মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! ‘রুস্কাইয়া ব্লুদা’র ইংরেজী অভিধানিক অর্থ ‘রাশিয়ান ডিস’। এই নামের সাথেই ভিন্ন ধরনের খাবারদাবারের একটা সরব উপস্থিতি টের পেতে বিলম্ব হয়না। আমার এই সিরিজ যদি নিয়মিত চলতে থাকে তাহলে বেশ কয়েকবার রুশীয়দের ভোজন বিষয়ক ব্যাপারটা উঠে আসা বিচিত্র নয়। কিন্তু আজকের বিষয়টা ভিন্ন। আজকের বিষয়বস্তু মুলত বিশ্বের অন্যতম চেইন ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্ট ম্যাকডোনাল্ড নিয়ে।
নামটা শুনেই অনেকের জিভে জল আসবে আবার কেউবা নাক সিটকাবে।
পাঠক আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন,’রুস্কাইয়া ব্লুদা’ যার শ্লোগান ‘রাশিয়ার কিছু জানা অজানা কথা’-এর মধ্যে ম্যাকডোনাল্ড আসে কেমনে? আমি উত্তরে বলব,আসতে পারে। নিশ্চিত ভাবে আসতে পারে। কেন আসতে পারে? এর উত্তর মোটামুটি ভাবে পেয়ে যাবেন –কষ্ট করে একটু লেখাটা পড়ুন;
১৯৭৬ সাল জর্জ কোহন নামের আমেরিকায় জন্মগ্রহনকারী এক কানাডিয়ান ভদ্রলোক মন্ট্রিয়াল অলিম্পিকে আসা রাশিয়ান উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলকে একটা অনুরোধ করে বললেন,তোমরা কি চাও আমেরিকা রাশিয়ার তিক্ততার সম্পর্কের পরিসমাপ্তি হোক?
আমরা কেউ যুদ্ধ চাইনা। আমরা ভালোমানুষেরা সবাই চাই শান্তি।
রুশ আমেরিকার এই ঠান্ডা লড়াই আমাদের সবাইকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। আমরা সবাই চাই এই অবস্থার থেকে উত্তোরন। ‘ পুজিবাদী সমাজের প্রতিনিধি জর্জ কোলন যিনি মুলত ম্যাকডোনাল্ড কানাডার তৎকালীন ফাউন্ডার চেয়ারম্যান। তিনি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলকে বোঝাতে সমর্থ হলেন-এই সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হতে পারে মস্কোতে একটা ম্যাকডোনাল্ড রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমতি। যার মাধ্যমে তারা গুহায় বাস করা সোভিয়েতবাসীদের বোঝাতে পারেন গনতন্ত্রের খোলসে ক্যাপিটালিজম মোটেই খারাপ জিনিস নয়।
দেখ আমরা কম পয়সায় কত তাড়াতাড়ি কি দারুন পরিচ্ছন্ন স্বুসাদু গরম খাবার পেতে পারি। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এই বৈষম্যতা নিঃসন্দেহে চরম দুঃখজনক।
কিন্তু পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে চরম সন্দেহপ্রবন সোভিয়েত সরকার দীর্ঘ চৌদ্দ বছর রুশীয় জনগনদের সেই ম্যাকডোনাল্ডের খাবারের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করল। অনেক দেন দরবার করার পরে রাশিয়াতে প্রথম ও একটা মাত্র ম্যাকডোনাল্ডের রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমতি দেয়া হয় ১৯৯০ সালে।
মস্কোর পুশকিন স্কয়ারে খোলা হয় ম্যাকডেনাল্ডের প্রথম খাবারের দোকান জানুয়ারি উনিশশ নব্বুই সালে।
