হ্যাকিং ॥ ট্রাইব্যুনাল প্রধানের কথোপকথন প্রকাশ যুদ্ধাপরাধী রক্ষার চেষ্টা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বিষয় থাকাকালীন অবস্থায় সেই বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মোঃ নিজামুল হক নাসিম ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কথোপকথন খবর প্রকাশ করাটা গুরুতর অপরাধের শামিল। দ্য ইকোনমিস্ট ট্রাইব্যুনালের চেয়াম্যানের কম্পিউটার হ্যাকিং করে নথিপত্র নেয়াটা নিম্নতম রীতিনীতি নৈতিকতার পারিপন্থী একইভাবে বিচারাধীন বিষয়ে আমার দেশ সংবাদ প্রকাশ করাটাও নৈতিকতার পরিপন্থী। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যেমন যুদ্ধাপরাধীরেদ বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে ঠিক একইভাবে সেই সংবাদ প্রকাশ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজকে বাধাগস্ত করা হচ্ছে। এখন কলোনি রাষ্ট্র নয়। গণতান্ত্রিক সমাজে একজন বিচারপতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সাথে যোগাযোগ থাকা উচিত।
অবশ্যই বিচার কাজে অন্যের পরামর্শ নিতে পারেন। তাতে কি আসে যায়। বিচার্য বিষয় এই যে, শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে দিচ্ছেন কিনা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর, সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী থেকে আইন কমিশনের অভিমতে এমনটিই বেরিয়ে এসেছে।
৫ ডিসেম্বর রাত ১০টায় দ্য ইকোনমিস্ট থেকে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হককে জানানো হয়, ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে তিনি যেসব কথাবার্তা বলেছেন এবং ই-মেইলের মাধ্যমে যেসব পরামর্শ নিয়েছেন তার সব কিছুই তাদের কাছে রয়েছে।
এ বিষয়ে তারা চেয়ারম্যানকে আরও কিছু প্রশ্ন করেন। এ ঘটনার পরদিন ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতের কাজে হস্তক্ষেপ ও বিচারকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করায় লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনোমিস্টের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া ইকনোমিস্টের সম্পাদক ও দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধানকে তিন সপ্তাহের মধ্যে এর ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নিয়মের বাইরে ও তা বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে মত দিয়ে ট্রাইব্যুনাল ইকোনমিস্ট কর্তৃপক্ষকে ওই কথোপকথন প্রকাশ না করার জন্য বলে।
বিষয়টি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় রবিবার দৈনিক আমার দেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিম ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কথোপকথন প্রকাশ করেছে।
এ বিষয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শাহ আলম জনকণ্ঠকে বলেছেন, একটি বিষয় বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কোন প্রতিষ্ঠান তা প্রকাশ করতে পারে না। আমার দেশ ঐ কথোপকথন প্রকাশ করে বে-আইনী কাজ করেছে। দ্য ইকোনমিস্ট যেমন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের সঙ্গে ব্লাক মেইল করেছে, তেমনি আমার দেশ পত্রিকাও সেই কাজটি করেছে। এটা সাংবাদিকতার মন মানসিকতার পরিচয় বহন করে ন।
জানা যায়, কম্পিউটার হ্যাকিং এরপর +৯১৯৮১০০১৬৬২ নম্বর থেকে চেয়ারম্যানের কাছে একটি ফোনকল আসে।
ফোন নম্বরটি লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের। ফোন করে চেয়ারম্যানকে বলা হয়, ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে চেয়ারম্যান যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তা তাদের কাছে আছে। এ বিষয়ে চেয়ারম্যানকে কিছু প্রশ্ন করা হয়। চেয়ারম্যান ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে যেসব ম্যাটেরিয়াল নিয়েছেন তার সব কিছুই তাদের কাছে রয়েছে। এভাবে চেয়ারম্যান এ উদ্বেগজনক বিষয়টি জানতে পারেন।
এরপর দ্য ইকোনমিস্টের সাউথ এশিয়া ব্যুরো চীফ এডাম রবার্টস (টেলিফোন নম্বর +৯১১১৪১০২৭৭৫৯) এবং দি ইকোনমিস্টের চীফ এডিটর রব গিফর্ড, ২৫ সেন্ট জেমস স্ট্রিট, লন্ডন, টেলিফোন নম্বর ০০৪৪২০৭৮৩০৭০৮৭ এবং মোবাইল ০০৪৪৭৯০৩০৫৭১৪৩-এর প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তিন সপ্তাহের নোটিস জারি করে।
বিষয়টি ফয়সালা না হতেই দৈনিক আমার দেশ রবিবার (৯ ডিসেম্বর) তাদের সেই কথোপকথন প্রকাশ করে। এ প্রসেঙ্গ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী জনকণ্ঠকে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই এটা করা হয়েছে। বিচার যাতে না হয় তা নিয়ে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বিচারাধীন বিষয়ে আমার দেশ যা করেছে তা অবশ্যই অপরাধযোগ্য।
