মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! স্করপিয়নের সেই বিখ্যাত গান
I follow the Moskva
Down to Gorky Park
Listening to the wind of change
সেই গোর্কি পার্কের পাশ দিয়েই ট্যাক্সি চড়ে যাচ্ছিলাম। বা দিকে তাকালে দেখা যায় মস্কোভা নদীর কোল ঘেষে বিশাল গোর্কি পার্কের এক কোনে চারিদিকে বুক সমান গ্রিল দিয়ে ঘেরা অনেকটা খাচার মত জায়গায় বিশাল দু ডানা ছড়িয়ে অনড় হয়ে আছে একটাএয়ারক্রাফট। দেখতে ঠিক আমাদের চেনা জানা বিমান বা আকাশযানের মত হুবহু না হলেও –পৃথিবীতে কত কিসিমের বিমান তৈরি হয়েছে সেসব ভেবে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেই। এ পথ দিয়ে যাতায়াতের সময় প্রায়শই দৃষ্টি চলে যায় সেই বিমানটার দিকে -কিন্তু কৌতুহলী হইনি কখনো। খুব সম্ভবত বিমানখানা পার্কে রেখে তার পেটে একটা রেস্টুরেন্ট বানিয়ে দর্শনার্থীদের বাড়তি মনযোগ কাড়বার এই চেষ্টা!
সেদিন সম্বিৎ ফিরল ট্যাক্সি চালকের ডাকে।
বিমানটা দেখিয়ে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি জানো ওইটে কি?
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, না জানার কি আছে ওইটে একটা বিমান?
লোকটা হাসল আমার কথা শুনে-এটা কিন্তু সাধারন কোন বিমান নয়।
এবার আমার একটু কৌতুহল হল, ‘সাধারন বিমান নয়তো কি যুদ্ধ বিমান?’
‘না। ওটা একটা স্পেস শাটল। রাশিয়ানদের তৈরি প্রথম স্পেস শাটল’।
স্পেস অর্থাৎ মহাকাশ তখন মহাকাশ বিষয়ক ব্যাপার স্যাপার নিয়ে আমার খুব বেশী আগ্রহ ছিলনা।
স্পেস শাটল ‘ নামটা রুশ ভাষায় খটমটে মনে হওয়ায় আমি বিস্তারিত জানার চেষ্টা করিনি। (আসলে আমি তখন বুঝিইনি। )
প্রতিউত্তরে ভদ্রতার খাতিরে শুধু দায়সারা গোছের একটা উত্তর দিলাম -অ তাই।
স্পেস শাটলটার দিকে জুল জুল চোখে তাকিয়ে সে এবার বেশ বড় একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি জান এই মহাকাশ যানটা তৈরির পিছনে আমারও হাত ছিল। আমি ছিলাম এই প্রজেক্টের একজন ইঞ্জিনিয়ার।
-যেদেশে পাইলটের থেকে বাসড্রাইভারের বেতন বেশী সেখানে একজন ইঞ্জিনিয়ার (স্পেস শাটল) ট্যাক্সি চালাবে এমন আর কি?
আমি তার দিকে করুনার দৃষ্টিতে তাকালাম মাত্র। মুখের ভাবখানা এমন ছিল ছিল যে, আমি চরম বিস্মিত তার কথা শুনে!
