আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রুস্কাইয়া ব্লুদা-১৬( রাশিয়ার কিছু জানা অজানা কথা)

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! কোন একদিন; আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের যুগের কথা বলছি। জীবন যাত্রা ছিল অনেক বেশী সুখী আর সহজ কিন্তু সমৃদ্ধ নয়। তবে বেশীরভাগ লোক তাদের কাজ আর জীবন যাত্রা নিয়ে বেশ সস্তুষ্ট ছিল। অল্প কিছূ মানুষ -হয়তো কোন কোন সমাজে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরা কখনোই কোন অবস্থাতেই সুখী নয়- আমি এদের কথা বলছিনা।

আমি বলছি সোভিয়েত সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা। যারা কমিউনিজম এর বিখ্যাত মতাদর্শ নিয়ে একখানে বন্ধুর মত জড়ো হত। হারিয়ে যাওয়া সেই স্বর্ণযুগের কথা এখন বয়স্করা গল্প করে শোনায় "soft Soviet education" (доброе советское воспитание - in Russian; দোব্রোই সোভিতস্কোই ভোস পিসানিয়ে) উঠতি বয়সী তরুন-তরুণীদের যাদের তখনো জন্ম হয়নি কিংবা জন্ম হলেও নেহায়েৎ শিশু ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে একটি বিশাল দেশ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গিয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই নাম -পেরিয়ে গেছে কুড়ি বছরের অধিককাল সময়। তারা পেয়েছে বহু আরাধ্য তথাকতিথ বাক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি।

কিন্তু তাতে করে কতটুকু সুখী ও সমৃদ্ধ করেছে সেই জাতিকে,ওদের অন্তরের মধ্যে একটু ঢুঁ মেরে দেখুন? বহু প্রাক্তন সোভিয়েত নাগরিকদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, তাদের অন্তরে এখনো সোভিয়েত দিনের সেই সুখস্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই সোভিয়েতের সেই কম্যুনিজম যুগের নেতিবাচক ধারানা ছড়িয়েছে সারাবিশ্বে; তারা বলেছে,তাদের রাজনৈতিক পদ্ধতি নিয়ে,তাদের কেজিবি নিয়ে তাদের মান্ধাতা আমলের লড়ঝড়ে অটোমোবাইল বেঢপ টিভি আর সেই টিভির থেকে বড় আকৃতির রেডিও নিয়ে। তারা রসিকতা করেছে ওদের জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে ওদের চাকচিক্যহীন পোষাকাদি নিয়ে এমনকি সোভিয়েত নাগরিকদের খাদ্যাভাসও ওদের পছন্দ হয়নি। সবচেয়ে বেশী সরব ছিল পশ্চিমা বিশ্ব ওদের বাকস্বাধীনতা নিয়ে- সোভিয়েত সরকার কতৃক টুটি চেপে ধরা মিডিয়ে ওদেরকে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। কিন্তু একজন একজন সচেতন প্রাক্তন নাগরিককে জিজ্ঞেস করে দেখুন;সেই সব দিনগুলিতে সোভিয়েত নাগরিকদের সামান্য সামাজিক পার্থক্য থাকলেও ওদের অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রায় ছিলই না বললে চলে।

কিছু কমন ভ্যালু যেমন,বন্ধুত্ব,আন্তরিকতা প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক এসব একজন ব্যাক্তি বা পরিবারের জন্য দারুন গুরুত্বপূর্ন। সেইসব সোভিয়েত সমাজে বেশ দাপটের সাথেই উপস্থিত ছিল। সোভিয়েত যুগের বহু মানুষ এখন সেই সব স্মৃতি রোমন্থন করে দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে। তাদের যৌবনের সেই ঐন্দ্রজালিক সপ্নের ট্রেন তাদেরকে পুজিবাদী নামক ভয়ানক স্বার্থপর অর্থনৈতিক সমাজব্যাবস্থার মধ্যে ফেলে রেখে চলে গেছে চিরদিনের জন্য। একটা সময় ছিল যখন সোভিয়েত প্রতিটা নাগরিকই একটি সফল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার নিমিত্তে সবরকম উন্নয়ন মুলক কর্মকান্ডে যোগ দিয়েছিল সেখানে কিছুটা ছিল নৈতিক আর কিছু ছিল আইনগত বাধ্যবাধকতা।

তারা বেড়ে উঠেছিল সোভিয়েত সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে যারা মুলত সৈনিক বা কর্মী কিংবা কোন অভিযাত্রী। যাদের ছিল অতি সাধারন আবাস,চাকচিক্যহীন পোষাকাদি .অপ্রতুল বিনোদনের ব্যাবস্থা মোটামুটি সাচ্ছন্দে বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত বা অপর্যাপ্ত আহার। যাদের পড়াশোনার ভার নিয়েছিল সেই সমাজতান্ত্রিক সরকার তারপরে চাকরির নিশ্চয়তা -জীবনের নিরাপত্তার সাথে শেষ কিংবা অবসর জীবনে তাদের বেঁচে থাকার জন্য রাষ্ট্রের সব রকম সুবিধাদি। এখনো মধ্য এশিয়ার বহু মানুষ থেকে শুরু করে সোভিয়েত যুগের সেইসব নাগরিকেরা সপ্ন দেখে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সেই সেই রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ব্যাবস্থা ফিরে পাবার। এটা অনেকাংশেই ভাল বর্তমান এই ভোগবাদী রাজনৈতিক সমাজব্যাবস্থা থেকে।

