বিজ্ঞান হলো প্রকৃত সত্য উদঘাটনের চলমান প্রক্রিয়া, নিরেট সত্য নয়। আরবি ভাষায় দ্বীনকেই আমরা ধর্ম বলি। এই দ্বীন হল দুই প্রকার : একটি আলাহ্র দ্বীন এবং অপরটি হল মানুষের দ্বীন। আলাহ্র দ্বীন সব সময় এক, অখণ্ড এবং যাঁর দ্বিতীয় নেই। যাকে বলা হয় ‘লাসানি দ্বীন'।
তাই কোরানকে ঘোষণা করতে হয়েছে, ‘সুন্নাতালাহে লা তাবদিলা' অর্থাৎ আলাহ্র আইন কখনোই বদলায় না তথা পরিবর্তন হয় না। সুতরাং পরিবর্তনের প্রশ্নটিই অবান্তর। যাহার পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হয় অথবা ধরে নিতে হয়, উহা আলাহ্র দ্বীনের নীতির পরিবর্তন নয়, উহা হল ব্যবহারিক জীবনেপ্রয়োগ পদ্ধতির পরিবর্তন। এই পরিবর্তনকেই দ্বীনের নীতির পরিবর্তন মনে করে ধর্মবিষয়টির অবস্থা হয়ে পড়েছে লেজে গোবরে। আসলে মূলনীতি এক, একক এবং অখণ্ড বলে কোরানকে ঘোষণা করতে হয়েছে।
হজরত আদম (আ.) হতে হজরত মোহাম্মদ (আ.) পর্যন্ত যত ধর্মের আগমন হয়েছে আসলে মূলত উহা হল একটিমাত্র ধর্ম এবং সেই ধর্মের নাম হল ইসলাম ধর্ম। সুতরাং হজরত মোহাম্মদ (আ.) হতে ইসলামের শুরু হয়েছে বলে প্রচার করাটা একটা মারাত্মক ভুল এবং এই জঘন্য ভুলের জালে আমরা প্রায় অধিকাংশ আটকা পরে গেছি। একটা ডাহা মিথ্যাকে বার বার সত্যরূপে প্রচার করার ফলে তার তাছির কমবেশি সবার মধ্যে মনের অজান্তে পড়ে যায়। এমনি তো মানুষের স্বভাব হল নিজের দলের প্রতি ভালবাসার টান এবং আপন গোত্রের বাহাদুরি জাহির করতে সবাই আনন্দ পায় এবং অহঙ্কারী হয়ে উঠে, তার ওপর এ রকম বানোয়াট উপদেশবাণী পেলে তো তেলের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেবার মত। এদিক দিয়ে হিটলার সাহেবের বন্ধু গুয়েবেলসকে একজন সার্থক দার্শনিক কি বলা যায় না? কত বড় মারাত্মক জিনিয়াস ছিল গুয়েবেলস, ভাবতেও অবাক লাগে।
তাহলে মানুষের দ্বীন তথা ধর্ম কী? মানুষের দ্বীন তথা ধর্ম এক নয়, বহু তথা অগণিত। এই মানুষের অগণিত দ্বীনের ওপর “লেইজহিরাহু” তথা উহাকে জাহির করার কথাই কোরান ঘোষণা করছে। অথচ ভুল ব্যাখ্যা করা হল এই বলে যে, পূর্বের সবগুলো ধর্ম বাতিল হয়ে গেছে। হিংসার বীজ হতে যে বিষময় জঘন্য ফলের জন্ম হয় তার অনেক দৃষ্টান্ত প্রায় সবকটি ধর্মের মধ্যেই কমবেশি পাওয়া যায়। কেউ বলতে পারবে না যে, আমরা তুলসী পাতা ধোয়া একদম পবিত্র জল।
যার দরুণ মানবতার মহামিলনের জলকে আমরা সবাই ঘোলা করে ফেলছি। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (আ.) আমাদেরকে আপন অস্তিত্বের ভেতর যে রবরূপী আলাহ্ লুকিয়ে আছেন সেই শিক্ষা দেবার জন্য নিজের জীবনের একটি বেশ বড় অধ্যায়কে চোখের সামনে তুলে ধরলেন। আমরা দেখেও, জেনেও সেই চরম সেই জ্বলন্ত অধ্যায়টিকে চরম অবহেলা করে চলি। আর সেটি হল, তিনি বেশ কয়টি বছর হেরা পর্বতের মত উঁচু পর্বতের একটি নির্জন গর্তের ভেতরে বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকতেন। এই নির্জন হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকার বিরাট এবং মহামূল্যবান আদর্শটি কি আমরা অতি যতেড়বর সহিত এড়িয়ে চলছি না? কেন আমাদের মহানবী সংসার জীবনের মাঝে থেকেও হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগড়ব হলেন? এই একাকী নির্জনে ধ্যানমগড়ব হবার কারণ কী? আপন অস্তিত্বের অভ্যন্তরের রবরূপী আলাহ্র পরিচয় পাবার একাগ্র সাধনা।