কারন তখন বুরানকে শুধুমাত্র একটা ভিন্ন ডিজাইনের এয়ার ক্রাফট ছাড়া ভাবতে পারছিলাম না আমি। সে সময়টা আমি তাম্বোভের রাস্তার পাশে ঝাঁ চকচকে ট্যাংক, হোভার ক্রাফট সহ অনেক বহু দামি দামি সামরিক সরঞ্জাম অবিভাবকহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি। পেরেস্ত্রোইকা নামের এক ভীষন ঝড় এসে বিশাল এক ভুখন্ডের মানুষের জীবনধারাকে ভয়ঙ্কর ভাবে ওলোট পালট করে দিয়ে গেছে। অর্থ উপার্জনের খুব বেশী শর্টকার্ট পদ্ধতি এদের জানা ছিল না।
কিছু যুবকেরা দুর্বলদের ভয় দেখিয়ে কিল-ঘুষি মেরে অর্থ ও অস্থাবর সম্পদ ছিনিয়ে নিচ্ছিল আর যুবতী ও মহিলারা আদিমতম পেশা দেহ ব্যাবসায় যুক্ত হচ্ছিল কেউ বাধ্য হেয়ে আর কেউবা সখে কিংবা বিলাস ব্যাবসনের জন্য। এইরকম কত ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার চাকরি হারিয়ে পথে নেমেছে কত ব্যাবসার ধান্দায় আর এখানেতো তিনি তাও ভদ্রস্থ পেশায় নিযুক্ত।
সেবার গ্রীস্মে গোর্কি পার্কে গেলাম হুট করেই আচমকা মনে হল তাই তিন বন্ধুকে সাথে করে। বিশাল পার্ক!
Tsentralnyi Park Kultury i Otdykha imeni Gorkovo (The Maxim Gorky Central Park of Culture and Leisure)
১৯২৮ সালে নির্মিত বিখ্যাত রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির নামে গোর্কি পার্কের পরিকল্পনাকারি ছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত স্থপতি কনস্তানতিন মেলনিকভ। সোভিয়েত যুগে এখানে বিখ্যাত ‘নেসকুসনি প্রসাদ, ও তার সংলগ্ন ৬৮ একর জুড়ে সুদৃশ্য বাগান,ও বহু পুরোন ‘গোলিৎসিন হাসপাতাল’ছিল ।
সোভিয়েত উত্তর যগে এটাকে বিনোদনমুলক পার্কে রুপান্তরিত করা হয়। মাত্র গত বছরেই-(২০১১সালে)এই পার্কের সব ধরনের রাইড সরিয়ে এটাকে অত্যাধুনিক রাইড দিয়ে একদম নতুন করে সাজানো হয়েছে।
পার্কের বেশ কিছু অংশ জুড়ে মনোরম সংকীর্ন রাস্তার কিনারা ঘেষে প্রমান সাইজের ঝক ঝকে আয়না বসানো। (পুরো শীতকালটা জুড়ে এই রাস্তার উপরে জমে থাকা বরফে প্রচুর স্কেটাররা জমা হয় এখানে স্কেটিং করার জন্য। ) এর পাশ দিয়ে দর্শকরা হেটে যেতে যেত হেসে লুটোপুটি খায়! সবগুলো আয়নাই সতন্ত্র।
একটার সাথে আরেকটার প্রতিফলনের চমৎকার পার্থক্য লক্ষ্য করতে বার্ধ হবেই যে কেউ। কোনটার পাশ দিয়ে হাটার সময় নিজকে মনে হবে বামনাকৃতির আবার কোনটার পাশ দিয়ে যেতে যেত মনে হবে বিশাল এক বপু নিয়ে হাটছি আমি! কোনটাতেবা চোখমুখ বেকে গিয়ে ক্যারিকেচারের রুপ নেয়। ব্যাপাটার সাথে নতুন পরিচয় বলেই আমাকে বেশ আকর্ষন করল । সেই সাথে ভুমি থেকে উচুতে ছুড়ে দিয়ে বাগ্গি জাম্প (সবখানে উল্টোটা হয়)আর রোমাঞ্চকর কিছু খেলনা আমাদের মনে দারুন উচ্ছলতা এনে দিল।
