আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রুস্কাইয়া ব্লুদা-১৫( রাশিয়ার কিছু জানা অজানা কথা)

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! ANTONOV-225 a Russian Space Shuttle carrier aircraft আন্তনভ’ এন ২২৫ মিরাইয়া Мрія (উক্রাইনান ভাষা- যার অর্থ সপ্ন বা অনুপ্রেরনা) পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ বিমান। এটাই পৃথিবীর একমাত্র বৃহৎ বিমান যা একের অধিকবার উড্ড্য়ন করেছে। যার মাত্র বত্রিশখান চাকা আর ডানার এপাশ থেকে ওপাশের মাপ ২৯১ ফিট। এটা প্রথম নকশা করা হয় ১৯৮৮ সালে যা মুলত এনারর্গিয়া(এনার্জি) নামে বুরানের রকেটের বুস্টার পরিবহনের জন্য। যার দুইলক্ষ পঞ্চাশ হাজার কেজি ওজন নিয়ে উড্ডয়নের ক্ষমতা আছে।

উচ্চতা ৬০ ফুট। আন্তনভ মিরাইয়া তার ১৪০ ফিট লম্বা পিঠে করে রাশিয়ার প্রথম স্পেস শাটেল ‘বুরান’কে সর্বপ্রথম সোভিয়েতের বাইরে নিয়ে গিয়েছিল ১৯৮৯ সালে প্যারিস এয়ার শো’তে। আন্তনভ সপ্নে’র অনুরুপ আরেকটা বিমানের তৈরির অনুমতি দেয়া হয়েছিল আন্তনভ এন ২২৫ এর থেকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন করে আরো বেশী বহন ক্ষমতা সম্পন্ন রাশিয়া সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্পেস শাটল ও রকেট বুস্টার পরিবহনের জন্য ‘আন্তনভ এয়ারলাইন্স’ আন্তনভ এন-৩২৫ নামে আরেকটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল কিন্তু অর্থাভাবে সেই প্রজেক্টটাও বাতিল হয়ে যায়। (গত এক যুগ ধরে বহুবার চেষ্টা চলেছে সেটাকে পূনর্নিমান করার কিন্তু আজ অব্দি কাজ বেশিদুর এগোয়নি। ) শুধু এই দৈত্য বিমানের-ই গিনেজ বুকে দুইশত চল্লিশ খানা রেকর্ড অন্তভুক্ত আছে!এর একটা রেকর্ড সর্ব্বোচ্চ পরিবহন ব্যয়ের -ডেনমার্ক থেকে কাজাকস্থানে পন্য পরিবহনের জন্য ২০০৮ সালে ‌এক দফায় খরচ হয়েছিল দুই লক্ষ ছেষট্টি হাজার ইউরো ।

যদিও এই বিমানের মালিক এখন উক্রাইন। রাশিয়া তাদের স্বত্ব হারিয়েছে সোভিয়েতের পতনের সাথে সাথেই। ১০৬টা বিশ্ব রেকর্ড ভেঙ্গে এই বিমান সর্ব প্রথম উড্ডয়ন করে ১৯৮৮ সালে। একসাথে এতগুলো বিশ্ব রেকর্ড ভাঙ্গা-ও ছিল একটা রেকর্ড! আন্তনভ সিরিজের এন -২২(১৯৬৫) ছিল বিশ্বের প্রথম টার্বোপ্রোপ চালিত সর্ব বৃহৎ বিমান। আন্তনভ এন-৭০(১৯৯৪)বিশ্বের সর্বপ্রথম প্রোপফ্যান চালিত সর্ব বৃহৎ পরিবহন বিমান।

আন্তনভ-২২৫ এর নিকট আত্মীয় আন্তনভ-১২৪ ব্যাবহুত হয়েছিল জেমস বন্ড চলচ্চিত্রের বিখ্যাত সিরিজ ‘ডাই এনাদার ডে’ ছবিতে। এইতো সেদিন ২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এ দিল্লি এয়ারপোর্টে অবতরন করেছিল আন্তনভ ১২৪। কারনটা কি জানেন? এই দানব এয়ারক্রাফটটা জার্মানী থেকে দিল্লির প্রথম মেট্রো কোচ বহন করে এনেছিল! আন্তনভ ২২৫ মিরাইয়া ১৯৮৯ সালে প্যারিস এয়ারশো’তে সেই বুরানকে পিঠে করে নিয়ে গিয়েছিল যেটা ঠিক আট মাস আগে সেই সোভিয়েত যুগে একটা ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। নামহীন একটা মিশনে সেটা সফল উড্ডয়ন করে পৃথিবীর চারপাশে দু চক্কর ঘুরে ফের নিরাপদে ভুপৃষ্ঠে অবতরন করেছিল। কিন্তু সেই সফলতাও বুরান প্রজেক্টকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি।