এই মহামূল্যবান সাধনার কথাটি কেন জোরেসোরে প্রচার করা হয় না? কোরান কি বলেনি যে, আলাহ্কে যে বা যারা অনুসরণ করতে চায় তারা যেন মোহাম্মদকে অনুসরণ করে এবং মোহাম্মদকে অনুসরণ করাই হল আলাহ্কে অনুসরণ করা? তবে কেন হেরা পর্বতের গুহায় এই ধ্যানমগ্ন হবার সাধনার বিষয়টি অবহেলার চোখে দেখি? কিছুটা বাদ দেওয়া আর কিছুটা যোগ করে দেবার মাঝে কি মুনাফেকির পরিচয় বহন করে না? ভুল করা কি অনেক ভাল, জেনে শুনে ভণ্ডামি করার চেয়ে? তবে আমরা কি তাই করছি না? এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা-র মত বিশ্বকোষ লিখতে কয়েক হাজার জাঁদরেল অধ্যাপকের প্রয়োজন হয় এবং প্রতিটি অধ্যাপক এক একটি বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞ, আর আসমান জমিন, ফেরেস্তার জগত, রূহের জগত ইত্যাদির মহাস্রষ্টার মহাগ্রন্থ কোরআনুল করিমের তফসির করে ফেলে জলের মত হাতেগোনা ক'জন অথবা অনেক ক্ষেত্রে একজন আরবি ভাষা জানা পণ্ডিত? এ জন্যই বোধহয় আমাকে একবার অনেক আগে এক মজ্জুব, যিনি সমাজে পাগল বলে পরিচিত, তিনি বলে ছিলেন যে, কোন অলী-দরবেশ, কামেল পীর-ফকির কোরানের তফসির করে যান নি। তিনি আরো বলে ছিলেন যে, জালাল উদ্দিন রুমী মসনভী লিখেছেন কিন্তু কোরানের তফসির করে যান নি। অবশ্য এ বিষয়ের গভীরতা বুঝবার বয়স ও বুদ্ধি তখন আমার হয় নি, তাই মুচকি হেসেছিলাম মাত্র। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি যে, সেই মজ্জুবের কথা কত বড় সত্য কথা এবং কত বড় সাংঘাতিক মন্তব্য। মহানবীর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনাই হল হেরা পর্বতের গুহায় একাকী ধ্যানমগ্ন হবার সাধনা, তথা আপন অস্তিত্বের মধ্যে লুক্কায়িত পরম সত্তার পরিচয় লাভ করার সাধনা।
এই সাধনা ঘরে থেকেও ঘরের বাইরের সাধনা। এই সাধনা জনতার ভিড়ের মধ্যে থেকেও একার সাধনা। এই বৈরাগ্য ঘরকে একদম ছেড়ে নয়। ঘরে থেকেও ঘরে না থাকার মত সাধনার নামই একটি উনড়বতমানের সাধনা। এই সাধনার মাধ্যমেই তিনি জিবরিল আমিনের দর্শন লাভ করেন।
এবং কোরান নাজেলের আসল রহস্যই হল এই নির্জন সাধনা। এই সাধনা আপন অস্তিত্বের অভ্যন্তরে কী আছে তা জানার সাধনা। এই সাধনা ছাড়া কোনো কিছু লাভ করা বা অবগত হওয়া যে প্রায় অসম্ভব, সেটা তাঁর নিজের জীবনের ওপর দিয়ে আমাদের শিক্ষার একটি বিরাট মূল্যবান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন। অথচ সেই সাধনার মূল্যায়ন আমরা অনেকটা ইচ্ছা করেই করতে চাই না। যার পরিণাম হল আমাদের এই লেজে গোবরের দশা।
এই সাধনার নাম বৈরাগ্য সাধন। এই বৈরাগ্য সংসার জীবনে বাস করেও করা যায়, আবার সংসার জীবন ত্যাগ করেও করা যায়। সংসারে থাকা অথবা না থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ একান্ত ব্যক্তিগত। এখানে ‘ইহা করতেই হবে' এমন কোন শর্ত নেই। যদি কোন সম্প্রদায় জোর করে যে কোন একটিকে বাধ্যতামূলক বলে ধরে নেয়, উহা মোটেই ঠিক নয়।
