা না থাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের কথিত অভিযোগে আটক মাওলানা সাঈদী।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নাসিম ১৯৯৪ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির (ঘাদানিক) একজন সদস্য হিসেবে গণতদন্ত কমিশনের সদস্যসচিব ছিলেন। ওই কমিশন একটি প্রতিবেদনও গণআদালতের কাছে পেশ করে। প্রতিবেদনে বিচারপতি নাসিমের নাম রয়েছে। ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, গণতদন্ত কমিশনের সদস্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হতে পারেন না। এতে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হতে পারে।
তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি বিচার্য বিষয়ের সঙ্গে এর আগে কোনো কারণে জড়িত থাকেন তাহলে তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালনে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। তিনি সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ লঙ্ঘন করেছেন। বিচারপতিদের কোড অব কন্ডাক্টের ধারা (ক্লজ) ১, ২, ৩ (৬) (এ), ৩ (৬) (ডি) (৪)-এর লঙ্ঘন বলে জানান। এছাড়া সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১০ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। কাজেই বিচারপতি নাসিম এই ট্রাইব্যুনালের বিচারক হতে পারেন না।
তিনি বলেন, বিচারপতি নাসিম সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগের আগে একজন বিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন। বাংলাদেশের আইন এবং সংবিধান সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি অবহিত। সুতরাং তিনি এমন পদক্ষেপ নেবেন, যা সংবিধান মানবাধিকার এবং আইনের শাসনকে সমুন্নত করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।