বুরানের সাথে সাথে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম এয়ার ক্রাফট এন-২২৫ মিরাইয়াও প্রায় তার অন্তিম দশায় পৌছে গিয়েছিল। এই বিশালকায় বিমান কিয়েভের পোতাশ্রয়ে হ্যাঙ্গারের বাইরে চরম অবহেলিত অবস্থায় দীর্ঘদিন পড়েছিল। ১৯৯৪ সালে এর ইঞ্জিন খুলে নিয়ে ব্যাবহৃত হয় আন্তনভ ১২৪ এস এ। আরো কিছু বছর আন্তনভ২২৫ এইভাবে অবহেলায় অযত্নে বহু বছর পড়ে থাকার পর একবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে এর উইক্রাইনান মালিক ‘আন্তনভ গ্রুপ’ ভাবনাচিন্তা শুরু করল মিরাইয়াকে নিয়ে। কি করে একে বানিজ্যিক ভিত্তিতে লাভজনক করা যায় সেইটে রইল তাদের মুল চেষ্ঠা।

মিরাইয়ার ওজন ধারন ক্ষমতা ছিল সাড়ে পাচ লক্ষ পাউন্ডের থেকেও বেশী(৫৫১,১৫০ পাউন্ড)। কোন কিছু এর পোটের মধ্যে ঢোকাতে চাইলে সম্মুখভাগ দিয়ে চালান দিতে হবে। এর সম্মুখভাগের ১৪ ফিট উচু আর বিশ ফিট চওড়া কার্গোর দরজা যখন খুলে যায় তখন এর বিশাল মুখ গহ্বর দিয়ে দৈত্যাকার মালবাহি ট্রাকও ঢুকে যায় অনায়াসে। কোন কিছু পেটে করে নিতে না নিতে পারলে সমস্যা নেই। আন্তনভ তার একশ চল্লিশ ফিট লম্বা পিঠে করে বহনযোগ্য যেকোন কিছু নিয়ে ঘন্টায় পাচশ মাইল গতিতে একটানা আড়াই হাজার মাইল উড়ে যেতে পারে(কোন কিছু বহন না করে মিরাইয়া মাটি থেকে প্রায় সাত মাইল উচু দিয়ে একটানা সাড়ে নয় হাজার মাইল উড়ে যেতে পারে)।

এমন একটা সোনার ডিম পাড়া রাজহাসকে এভাবে অবহেলায় ফেলে রাখাটা যে বোকামী এই অবশেষে সেই কর্তা ব্যাক্তিরা বুঝতে পারলেন। অবশেষ তারা বিশ মিলিয়ন ডলার খরচ করে আরো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি লাগিয়ে আন্নভ-২২৫ মিরাইয়াকে নবজীবন দিলেন। অবশেষে জানুয়ারি ২, ২০০২ সালে মিরাইয়া জার্মানীর স্টুটগার্ড থেকে প্রথমবার বানিজ্যিক বিমান হিসেবে উড়াল দিল। পারস্য উপসাগরে যুদ্ধরত আমেরিকান যোদ্ধাদের জন্য দুইলক্ষ ষোল হাজার রান্না করা খাবার প্যাকেট নিয়ে সে উড়ে গিয়েছিল সেদিন। ভাবতে অবাক লাগে আন্তনভ মিরাইয়া এখন রংচং মেখে তার ভোল পাল্টে কানাডিয়ান আর সোভিয়েতদের এককালের চরম শত্রু ইউ এস আর্মির খাবার আর যুদ্ধ সরঞ্জাম বহন করে নিয়ে যায় মধ্যপ্রাচ্যে ।

রুশীয়দের তৈরি এতগুলো বিমানের কথা বললাম কিন্তু তাদের হাতেই বানানো বিশ্বের সর্ব বৃহৎ ভারি পন্য বহনের উপযোগী, ভয়ঙ্কর শক্তিশালী সামরিক ও বেসামরিক ব্যাবহৃত হেলিকপ্টার এম আই ২৬ এর কথা না বললেই নয়। যেটা প্রথমে তৈরি হয়েছিল ‘মিল মস্কো হেলিকপ্টার প্লান্ট’ থেকে । প্রথম উড্ডয়ন করেছিল ১৯৭৭ সালে । সোভিয়েত সরকারের রাখঢাক ও দীর্ঘ গোপনীয়তার পর বিশ্ব সর্ব প্রথমএই হেলিকপ্টার সন্মন্ধে জানতে পারে ১৯৮৩ সালে। আট ডানার রটার এই কপ্টারের সব্বোচ্চ বহন ক্ষমতা প্রথমে ছিল ২০ মেট্রিকটন।