পাঠক হয়তো জানেন পরবর্তী সূদীর্ঘ একুশ বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যগডোনাল্ড রেস্টুরেন্ট ছিল এইটে। এখানে একটা তথ্য সংযুক্ত করে দিচ্ছি, এবছর লন্ডন অলিম্পিক ভেন্যুতে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম ম্যাকডোনাল্ড রেস্টুরেন্ট খোলা হয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে পুশকিন স্কয়ারের ছায়া রেস্টুরেন্ট। যেটা একটা ফুটবল মাঠের অর্ধেকের সমান জায়গা নিয়ে করা হয়েছে। যেখানে আছে একসাথে পনেরশ খদ্দেরের বসবার জায়গা।
সার্বক্ষনিক ৪৭০ জন স্টাফ সেবার জন্য প্রস্তুত আর প্রতিদিন গড়ে পঞ্চাশ হাজার বিগম্যাক, এক লক্ষ প্যাকেট আলু ভাজা, ত্রিশ হাজার মিল্ক শেক তৈরি করতে সক্ষম।
জানুয়ারির প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে যেন পুরো মস্কোবাসী ঝাপিয়ে পড়ল সদ্য উদ্ভোধন হওয়া সেই ম্যাকডোনাল্ডে!প্রথম দিন সেই ম্যাকডোনাল্ড কম বেশী ত্রিশ হাজার লোককে আপ্যায়িত করতে পেরেছিল। ভীড় সামলাতে সেইদিন ম্যাকডোনাল্ড কতৃপক্ষ মিলিশিয়া(পুলিশ)ডাকতে বাধ্য হয়েছিল। আর মিলিশিয়া বাধ্য হয়েছিল লাঠিচার্জ করতে।
রাশিয়ানরা লাইনে দাড়িয়ে অভ্যাস্ত।
এক বাঙ্কা(বয়াম)দুধের জন্য তারা সারাদিন মুখ বুজে লাইনে স্ট্যাচুর মত লাইনে দাড়িয়ে থাকতে পারে। আমি প্রথমে ভীষন অবাক হতাম। এত সুশৃঙ্খলভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষ কিভাবে লাইনে দাড়িয়ে থাকতে পারে? সন্তানসম্ভাবা রমণী বাদে আর কাউকেই বিশেষ সুযোগ দেয়া হতনা। হোক সে নব্বুই বছরের বৃদ্ধা-লাইন ভেঙ্গে এগিয়ে যাবার উপায় নেই! সমাজতান্ত্রিক দেশে সবারই প্রয়োজন সমান-কম বেশী এটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার! নিজের প্রয়োজনটা নিজের ভিতরে চেপে রেখে অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
কিন্তু সেদিন কেন আপাত শান্ত রুশীয়দের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল? এর উত্তর আমার জানা নেই।
সেদিন পশ্চিমা সাংবাদিকরা বলেছিল,রুশীয়রা সমাজতন্ত্রের কঠিন বন্ধন থেকে মুক্তি চাইছিল। তারা ক্যাপিটালিজম কিংবা ভোগতন্ত্র কিংবা পুজিবাদের উন্মুক্ত আকাশে প্রানখুলে নিঃশাষ নেবার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। তারা ভাবছিল ম্যাকডোনাল্ডই সেই স্বর্গের দ্বার। ম্যাগডোনাল্ডের বিগ ম্যাকে আছে সেই স্বর্গীয় স্বাদ-যা থেকে তারা সত্তুর বছরেরও অধিককাল বঞ্চিত। এর প্রায় দুবছর বাদে যখন সমাজতন্ত্রের পতন হল বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে কয়েকটুকরো হয়ে গেল, তখন পশ্চিমের বহু পত্রিকার নিবন্ধের কলাম ছিল;একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের বিপর্যয়মূলক অর্থনৈতিক সমস্যা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে ভীত রুশীয় গনতন্ত্রের স্বাদ প্রথম উপভোগ করেছিল হৃদয় বা মগজ দিয়ে নয় তারা উপভোগ করেছিল তাদের পরিপাক তন্ত্র দিয়ে।