সেইসব দিনের কথা ভেবে বয়স্ক মানুষের চোখের কোল ভিজে ওঠে। তাদের ভীষন গর্বের একটা সময় ছিল- ছিল অহংকার করার মত একটা দেশে। বিশ্বের মানচিত্রে যার ছিল সবল উপস্থিতি-শৌর্যে শক্তিতে আর জ্ঞান বিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিল তারা। তারা ছিল বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি – অন্যান্য শক্তিধর দেশেরা সম্ভ্রমের সাথে উচ্চারন করত সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম। আর আজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া বিশাল সেই দেশের অবস্থান কোথায়? শুধু চাকচিক্য ভোগবিলাস আর তথাকতিথ বাকস্বাধীনতাই যে সব নয় তাতো এখন আমরা বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করছি।

-জনৈক আনোয়ার,উজবেকিস্থান [আনোয়ারের বয়স এখন ৬০ ছুয়েছে। হাসতে গিয়ে ঝিলিক দিয়ে ওঠা সোনা দিয়ে বাঁধানো দাতের (সোভিয়েত ইউনিয়নে জোলাতাইয়া জুবা বা সোনা দিয়ে দাত বাধানোর প্রচলন ছিল ব্যাপক- বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে)ছোটখাট গড়নের সেই মানুষটার সাথে মুল লেখকের দেখা হয়েছিল প্যারিসে ২০১১ সালে। সে একজন শিক্ষক তার স্ত্রীও নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেঞ্জ ভাষার শিক্ষক। সে মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে উনিশ’শ নব্বুইয়ে। এখন যদিও সে শুয়োরের মাংসও বর্জন করেছে কিন্তু মদটা খাওয়াটা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে।

মদের গ্লাস হাতে নিয়ে এখন সে স্মরণ করে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে তার ফেলে আসা স্বার্ণালী দিনগুলোর কথা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সে গর্বভরে বুক চেতিয়ে বলে তার সমাজতান্ত্রিক দেশের কথা। ] সরাসরি অনুবাদ নয় রুপান্তরিত- "unforgettable Soviet period" (незабываемые советские времена - in Russian). ফুটনোট:আনোয়ারের বাকি কথা শুনাব এর পরের পর্বে । রুশীয় কাঠের ক্যালকুলেটর: ভিতরে ঢুকে চোখ ছানাবড়া। বাইরে থেকে এতটুকু বোঝার উপায় নেই-এ দেখি বেশ বড় সড় সপিং মল।

দেখতে আমাদের এখনকার আঘোরা কিংবা নন্দনের মত কিন্তু কোন ট্রলি নেই –হাত দিয়েও কোন কিছু নেবার উপায় নেই। কাউন্টারের ওপাশে বিক্রেতা রমণীগন ক্রেতার ফরমায়েশ অনুযায়ী দ্রব্য গুলো প্যাকেটজাত করে টাকা পয়সা গুনে নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। টাকা পয়সা হিসেব করার কৌশল তেমনি আদ্যিকালের। আমি বাপের জন্মে এমন ক্যালকুলেটর দেখিনি। কয়েকখানা লোহার দন্ডের মাঝে গোল গোল কাঠের ঘুটি গুলো দ্রুত হাতে ডাইনে বায়ে চালান করে কি যে হিসেব করছে আল্লা মালুম!(আমার লেখা ‘রুশ কারতুসকা’থেকে) রুশীয় এ্যবাকাস বা ‘চোতি’счёты রাশিয়ায় ব্যাবহার শুরু হয় ১৮২০ সাল থেকে যা গত শতাব্দীর নব্বুই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাশিয়ায় সর্বাধিক ব্যাবহৃত হয়েছে।

বিশ্বাস করা যায়- মাত্র পনের বিশ বছর আগেও ওরা কোন ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটরের পরিবর্তে ব্যাবহার করত আদ্যি আমলের ‘চোতি’। জনৈক সুইডিশ ‘ভিটি ওধনার’কতৃক আবিস্কৃত ‘ওধনার এরিথমোমিটার’বা ‘পিনহুইল ক্যালকুলেটর’আবিস্কৃত হয় ১৮৭৩ সালে। যার প্রথম কারখানা স্থাপিত সেন্ট পিটার্সবার্গে ১৮৯০ সালে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গনক যন্ত্র। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে এই যন্ত্র তেমন সমাদৃত হয়নি।