সবশেষে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে দাড়ালাম গ্রিল দিয়ে ঘেরা খাচায় বন্দী সেই ‘বুরানে’র সামনে।
সেইদিন আমি কিছুটা উপলব্দি করেছিলাম’বুরান’টা আসলে কি? সেদিন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বুরানের পেটে বসে মহাশুন্যে উড়ে যাবার কৃত্রিম অনুভুতির- আর তার ককপিটে বসে মনে হচ্ছিল আমি একজন মহাশুন্যচারী।
বুরানের চড়ার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করার আগে আমরা অতি সংক্ষেপে (তবুও লেখাটা বড় হয়ে গেল-তাই এক পর্বে শেষ করা সম্ভবপর হল না) জেনে নিই ‘বুরানে’র ইতিহাস।
‘বুরান’যার রুশীয় অর্থ তুষার ঝড়। আশির দশকের প্রথম দিকে সোভিয়েত আর আমেরিকার মধ্যকার শীতল ঝড় যখন তুঙ্গে সেই সময়ে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে ইউ এস প্রতিরক্ষা বিভাগ পূনঃব্যাবহারযোগ্য মহাকাশ যান তৈরি করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। যেটা মুলত মিলিটারি মিশনে ব্যাবহৃত হবে।
জুন ১৯৭৪ সালে মস্কো পূনঃব্যাবহারযোগ্য মহাকাশযান নির্মানের অনুমোদন দেয়-এবং দায়িত্ব অর্পন করে Ракетно-космическая корпорация "Энергия" им রাকেটনা কসমিচেসকাইয়া কর্পোরাশিয়া ‘এনারগিয়া’- রকেট এন্ড স্পেস কর্পোরেশন ‘এনার্জি’কে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাকি জীবনে একখানই মাত্র কর্মক্ষম পুনঃব্যাবহারযোগ্য স্পেশ শাটল তৈরি করতে সক্ষম হয় –যার নাম করন করেছিল ‘বুরান’।
ইউ এস স্পেস শাটল তৈরি করা হয়েছিল তাদের দশ বছরের জীবন সীমায় যেন নুন্যতম একশবার মিশনে যেতে পারে।
সোভিয়েত নির্মিত মহাকাশযান বুরান’কে বাইরে থেকে আমেরিকান নাসার তৈরি মহাকাশযানের কপি মনে হলেও পূর্নব্যাবহারযোগ্য বুরানের নকশা ও ব্যাবহার উপযোগিতায় অনেক ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।
এটা ছিল অনেক বেশী অত্যাধুনিক জ্বালানী সাশ্রয়ী,বহন ক্ষমতা ছিল প্রায় দ্বীগুন।
মহাকাশ যানের উৎক্ষপেন ও অবতরন প্রক্রিয়াটাও ছিল নাসার উৎক্ষেপন ও অবতরন প্রক্রিয়ার থেকে অনেক বেশী উন্নতমানের।
ইউ এস স্পেস শাটল যেখানে সব্বোচ্চ পচিশ মেট্রিক টন মাল বহন করতে পারত সেখানা বুরান খুব সহজেই ত্রিশ টনের অধিক মালামাল বহন করতে পারত। ঠিক সেই ভাবেই অবতরনের সময়ও ইউ এস স্পেস শাটল পনের মেট্রিক টনের বিপরিতে বুরানের ক্ষমতা ছিল বিশ মেট্রিক টনের অধিক!
অবতরনের সময় ইউ এস স্পেস শাটল হাওয়ায় ভেসে প্যারাসুটের সাহায্যে ভুমি বা পানিতে গিয়ে আছড়ে পড়ত যা ছিল মহাকাশ যান ও মহাকাশচারিদের জন্য বেশ ঝুকিপূর্ন! কিন্তু বুরান শেষ মুহুর্তে সংযোজিত দুটো জেট ইঞ্জিনের সাহায্যে রানওয়ে দিয়ে বিমানের মত সহজেই অবতরন করতে পারত। যদিও অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে ভেবে শেষ মেষ যদিও অবতরনের এই প্রক্রিয়াটা প্রথমে বাদ দেয়া হয়েছিল।
