আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যিনি সাক্ষী তিনিই বিচারক (হায়রে অভাগা দেশ)

২২শে সেপ্টেম্বরের হরতালের চিত্র। দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় পুলিশের বুটের নিচে পিষ্ট এক ব্যক্তি। তার নাম ইউসুফ আলী। অপরাধ হরতালের সমর্থনে মিছিলের চেষ্টা। পরদিন এ ছবি প্রকাশ হয়েছে সংবাদপত্রের পাতায়।

তবে এটিই এ গল্পের শেষ নয়। বহুল আলোচিত মোবাইল কোর্ট উল্টো সাজা দেয় ইউসুফ আলীকেই। এক বছর কারাদণ্ড হয় তার। সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টে ঘটনাস্থলে কোন মোবাইল কোর্টের হদিস পাওয়া যায়নি। পরে থানায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাজির হয়ে সাজা দেন ইউসুফকে।

অথচ আইন বলছে, ম্যাজিস্ট্রেট কেবল তার নিজের সামনে সংঘটিত অপরাধেরই বিচার করতে পারবেন। এ যেন যিনি সাক্ষী তিনিই বিচারক। বহুল আলোচিত মোবাইল কোর্ট অ্যাক্ট-২০০৯ এভাবে লঙ্ঘন হয়েছে আইনের অনেক মৌলিক নীতির। এ আইনটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আইনটি প্রণয়নের প্রায় দুই বছর পর এ আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ হয়েছে উচ্চ আদালতে।

গত ১৯শে অক্টোবর হাইকোর্ট এ নিয়ে জারি করে রুল। রুলে মোবাইল কোর্ট অ্যাক্টের ৫, ৬(১), ৬(২), ৬(৪), ৭, ৮(১), ৯, ১০, ১১, ১৩ এবং ১৫ ধারার বৈধতা নিয়ে সরকারের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়। এ নিয়ে রিট দায়েরকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজিম এ আইনটিকে চিহ্নিত করেছেন সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে। তার ভাষায়- মাসদার হোসেন মামলার রায়ের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে- বিচার করবেন বিচারকরা। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচার করতে পারবেন না।

অথচ মোবাইল কোর্ট অ্যাক্টে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সর্বপ্রথম নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের সেই সময় নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা পৃথক্‌করণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। মূলত তাদের সন্তুষ্টির জন্যই সে সময় অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। ২০০৯ সালে তা আইনে পরিণত হয়।

ভেজালবিরোধী অভিযানে মোবাইল কোর্টের প্রয়োগ প্রশংসিত হয়েছিল। তবে এ আইনটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মোবাইল কোর্টের ব্যবহার নিয়ে। শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আইনটির প্রয়োগের সমালোচনা করে। তবে আইনটির প্রয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এ আইনের ৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, ধারা ৫-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ধারা ১১-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় তফসিলে বর্ণিত আইনের অধীন কোন অপরাধ, যা কেবল জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য, তার সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হয়ে থাকলে তিনি উক্ত অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, দোষী সাব্যস্ত করে, এই আইনের নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করতে পারবেন।

এ আইন অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড দিতে পারেন। আইনটির এ বিধানের প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করে। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে গিয়ে সাজা দিয়ে থাকেন। যা আইনের লঙ্ঘন। এ আইনে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সাজা দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

কেউ যদি অপরাধ অস্বীকার করেন তাহলে তার অপরাধ বিচারের জন্য সাধারণ আদালতে পাঠানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের ব্যাপারে আইনে বিস্তারিত কিছু বলা নেই। পুলিশের বুটে পিষ্ট ইউসুফ আলীও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে তাই বলা হয়েছে। যা অবিশ্বাস্য। মোবাইল কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আপিল দায়েরের সুযোগ রয়েছে।

তবে আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এ আপিল দায়ের করে ভুক্তভোগীরা তেমন কোন সুবিধা পান না। কারণ ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে শাস্তি দেয়া হলে তার ওই শাস্তি পুরোপুরি বাতিলের কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে আপিলের শুনানি শেষে শাস্তির মেয়াদ হয়তো কমতে পারে। এক্ষেত্রে কথিত স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে যাদের শাস্তি দেয়া হয়, তাদের অন্তহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ স্বীকারোক্তি আদায় সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি দাবি করা হয়েছে এ আইনটি নিয়ে দায়ের করা রিটে।

সংবিধানের ৩৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ ও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু মোবাইল কোর্টে অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থন বা আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার কোন অধিকার থাকে না। ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তি এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত এর বেশি সময় আটক রাখা যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪অ(ধ) ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট মানে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।

সূএ: মানবজমিন (বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর ২০১১) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.