আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রুস্কাইয়া ব্লুদা-৩

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! আমি আশ্চর্য হই শুনে বোতলের গায়ে ইংরেজী অক্ষরে ‘ভি ও ডি কে এ’লেখা থাকার পরে কেউ একবারের জন্য একে 'ভডকা' বলেনা- বলে ভোদ্কা কিংবা সঠিক উচ্চারনে ভদ্কা। ইংরেজীর এই ‘ডি’ এর উচ্চারন যে রাশিয়ানরা ‘দ’ করে এটা প্রায় সবাই জানে। ‘ভদ্কা’ নামের সাথেই রাশিয়ার প্রসঙ্গ উঠে আসে। অনেকেরই ধারনা সব নামী দামী ভদ্কাই রাশিয়ার তৈরি। আসলে কিন্তু তা নয় মোটেই।

বরংচ খোদ রাশিয়ার তৈরি ভদ্কা আমরা অনেকে চোখেই দেখিনি কখনো। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের নিজের তৈরি ভদ্কার ব্রান্ড ছিল ‘মস্কোভসকাইয়া’ বা ‘স্তালিৎসনাইয়া! আঃ কি তার স্বাদ গন্ধ আর বোতলের ছিড়ি! সেই ভদ্কাকে আমরা বলতাম কোরোসিন তেল -আর বোতলকে কেরোসিন তেলের বোতল। ‘ভদকা’ ছিল মুলত রাশিয়ার সব’চে সস্তা মদ। ওরা কিন্তু সবাই ভদ্কা খায়না। অনেকেরই কনিয়াক বা ব্রান্ডি বেশ পছন্দ।

মেয়েরা সব ধরনের মদ খেলেও পছন্দ করত শ্যাম্পেন,ওয়াইন কিংবা লিকিওর’। আর বিয়ার ছিল সবারই পছন্দের। সুদৃশ্য ছোট বোতল বা ক্যানের বিয়ার আমি ওদেশে দেখিনি প্রথমে। বেশ বড় আকারের বোতলে উচ্চ মাত্রার এ্যালকোহল ছিল সেই সব বিয়ারে। অনেকেই এক বোতলে কুপোকাত হয়ে যেত।

খুব জাঁদরেল মাতালদের পছন্দ ছিল ‘সামাগোন’। যার এ্যালকোহলের মাত্রা কমবেশী আশি শতাংশ! পুরুষরা তুলনামুলক ভাবে বেশী মদ খেলেও মেয়েরা কিন্তু পিছিয়ে ছিল না মোটেও। তারাও সমানতালে পাল্লা দেবার ক্ষমতা রাখত। রুশীয়রা মদ খাবার আমন্ত্রনটা মুলত করে ‘গলার নীচে টনসিলের কাছে আংগুলের টোকা দিয়ে ‘বুজ্বেস পিচ্ব’(ড্রিংক করবি)। আলকাশ’ শব্দের অর্থ অ্যাডিক্টেড বা মদে আসক্ত! রুশীয়রা সাধারন মাতালদের বলে ‘পিয়ানী’ আর যারা পুরোপুরি মদে আসক্ত হয়ে গেছে তাদেরকে বলে ‘আলকাশ’।

রাশিয়ার শহরগুলোতে ঘুরলে ছোটখাট পার্ক আর সিগন্যাল গুলোতে দেখা মিলবে কিছু ছিন্নদুল হতদরিদ্র এইসব ‘আলকাশ’দের ঠিক আমাদের দেখা যায় হিরোইনসেবিদের। আলুথালু ছিন্নবেশ উস্কখুস্ক চুল আর কিডনি লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত গৃহহীন এইসব নারী পুরুষেরা সারাদিন ঘুরে বেড়ায় একফোটা মদ পানের আশায়। এরা কাউকে বিশেষ জ্বালাতন করে না। সারাদিন রাস্তায় আর পার্কে ঘুরে এরা বিয়ার আর মদের খালি বোতল কুড়িয়ে সামান্য যা কিছু পয়সা পায় তাই দিয়ে সামান্য মদ গলঃ ধকরন করেই এদের শান্তি। দু-য়েকজন অবর্শ ছোটখাট চুরিচামারি আর ভিক্ষাবৃত্তিও করে, তবে তেমন পেশার আলকাশ বিরল।