যদিও ঠিক নাসার তৈরি স্পেস শাটল মত দুই ডানা সংযুক্ত করা বিমানের আকৃতির আদলে বুরানও অবিকল সেইরকম ছিল।
সেই সাথে তার ঠিক সামনের দিকে বিমানের ককপিটের মত জায়গায় মহাকাশচারীদের বসবার জায়গা ছিল যেটা অরবিটের অনুরুপ। ইউ এস স্পেস শাটল মহাকাশচারীদের বিশ্রামের জায়গা ছিল নীচের ডেকে বুরানে’রও তেমনি। যদিও সেটাতে সাতজনের বেশী ক্রু বহনের জায়গা ছিলনা কিন্তু বুরান সেই স্থানটা বাড়িয়ে দশজনের করা হয় যার মধ্যে চারজন উপরের ডেকে(যেখান থেকে স্পেস শাটল পরিচালনা করা হয়) এবং ছয়জন নীচের ডেকে থাকতে পারত।
বুরানের সাথে সংযুক্ত একটা যান্ত্রিক হাত যা মহাকাশযানের ভিতর থেকে কন্ট্রোল করা হয় সেইটেও হুবহু ইউ এস স্পেস শাটল এর মতনই ছিল।
ভয়ঙ্কর আলোক রস্মি ও তাপ থেকে মহাকাশ যান ও যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য ইউ এস স্পেস শাটল এর অনুরুপ শত সহস্র তাপ সুরক্ষা টাইলস ও কার্বন উপাদান দ্বারা আবৃত ছিল।
যদিও সোভিয়েতরা দাবি করেছিল যে, তাদের ব্যাবহৃত তাপ সুরক্ষা টাইলস বা thermal protection tiles নাসার ব্যাবহৃত টাইলস থেকে অনেক বেশী সুরক্ষা সম্পন্ন।
বুরানের পাশাপাশি আরো চারটে মহাকাশযান তৈরির চেষ্টা চলছিল সেই সময়ে;
যার একটার নাম ছিল'পিচকা। যেটার কাজ ৯৭ভাগ সম্পন্ন করার পর পরিত্যাক্ত হয়। অন্যটার নাম ছিল বৈকাল’যেটার কাজ ৫০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছিল। অন্যদিকে সাটল ২.০২ এর কাজ মাত্র বিশ ভাগ হয়েছিল।
অপরটা কাজের মাঝপথে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এ ছাড়াও বুরান তৈরি করার আগে বহু শত স্কেল মডেল আর ১২টার অধিক টেস্ট মডেল তৈরি করা হয়েছিল।
আশির দশকে আমেরিকা তার মহাকাশগামী যান উৎক্ষেপনের পররেই বরাবরের মত রুশীয়দের মনে জুজুর ভয় ঢুকে গেল । তাদের নিশ্চিত ধারনা হল এই মহাকাশ যান উৎক্ষেপন আদপে বড় ধরনের সামরিক হুমকি। আমেরিকা এই মহাকাশ যান দিয়ে পরমানু বোমার আক্রমনও করতে পারে।
সেই মুহুর্তে সোভিয়েত প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় সবচাইতে বেশী অগ্রাধিকার দিয়েছিল আমেরিকার মহাকাশ যানের থেকেও উন্নততর মহাকাশ যান তৈরির পরিকল্পনাতে।
বিখ্যাত রুশ মহাকাশচারী ওলেগ কোতভ বলেছিলেন,‘বুরানের নকশাটাই এমন ছিল যে, এটা মুলত যুদ্ধ ও সামরিক কাজে ব্যাবহৃত হতে পারত। এটাতে অনেক বেশী অস্ত্র বহন এমনকি পারমানবিক বোমা বহনের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছিল। ঠিক আমেরিকানদের মহাকাশ যানের অনুরুপ!’