তারা উপলব্ধি করেছিল সামান্য একটা বিগ ম্যাকের স্বাদ যদি এত উপভোগ্য হয় তাহলে সম্পূর্ন পুজিবাদের স্বাদ কি-ই উপভোগ্য হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ম্যাকডোনাল্ডের আগমন যদিও একটা ছোট্ট ঘটনা ছিল মাত্র কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম দেশের মানচিত্র চিরস্থায়ী ভাবে পরিবর্তনের জন্য তা ছিল প্রারম্ভিক সুচনা।
আমাদের হোস্টেলের অতি বিস্বাদ খাবার খেতে খেতে স্বুস্বাদু ব্যাপারটাই যখন প্রয়া ভুলে যেতে বসতাম- তখন মস্কো গিয়ে সেই পুশকিন স্কয়ারের ম্যাকডোনাল্ডের খাবার খেয়ে স্বাদ গ্রন্থিগুলোকে উজ্জীবিত করে নিতাম। আগের পর্বে বলেছি, মস্কোতে প্রথমদিন আমাদের গাইড মশাই বিদেশী বলে অন্য কোন খাবার দেয়ার ঝুকি নেয়নি-সারা বিশ্বের আম-জনতার খাবার দিয়েছে। সেই দিনই প্রথম খেলেও প্রথমদিনই আমি ম্যাগডোনাল্ডের বার্গারের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু শুরু থেকে দুই আড়াই বছর পার হয়ে গেলেও ম্যাগডোনাল্ডের খাবারের আবেদন তখনো তেম কমেনি। তখন অব্দি মাত্র একখানাই রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমোদন পেয়েছিল তারা। তাই সারা দেশের লোক একটু অন্যরকম স্বাদের জন্য এখানে এসে ভীড় জমাত। সব সময়ই দেখা যেত রেস্টুরেন্টের পরিধি ছাড়িয়ে একেবেকে অপেক্ষারত খদ্দরের লাইন গেছে বহুদুর। প্রতি দশ পনের মিনিট পর পর তারা সদর দরজা খুলে মাথা গুনে জনা বিশেক খদ্দের ঢুকিয়ে আবার গেট আটকে দিত।
ফের দশ পনেরমিনিট বাদে আবার বিশজন-এই ভাবে চলত সারাদিন। তবে অন্য সময় ভিড়ভাট্টা একটু কম হলেও ছুটির দিনগুলোতে খাবার পেতে কয়েক ঘন্টাও লেগে যেত। এমন অভিজ্ঞতা আমার বহুবার হয়েছে-দাড়িয়ে থাকতে থাকতে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে তার পাশের লেবানিজ রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে খেয়েছি।
রুশীয়রা নিশ্চিতভাবে সভ্য জাতি। অপেক্ষমান খদ্দেরের ভীড় দেখে তারা অযথা চেবিল চেয়ার আকড়ে বসে থাকতনা।
খাবার শেষেই অতিদ্রুত নিস্ক্রান্ত হত-আমি এই ভেবে মনে মনে হাসি। পুজিবাদের স্বাদ গরম গরম অতিদ্রুত উপভোগ করেই তারা ছুটে যায় সমাজতন্ত্রের বদ্ধ মোলায়েম সুশীতল ছায়াতে। একটু বসে থেকে যে জাবর কাটবে তারও উপায় নেই, আরেকজন যে ঘাড়ের কাছে ট্রে হাতে দাড়িয়ে লোভাতুর চোখে ঘন ঘন নিঃশাষ ফেলছে।
শীতের দিনগুলোতে রাশিয়ানদের খাবারের মেন্যু খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আলু ওদের প্রধান খাদ্য-এক বেলা যেন সেটা ছাড়া চলে না।