ওরা যেন এ্যাবাকাসের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিল। লোহার শলাকায় গাথা গোল গোল কাঠের গুটিগুলো যেন তাদের খেলনা ছিল। দ্রুত হাতে রুশ রমনীরা তাদের সুন্দর আঙ্গুলীদ্বারা ঘুটিগুলো ডাইনে বায়ে নাচাত তখন মনে হত পিয়ানোর রিড চেপে নতুন কোন সুর তুলছে আর সেকারনেই হয়ত কোন শিল্প বোদ্ধা ক্রেতা মোহাবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকত হঠাৎ জীবন পাওয়া সেই কাঠের ঘুটিগুলোর দিকে। দুই হাজার ১২ সালে অনলাইনে এক রুশ সোতি’র বিজ্ঞাপন নিন্মরুপ; আদ্যি কালের কাঠের অ্যাবাকাস-সোভিয়েত রাশিয়ান গননাযন্ত্র ব্যবহার করুন গৃহসজ্জার জন্য,বাচ্চাদের খেলনা হিসেবে এমনকি পায়ের মাংশপেশী মর্দনের জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়নে এটা ব্যাবহৃত হয়েছে নাকি নব্বুই দশক পর্যন্ত!লোহার দন্ডগুলোতে গাথা পুতি বা ঘুটিগুলো ডাইনে থেকে বায়ে আলতো করে সরিয়ে আপনি আপনার গননার কাজ সারতে পারেন খুব সহজেই।

দশটা করে ঘুটি আসে প্রতিটা লাইনে তার মধ্যে দুটো কালো যা পাঁচ ও ছয় সংখ্যা বোঝায়। উপরের থেকে নীচের লাইন ১০০০০,১০০০,১০০,১০,১ অংকের জন্য। আরেকটা লাইন আছে যা যাতে চারটে মাত্র সাদা ঘুটি যার প্রতিটি রুবলের চারের এক ভগ্নাংশ বা ২৫ কোপেক নির্ধারন করে। সোভিয়েত কতৃক ১৯৮০ সালে তৈরি। একদম ভাল অবস্থায়-শুধু কিছু সাদা রঙ্গের ছোপ আছে।

সাইজ -১২.৬ ইঞ্চিx৭.৯ ইঞ্চি অ্যাবাকাস পাটিগাণিতিক গণনা সম্পাদনের একটি প্রাচীন যন্ত্র, যাতে একটি কাঠের ফ্রেমের বসানো তারে লাগানো গুটি উপরে নীচে সরিয়ে গণনা করা হয়। ফ্রেমে বসানো একটি তারের উপর গুটিগুলি বসানো থাকে। তারগুলির সাথে লম্বভাবে একটি আড়াআড়ি দণ্ড থাকে যা গুটিগুলিকে দুইভাগে ভাগ করে। প্রতিটি তার দশমিক ব্যবস্থার একটি ঘর নির্দেশ করে। সবচেয়ে ডানদিকের তারটি হল এককের ঘর।

তার বামপাশেরটি হল দশকের ঘর, ইত্যাদি। প্রতিটি তারে আড়াআড়ি দণ্ডের নিচে পাঁচটি গুটি থাকে, যা এক একক নির্দেশ করে। আড়াআড়ি দণ্ডের উপরে অবস্থিত তারে দুইটি গুটি থাকে, যেগুলির প্রতিটি পাঁচ একক নির্দেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, দশকের ঘরে নিচের পাঁচটি গুটির প্রতিটি ১০ নির্দেশ করে এবং উপরের দুইটি গুটি প্রতিটি ৫০ নির্দেশ করে। যে গুটিগুলিকে কোন সংখ্যার অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে, সেগুলিকে আড়াআড়ি দণ্ডের উপরে বসানো হয়।

অনেক প্রাচীন সভ্যতা অ্যাবাকাস ব্যবহার করত। রোমানদের অ্যাবাকাস ছিল ব্রোঞ্জ নির্মিত লিপিফলক। লিপিফলকটি খাঁজকাটা ছিল। গোলাকৃতির গুটিগুলি গড়িয়ে যেতে পারত। রোমানদের অ্যাবাকাস পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যে এবং দূরপ্রাচ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।

মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডে অ্যাবাকাসের একটি সরলীকৃত রূপ ব্যবহার করা হত। দ্বিতীয় শতকে চীনদেশের সাহিত্যে অ্যাবাকাস ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে চীনদেশে অ্যাবাকাস তেমন ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়নি। রোমান অ্যাবাকাস এবং চৈনিক এবাকাসের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য ছিল। চৈনিক অ্যাবাকাসে প্রতিটি পর্যায়ে একটি করে গুটি বেশি থাকত এবং গুটিগুলি তারের উপর লাগানো থাকত।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে জাপানে অ্যাবাকাসের ব্যবহার শুরু হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে এর একটি উন্নত সংস্করণ প্রচলন হয়। চীন ও জাপানের কিছু কিছু অঞ্চলে এখনও অ্যাবাকাসের প্রচলন আছে। চীনে অ্যাবাকাসকে বলে 'সুয়ান-পান' (Suan-pan)। জাপানে বলা হয় 'সরোবান' ( Soroban)।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.