বুরান প্রথমবার উড্ডয়ন করেছিল ১৯৮৮ সালের ১৫ই নভেম্বর । সোভিয়েত রক্ষনশীলতার কারন প্রচারনার অভাবে পৃথিবীর বেশীরভাগ লোকের যা অজানাই থেকে গিয়েছিল।
শুধু তাই নয় সোভিয়েত যুগের প্রথম স্পেস শাটল উড়ানের কোন নাম পর্যন্ত দেয়া হয়নি তখন। বুরান’কে উড়ানো হয়েছিল সোভিয়েত নির্মিত তৎকালীন সবচাইতে শক্তিশালী রকেন ইঞ্জিন এনারগিয়া বা এনার্জীর সাহায্যে।
পৃথিবীতে বুরান-ই একমাত্র মহাকাশযান যার দীর্ঘ বিশ বছররের অধিক জীবনকালে মাত্র একবার পৃথিবীর কক্ষপথ ভ্রমন করেছিল তাও নামহীন সেই ভ্রমন! শুধু তাই নয় নাসা কতৃক নির্মিত বোয়িং এক্স -৩৭ মহাকাশ বিমান যা ২২শে এপ্রিল ২০১০ সাথে মহাকাশ ভ্রমন শেষে প্রথমবার সয়ংক্রিয়ভাবে পৃথিবীতে অবতরনের আগে বুরান-ই ছিল একমাত্র মহাকাশ যান যা সম্পূর্ন সয়ংক্রিয়ভাবে অবতরন করতে পারত।
বুরানের সর্বপ্রথম মিশন ছিল মাত্র ২০৬ মিনিটের। এটা পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করার পরে ইঞ্জিনিয়াররা ৩৮০০০ তাপ নিধোরোক টাইলস এর মধ্যে শুধুমাত্র পাচটার হদিস পাননি এ ছাড়া বাকি সবকিছুই কোনরুপ ক্ষতি ছাড়া সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
বুরানের দ্বীতিয় বার উড্ডয়নের পরিকল্পনা ছিল ১৯৯৩ সালে। যেবার ১৫ থেকে বিশ দিন কক্ষপথে থাকার কথা ছিল। সোভিয়েত যুগ সমাপ্তির সাথে সাথে বুরানের উড্ডয়ন ও থেমে যায় ।
বুরান তৈরির আগে যতগুলো টেস্ট মডেল তৈরি করা হয় তার মধ্যে সম্ভবত সবচাইতে চমকপ্রদ ও আকর্ষনীয় পরিসম্পদ ছিল ওকে-জিএলআই(অক-ঝ্বিলি)। যাকে বলা হত ‘এনালগ বুরান’।
প্রায় বুরানের মতই দেখতে এই টেষ্ট মডেলটা উড়তে পারত। স্পেসক্রাফটের আদলে তৈরি এনালগ বুরান কিন্তু ঠিক মহাকাশযান নয়-এর গতি ছিল ‘মুল’বুরানের গতি থেকে অনেক কম। শক্তিশালী চারটে জেট ইঞ্জিনের সাহায্যে নভোমন্ডল ভেদ করে অনেক উপরে উঠে এর ইঞ্জিনগুলো সয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যেত আর সেটা শুন্যে ভেসে ভেসে অবতরন করত। বুরানের স্বনির্দেশকারী ও স্বয়ংক্রিয় অবতরন ব্যাবস্থা নিরাপদ করার জন্য এই টেষ্ট ড্রাইভ দারুন ভুমিকা রেখেছিল। মোট ২৫বার উড্ডয়নের পর এনালগ বুরান অবসরে যায়।
কিন্তু এই এনালগ বুরানের একটা মুল বুরানের থেকে একটা সফল ও দূভাগ্যজনক ইতিহাস আছে;
এই এনালগ বুরানটি বিক্রি করে দেয়া হয় এক অষ্ট্রেলিয়ান কোম্পানির কাছে। যারা ২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিকে সেটা প্রদর্শনের জন্য রাখে। অষ্ট্রেলিয়ান সেই কোম্পানীর আশা ছিল অস্ট্রেলিয়াতো বটেই এশিয়া ইউরোপ সহ সারা পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে এই মহাকাশযান প্রদর্শন করবে। কিন্তু কিন্তু খোদ সিডনিতেই চরম হতাশজনক টিকিট বিক্রির কারনে শেষ মেষ দেউলিয়া হয়ে যায়। শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা সেটা বিক্রি করতে চেয়েছিল কিন্তু মাত্র ছয় মিলিয়ন ডলার দর হাকার পরেও কেউ সেটা কিনতে রাজী হয়নি।
দীর্ঘ বছর দুয়েক খোলা আকাশের চরম অবহেলায় নীচে পড়ে থাকার অবশেষে বাহরাইনের এক কোম্পানী সেটা কিনে নেয়। বাহরাইনে গ্রীস্মকালীন উৎসবে সেটা প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাহরাইন ভিত্তিক সেই কোম্পানীও দেউলিয়া হয়ে পড়লে রাশিয়ান মহাকাশযান প্রস্তুতকারকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। মামলার দীর্ঘসুত্রিতার জন্য বহুদিন ধরে বাহরাইনের একটা জাঙ্কইয়ার্ড বা আবর্জনার গুদামে পড়ে ছিল।
অবশেষে এটা জার্মানীর Tech.-Museum Speyer’ নামে এক যাদুঘর কতৃপক্ষ কিনে নেয়।
(তাদের বিজ্ঞাপন ছিল এরুপ:Russian Space-Shuttle BURAN NOW permanently in Tech.-Museum Speyer’ germany). সেই যাদৃঘর কতৃপক্ষ এখন চেষ্টা করছে একটা ইউ এস স্পেস শাটল কিনে দুটোকে পাশাপাশি রেখে প্রদর্শন করার কেননা শুধু একটা কে প্রদর্শন করতে গিয়ে তারাও দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে!