এতবড় দেশজুড়ে গ্রীস্মকালে লক্ষ লক্ষ মেট্রিকটন আলু উৎপন্ন করেও বছরজুড়ে টান পড়ে। বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এই আলুর সাথে রুটি, সসেজ,সালামি, ঘোল মাখন ছানা মুরগি ডিম গরু শুয়োর খাবারের মধ্যে এই কাটার ভয়ে ভীত বলে মাছ খুব বেশী খায়না। সব্জি বলতে তখন বাধাকপি লবনে জারানো গাজর টম্যাটো আর সসা। হট ডগ ওরা বেশ পছন্দ করে।
কিন্তু বার্গার,ফ্রেন্ঞ ফ্রাই, পাই -মিল্ক সেক আর সাথে প্রমান সাইজের গ্লাসে বরফ ভর্তি কোক আর পেপসির স্বাদ ওরা কখনো পায়নি। মসলাবিহিন বিস্বাদ(আমার দৃষ্টিতে) খাবার খেতে খেতে ওরা তখন ক্লান্ত! তাই স্বাদ পরিবর্তনের এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায়না। মস্কো আসলেই সবাই ম্যাকডোনাল্ডের দিকে দৌড়াত।
প্রথমবার যখন রাশিয়া যাই তখন পোরেস্ত্রোইকার পরবর্তী ভীষন ফাকা একটা সময়। সদ্য সোভিয়েত যুগের সমাপ্তি হয়েছে তখন।
এই বিশাল পরিবর্তন কিন্তু তখনো রুশ জনগনের মানসিকতা অর্থনৈতিক সামাজিক কোন পরিবর্তন হয়নি তেমন করে। বহুবছর ধরে সমাজতন্ত্রিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা রুশীয় জনগন তাদের এই নতুন যুগান্তকারি পরিবর্তনের সাথে ঠিক খাপ খাওয়অতে পারছিলনা। সবকিছুই চলছিন তার চিরপরিচিত সমাজতান্ত্রিক আদলে। তখনো প্রাভেটাইজেশন শুরু হয়নি-‘তালোন’(রেশনের টিকেট) ব্যাবস্থা বহাল ছিল আরো কয়েক বছর ধরে। সদ্য স্বাধীন হওয়া ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে চালু হয়নি ভিসা প্রথা।
অতি দুর্বল টেলি কমিউনিকেশন-ডাক ও টেলিগ্রাফের উপর চরম নির্ভরতা তখনো ছিল। অকল্পনীয় সস্তা দ্রব্যমুল্য কিন্তু সহজলভ্য নয় তখনো। ব্যাবসা কি জিনিস তাদের মগজে ঢোকেনি। সবার ভিতরে কিছুটা আতঙ্ক মেশানো উত্তেজনা কিন্তু বাইরে থমথমে নির্ভার শান্ত পরিবেশ।
আমি দ্বীতিয়বার যখন রাশিয়াতে যাই তখন পূরো দেশের আমুল পরিবর্তন দেখে বেকুব বনে গিয়েছিলাম।
ভোজবাজির মত যেন পাল্টে গিয়েছিল দেশটা। মস্কো জুড়ে শত শত নামিদামী ব্রান্ডের দোকান-চারিদিকে অঢেল অর্থের ছড়াছড়ি। রুশীয়দের মানসিকতা –রুচি পাল্টে গেছে ভীষনভাবে। পুজিবাদের নগ্ন প্রকাশ চারদিকে। এখন ওদের আর বিশেষ কোন ব্রান্ডের ফাস্ট ফুড সেইভাবে টানে না- সারা মস্কো জুড়ে তখন আশিটির-ও বেশী ম্যাকডোনাল্ডের রেস্টুরেন্ট।
আমার বন্ধুরা নিজেদের গাড়িতে যেতে যেতে সাই করে গাড়ি ঘুরিয়ে ঢুকে পরে কোন ম্যাকডোনাল্ডের লবিতে- গাড়িতে বসেই এক কাউন্টারে টাকা দিয়ে আরেক জানালা দিয়ে খাবার নিয়ে ধাই করে বেরিয়ে যায়। আমি প্রথমে চোখ বন্ধ করে ঘ্রান নিই কিছুক্ষন – কল্পনায় হাতড়ে ফিরি পুরনো সেই রাশিয়াকে তারপর মোড়ক খুলে কামড় বসাই মোলায়েম সেই বার্গারে। কেন যেন পুরনো সেই স্বাদ আর পাইনা। সমাজতন্ত্রের কোলে বসে পুঁজিবাদের যেই স্বাদ পুরো রুশ জাতি সহ আমকেও মোহাবিষ্ট করত-এখন খোদ পুঁজিবাদী রাশিয়াতে বসে সেই স্বাদ পাল্টে গেছে অনেকখানি-কখন কিভাবে তা আমার জানা নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।