এম আই ২৬ কপ্টারের আগে ভি-১২ নামে একটা হেলিকপ্টার পরিক্ষা মুলক ভাবে তৈরি করা হয়েছিল যেটা বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও ভারি কপ্টারের স্বীকৃতি তার উৎপাদনের অসফলতার কারনে। সাল ১৯৯৬,সেপ্টেম্বর ২৭। প্রায় চল্লিশটা দেশ থেকে একত্রিত হওয়া পৃথিবীর বিখ্যাত তিন শতাধিক ‘স্কাই ডাইভার’ aerial judges (বায়বীয় বিচারক),আলোকচিত্রকর ও সিনেম্যাটোগ্রাফার হলিউডের নামী দামী এরিয়েল স্টান্ট বি,জে ওরথ এর নেতৃত্বে ৬৭০০ মিটার উপর থেকে চারটে এম আই ২৬ কপ্টার থেকে প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করে। ১৯৯৯ সালে বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলে বরফের নীচে প্রায় অবিকৃত অবস্থায় প্রাগৈতিহাসিক বিশাল এক ম্যামোথ এর সন্ধান পায়। ম্যামোথ সহ সেই বরফ খন্ডের ওজন ছিল প্রায় পচিশ টন।

বৈজ্ঞানিকরা আশা করেছিল সেই ম্যামথের দেহকোষ থেকে ক্লোন করা সম্ভব হবে। সেই বরফ খন্ডটা ল্যাবরেটরিতে আনার জন্য এম আই ২৬ হেলিকপ্টারকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এত বেশী ওজন বহনের ক্ষমতা সেই কপ্টারের ছিলনা। পরবর্তিতে সেই কপ্টার ফিরিয়ে এনে বেশী ওজন ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন কপ্টার নতুন করে তৈরি করে ফের পাঠানো হয়। ২০০২ সালে আফগানিস্থানে ‘তালেবানদের আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্থ আমেরিকানদের গর্ব চিনুক হেলিকপ্টার বরফাচ্ছাদিত পর্বতের ৩১০০ মিটার পর্যন্ত উচু থেকে এ অব্দি ‘মিল মস্কো’৩১৬ টা হেলিকপটার তৈরি করেছে।

যেগুলো আজ ব্যাবহৃত হচ্ছে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স,উক্রাইন আর খোদ রাশিয়ান এয়ারফোর্সে। রাইট ভাতৃদ্বয় তাদের আবিস্কৃত বিমান কিটিহককে প্রথমবার উড়িয়েছিল ১৯০৩ সালে যার দুরুত্ব ছিল একশ বিশ ফিট। ভাবুন একবার সেই উড়নটা ছিল আন্তনভ মিরাইয়ার বিস্তৃত দু ডানার দুরত্বের অর্ধেকেরও কম! তবুও বিশ্বের সব’চে বৃহৎ এই কেরিয়ার এয়ার জেট এর কোম্পানি ইউক্রাইন ভিত্তিক ‘আন্তনভ এয়ার লাইন’স কিন্তু সবসময়ই এই বিমান চালিয়ে লোকসান করেছে। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোন দেশ এইরকম দৈতাকৃতির আরেকখান বিমান বানানোর অনুরোধ করেনি তাদের। তবুও আজ অব্দি তারা এটা চালিয়ে যাচ্ছে এই কোম্পানীর প্রযুক্তিগত শৌর্যের প্রতিক হিসেবে কেননা এখনো এই বিমানের প্রতিটি বিচলন স্থানীয় পত্রিকার খবরের মুখ্য বিষয় হয়।

ছবি:বা থেকে ডানে ১.আন্তনভ-২২৫ মিরাইয়া এয়ারক্রাফট ২. আন্তনভের পিঠে বুরান আর সামনে দাড়িয়ে আছেন বুরান প্রজেক্টের কারিগরেরা ৩.এম আই-২৬ কপ্টার আফগানিস্থানে ক্ষতিগ্রস্থ চিনুক কপ্টারকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.