আরেকখানার নাম OK-TVA (অক-তোভা)। এটাকে উড়ানো হয়েছিল ১১মে ১৯৮৭ সালে । এর উড়নটা ছিল বুরানের সত্যিকারের উড্ডয়নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সম্পূর্ন সয়ংক্রিয় ও সফল উড্ডয়ন শেষে এটা ভুমিতে নেমে আসার পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরের বছর-ই তাদের প্রথম স্পেস শাটল উড্ডয়নের পরিকল্পনা করে। সবরকম টেষ্ট ড্রাইভের পর এটাকে এনে রাখা হয় মস্কোর বিখ্যাত’পার্ক কুলতুরি’(কালচারাল পার্ক) যাকে আমরা গোর্কি পার্ক নামে চিনি সেখানটায় দর্শনীর বিনিময়ে জনসাধারনের প্রদর্শনের জন্য।
কতৃপক্ষ প্রথমে চেয়েছিল এটাকে স্পেস থিম রেস্টুরেন্ট হিসেবে চালু করবে। যেখানে দর্শনার্থীদের সেই ধরনের খাবার দেয়া হবে যা মহাশুন্যচারীরা মহাকাশে ভক্ষন করে। কিন্তু পরে সেই প্রজেক্টটা বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তিতে সেখানে কৃত্রিম মহাকাশ ভ্রমনের ব্যাবস্থা করা হয় । ত্রিশ মিনিটের সেই ভ্রমনে এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি করা হয় যাতে ভ্রমনকারীরা অনুভব করতে পারে সত্যিকারের মহাকাশ ভ্রমনের।
সামনের পর্দায় ফুটে ওঠা মহাকাশ চিত্রের সাথে সাথে যান্ত্রিক সিটগুলো এমনভাবে নাড়াচাড়া করত যে ওজনহীন অবস্থায় ঠিক অবতরন আর উড্ডয়নের অনুভুতি মিলত।
দর্শকরা চাইলে পুরো মহাকাশযানটা ঘুরে ঘুরে দেখতে পারে-এবং চাইলে ইচ্ছেমত ছবিও তুলতে পারে। এটাতে ছিল অবিকল বুরানের মত ককপিট- যেখানকার মহাশুন্যচারীর সিটে বসে নিজেকে তেমন একজন ভাবতে বাধা নেই।
একসময় যেটা ভ্রমনকারীদের জন্য চরম আকর্ষনীয় বিষয় অযত্ন অবহেলা আর মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি দিয়ে মানুষের বিনোদন এখন একরকম অসম্ভব হয়েই দাড়িয়েছে। পার্কে আসা দর্শকরা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এক সময়ের পরম আরাধ্য মানুষের সপ্নের সেই মহাকাশ যান থেকে।
আজ বুরানের এই যমজ ভাইটাও মৃত্যু প্রতিক্ষায় ধুঁকছে গোর্কি পার্কের সেই নিভৃতকোনে।
...১৪ তম পর্বের প্রথম অংশ সমাপ্ত। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।