সাধারন রাশিয়ানরা এদেরকে সাধারনত ঘাটায়না- ওদেরকে ওদের মত থাকতে দেয়। রুশ প্রেসিডেন্ট ইয়েলিৎসিনকে অনেক রাশানরাই সন্মোধন করত আলকাশ আর পাগল হিসেবে। তিনি নাকি মদ্যপান ছাড়া এক মুহুর্ত থাকতে পারতেননা! রুশ গাড়িচালকদের যথাসম্ভব সবচেয়ে বড় অফেন্স এর একটহল মদ খেয়ে গাড়ি চালানো । এই ব্যাপারে এদের আইন এত বেশী কঠিন যে ভাবাই যায়না। সেই কারনেই হয়তো ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় রাশিয়ায় সড়ক দূর্ঘটনার হার সবচেয়ে কম।

প্রতিবার মদের পেগ হাতে তোলার পর উপলক্ষ্য বা উইশ করে সেটা দারুন মজার। যেমন আসুন আমরা পান করি অমুকের সুসাস্থ্য কামনা করে। অমুক বন্ধুর সাথে নতুন বন্ধুর সাথে পরিচয়ের জন্য। আমরা যেন বেঁচে থাকি। আমাদের যেন আবার দেখা হয়।

এইরকম হাজারটা উপলক্ষ্য চলে আসে পান করার সময়। পানের সাথে চলে গল্প আর কৌতুক বলা। কারো বলা কৌতুক শুনে সবাই হাসছে-ঠিক তখুনি হয়তো একজন বলে উঠল,এবার আমরা পান করি এই দারুন কৌতুকটার জন্য! তখুনি সবাই ফের বেশ সিরিয়াস, আসলেইতো এইটেতো দারুন একটা উপলক্ষ্য । এজন্য অবশ্যই পান করা উচিৎ…। কোন এক সময় কোনভাবেই উপলক্ষ্য না পেলে, কেউ হয়ত বলে ‘দাভায়(আসুন) রিবিয়েতা, দ্রুজিয়া(বন্ধুগন) বা বিল্ল্যাত’ কোন উপলক্ষ্য নাই তাই সেইজন্য পান করা যাক! মদের শেষ বিন্দু আর সিগারেটের শেষ টান দুটোই ওদের কাছে বেশ উপভোগ্য।

ফুট নোটঃ মস্কোভস্কাইয়া অসোবাইয়া ভদকা বা ‘মস্কোর স্পেশাল ভদকা’ প্রথমবার ব্রান্ড মার্কেটিং করা হয় ১৮৯৪ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্বের সময় রুশ প্রশাসন মস্কোভস্কাইয়া সহ সব ধরনের কড়া স্পিরিটের পানীয় উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কয়েক বছর বাদেই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে দ্বীতিয়বার এই ব্রান্ড বাজারে আসে-যা চলছে আজ অব্দি। স্তালিৎসনাইয়া ভদকা প্রথমবার বাজারো আসে ১৯৪৬ অথবা ‘৪৮ সালে(মতান্তর আছ)। স্তালিৎসা অর্থ রাজধানী।

এসেই এটা বাজার মাত করে। অল্পদিনেই রাশিয়ান উচু মানের ভদকার মধ্যে স্তালিৎসনাইয়া সবার শীর্ষে উঠে আসে। ১৯৫৩ সালে বার্ণ শহরের এক আর্ন্তজাতিক মেলায় 'স্তালিৎসনাইয়া ' ভদকা প্রথমবার প্রদর্শনীতে এসেই স্বর্ণ পদক জিতে নেয়। ১৯৭২ সালে বিশ্বখ্যাত পানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পেপসিকো তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের সাথে একটা চুক্তি সাক্ষর করে- যে চুক্তির মুল বিষয় ছিল পেপসিকো রাশিয়ান স্তালিৎসনাইয়া ভদকা সারা বিশ্বে বাজারজাত করবে তার বিনিময়ে পেপসিকো কোম্পানীর পানীয় তাদের দেশে বাজারজাত করার অনুমতি দেবে। উল্লেখ্য পেপসিকোলা সোভিয়েত ইউনিয়নের বাজারে প্রথম বিদেশী পানীয়।