প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, এ ঘটনাটি আমাদেরকে বিস্মিত করেছে। একটি বিষয় বিচারাধীন থাকা অবস্থায় দেশের আরেকটি পত্রিকায় তা প্রকাশ করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় পড়ে। জেনেশুনে প্রকাশ করাটা সবাইকে হতবাক করেছে। অবশ্যই একজন আরেকজনের সাথে আলাপ করতে পারে। তাই বলে সেই গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে প্রকাশ করা করতে হবে? অবশ্যই আমাদেরকে দেখতে হবে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে ট্রাইব্যুনালের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়।
সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, বিচারাধীন বিষয়ে অবশ্যই সাধারণভাবে সেই সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করা যায় না। যা দৈনিক আমার দেশ করেছে। কিন্ত কোন কোন ঘটনার ব্যতিক্রমও থাকতে পারে। তিনি বলেন, যে সব কথা ছাপা হয়েছে তাতে করে অনেক অপ্রত্যাশিত ব্যাপারে চলে আসছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুনতাসীর মামুন এ বিষয়ে বলেন, দৈনিক আমার দেশ যা করেছে এটাকে আমি তুচ্ছ মনে করছি।
আমি কোনভাবেই আইনী বিতর্কে যাব না। এখন বাংলাদেশ কলোনি রাষ্ট্র নয়। কলোনি রাষ্ট্র ছিল যখন বিচারপতিরা গৃহবন্দী থাকতে হবে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় তা কাম্য নয়। একজন বিচারপতি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা উচিত। তারা অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা বলতে পারেন।
তাতে কি আসে যায়। অবশ্যই পরামর্শ নিতে পারে। বিচার বিষয় এই যে, সব শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে রায় দিচ্ছেন কিনা। যে সব আইনানুগ ও ন্যায়সঙ্গত হয়েছে কিনা। বিচারপতিদের নিয়োগ রাজনৈতিকভাবেই হয়ে থাকে।
ড. মুনতাসীর মামুন আরও বলেন, সব সরকারের সময়ই রাজনৈতিকভাবেই বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি কি বিচার দিচ্ছেন সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সুতরাং কার সঙ্গে কি আলাপ করেছেন এতে কিছুই আসে না। বিএনপি জামায়াত প্রচুর টাকা ব্যয় করেছে। এখন পত্রিকারগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
দ্য ইকোনমিস্ট ৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিউজ করে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন স্কাইপের মাধমে কথোপথন টেপ করা যায় না। এই কথোপকথন অবশ্যই কেউ টেপ করে বিক্রি করেছে। সে বিষয়টিও ক্ষতিয়ে দেখতে হবে। রায় কারও পক্ষে যাবে কি যাবে না সেটা বিষয় নয়।
ইতিহাসের রায় আমাদের পক্ষে। গোলাম আযমদের বিপক্ষে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের মধ্যে অনেক আওয়ামীপন্থী আইনজীবী রয়েছেন। তারা নিজেরা অন্তঃকোন্দলে না জড়িয়ে একটি রিট করতে তো পারে। তিনি বলেন, আমি মনে করি এ বিষয়ে আইনজীবীদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
এখন কথা বলার সময় নয়। কাজ করার সময়। সুপ্রীমকোর্ট বার সমিতির সাবেক সম্পাদক শ. ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেছেন, যে কোন বিচারপতির এখতিয়ার রয়েছে বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য আদালতের বন্ধুদের (এমিকাস কিউরি) পরামর্শ গ্রহণ করা। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতামত বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহের উপযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে থেকে সহায়তা নেয়। ফলে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি কোন বিষয়ে উপযুক্ত কারও সঙ্গে কথা বলা অভিজ্ঞতা গ্রহণ, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও আইনের ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে তাকে কোনভাবেই বিতর্কিত দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ নেই।
কোন বিচারপতি এর আলাপচারিতা, কথোপকথন রেকর্ড করা এবং তা অসৎ উদ্দেশ্যে প্রচার করার মধ্য দিয়ে বিচারক বা বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিতর্কিত করা যে কোন চেষ্টা, বিচার ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করা তথা আদালতের কার্যক্রমে কৌশলগত হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
বিষয়টি আদালত অবমাননার পর্যায়ভুক্ত হতে পারে।
শ. ম রেজাউল করিম আরও বলেন, তা ছাড়া একই বিষয়ে ইকোনমিস্ট রিপোর্টের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল রুল ইস্যু করতে পারে। আলোচ্য বিষয়টি সাব-জুডিস (বিচারাধীন) হিসেবে গণ্য হতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে পুনরায় একই বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ কার্যত : সাবজুডিস বিষয়ে সংবাদ প্রকাশে শামিল না কোনভাবেই আইনানুগ নয়।
বিচারক হিসেবে, বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিম দায়িত্ব পালনের বাইরেও তিনি একজন নাগরিক হিসেবে তা সাংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার রয়েছে। তার কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করার নৈতিকতা ও আইনবহির্ভূত, যা বিশ্বের অনেক বড় ঘটনাকেও নিন্দিত হয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।