ভিন দে আকাসাঃ মলদোভিয়ার ঘরে বানানো (দামাসনি)বিখ্যাত রেড ওয়াইন রুশ ভাষায় ‘ক্রাসনি ভিনো’ আর মলদোভিয়ান ভাষায় ‘ ভিন দে আকাসা’র স্বাদ আর গন্ধ অতুলনীয়! আকাসা অর্থ বাড়ি । মলদোভিয়ার শহরে কিংবা গ্রামের প্রতিটা বাড়িতেই প্রায় সারা বছরই ‘বাঙ্কা’ বা কাচের জার ভর্তি 'ভিনো' প্রিজার্ভ থাকে। কোন বাড়িতে বেড়াতে গেলেই প্রথমে ওয়াইন দিয়ে আপ্যায়ন করবে। গ্রীস্মের সময়টা শহর থেকে বেরুলেই দেখা মিলবে ঠিক আমাদের শস্য ক্ষেতের মত মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু আঙ্গুরের বাগান। প্রায় দুই লক্ষ হেক্টর ভুমিতে ওরা আঙ্গুর উৎপাদন করে যার তিনের এক ভাগ অবানিজ্যিক উৎপাদন যেটা দিয়ে ভিন দে আকাসা বা বাড়ির ভিনো তৈরি হয়।

উৎকৃষ্ট মানের সেই আঙ্গুর থেকেই তৈরি হয় ওদের অতি প্রিয় ক্রাসনি ভিনো’। শহরের 'ভিনো'র স্বাদে কেমন যেন শুহুরে গন্ধ থাকে। সত্যিকারে ভিনো'র স্বাদ পেতে হলে যেতে হবে ভিনো তৈরির গায়ে। পরে সংযোজনঃ রাশিয়ানরা ভদকা কেনার সময়ে ঘুরিয়ে ঝাকিয়ে চোখের খুব কাছে বোতলটা নিয়ে ভাল করে নিরিক্ষন করে ভদকার মান সম্পর্কে নিশ্চত হয়। ওরা কিভাবে নিশ্চিত হয় আমি বুঝিনি কখনো ব্যাপারটা- সেখানে অনেক বাঙ্গালীকেও দেখেছি এরকমটা করতে।

ঢাকা শহরে কিছুদিন ফড়িয়ারা শার্টের নীচে বা ব্যাগে বোতল লুকিয়ে পাড়া মহল্লায় বিক্রি করত। বহু বছর আগে সেইরকম এক বোতলে না খুলে অরিজিনার জিনিস আছে কিনা সেটা পরিক্ষার ভার পড়ল আমার উপর- কেননা আমি রাশিয়া ফেরত সুতরাং ভদকা স্পেশালিষ্ট! আমি দারুন অভিজ্ঞ এমন ভাব নিয়ে ঠিক রুশদের বেশ খানিক্ষন ঝাকিয়ে ঘুরিয়ে বিশেষজ্ঞের মত নিরিক্ষন করে বললাম-'জিনিস এক নম্বর'। রাতের বৈঠকে,কোমল পানীয় আর নানা উপকরন নিয়ে বসে সেই বোতল খুলে বেরুল পানি! নেহায়েৎ বাল্য বন্ধুরা ছিল বলে সেইদিন খুনোখুনি হয়নি। ভদকা খাবার রুশ স্টাইল; ভাল মানের পিয়ানী বোতলের ছিপি খুলেই একবার ঘ্রানটা শুকে নেয়। এতে করেও নাকি মান সম্পর্কে নিশ্চত হওয়া যায়।

আমি এমন কুকর্ম করতে গিয়ে আরেকটা বিপদে পড়েছিলাম! সেই গল্প নাহয় উহ্য রইল! ওরা মদ্য পানের সময় 'জাকাজ'কা বা মদের সহযোগ হিসেবে একটু পাউরুটি(এই সময়ে কালো পাউরুটি র কদর বেশী কেননা এর একটা টক টক ঘ্রান থাকে যেটা মদ গলঃধ্বকরনের পর নাকের কাছে নিয়ে শুকলে মদের গন্ধটা উৎকট লাগে না। ) কিংবা পনির বা সামান্য সসেজেই খুশি! (এই অংশটুকু সংযোজিত হয়েছে ৪ নভেম্বর ২০১১) ...চলবে আগের পর্বের লিঙ্কঃ Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.