কারণ উহা হল প্রবৃত্তি প্রসূত তথা মনগড়া আইন তৈরি করে জোর করে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া। এ রকম জোর খাটানো ইসলামের মধ্যে নেই। তাই সংসার জীবনে থেকেও বৈরাগ্য সাধন করা যায়, আবার সংসার ত্যাগ করেও যায়। সংসার জীবন ত্যাগ করতেই হবে এমন কথা যেমন বৈরাগ্য সাধনের প্রশেড়ব ইসলাম বলে নি, তেমনি সংসার জীবনে থেকেই বৈরাগ্য সাধন করতে হবে বলা হয় নি। দুটোর একটিকেও ‘অবশ্যই' করতে হবে বলে ইসলাম ঘোষণা করে নি।
সবার জন্য একই রকম ব্যবস্থাপত্র হতে হবে, এমন কথা ইসলামের মধ্যে যেমন হাস্যকর, তেমনি দুনিয়ার জীবনে চলার মধ্যেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাস্যকর। সুরা ফাতাহ্র আটাশ নম্বর আয়াতে আলাহ্ বলছেন, তিনি তাঁর রসুলকে পাঠিয়েছেন হেদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ সমস্ত দ্বীনের ওপর উহাদের জাহের বা প্রকাশ করার জন্য। সকল দ্বীন বলতে মানব রচিত পার্থিব আইন-কানুন বা বিধানগুলোকে বুঝায়। ব্যক্তিজীবনে এবং সমাজ জীবন পরিচালনার জন্য মানুষকে অনেক প্রকার দ্বীন তথা বিধান তৈরি করে নিতে হয়। এই সব মানুষের দ্বীনগুলো তথা বিধানগুলো আলাহ্র একমাত্র দ্বীনের তথা আলাহ্র মৌলিক সৃষ্টি বিধানের ধারার সঙ্গে যোগসূত্র না রাখলে মানুষের কর্মজীবন তৌহিদভাব হতে সরে পরে।
এই জন্যই আলাহ্র একমাত্র দ্বীনের রঙে মানবীয় দ্বীনগুলোকে রাঙিয়ে নিতে হয়। তবেই আলাহ্র দ্বীন তথা সৃষ্টির মূল কার্য ও কারণ মানবীয় সকল প্রকার দ্বীনগুলোর ওপর জাহির হয়ে যায় তথা প্রকাশ লাভ করে। মোহাম্মদি ইসলামের (আসলে ইসলাম একটিই, কিন্তু পাঠককে বুঝাবার জন্য বলতে হচ্ছে) পূর্ববর্তী ইসলাম ধর্মগুলোও মানব রচিত অগণিত দ্বীনের ওপর একই রূপে প্রকাশিত হওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। সুতরাং কোরানের এই বাক্যের দ্বারা আগের ইসলাম ধর্মগুলো, যাহা আলাহ্ কর্তৃক পাঠানো হয়েছিল, উহা বাতিল হয়ে যাবার কথা মোটেই বুঝায় না। কোরানের এই বক্তব্যের পূর্ণ সমর্থন আমরা পবিত্র বাইবেলের প্রথম খণ্ডের মথির পাঁচ অধ্যায়ের সতের নম্বর বাক্যে দেখতে পাই : হজরত ঈসা (আ.) তথা যিশুখ্রিস্ট বলছেন, ‘এই কথা মনে করিও না, আমি মুসার শরিয়ত আর নবীদের বাণী বাতিল করিতে আসিয়াছি।
আমি সেইগুলি বাতিল করিতে আসি নাই বরং পূর্ণ করিতে আসিয়াছি। ' মহানবী সংসার জীবনে বাস করেও হেরা পর্বতের সেই নির্জন গুহায় একান্ত একাকী ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন আপনার ভেতর আপনাকে চেনবার, জানবার এবং বুঝবার জন্য। ‘মোহাম্মদকে অনুসরণ করা হল আলাহ্কে অনুসরণ করা'-কোরানের এই কথা এবং উপদেশটি আমাদের প্রায় সবারই জানা আছে, অথচ এত বড় সাধনার বিষয়টির অনুসরণ করার গুরুত্ব আমরা কতটুকু দিতে পেরেছি? মনে হয় এর প্রয়োজনকে আমরা আমাদের জীবনের চলার পথ হতে বাদ দিয়ে ফেলেছি। ইচ্ছা করেই বাদ দেওয়া হয়েছে কিনা তা বলতে পারবো না, তবে বাদ যে দেওয়া হয়েছে এটা কমবেশি সবাই বুঝতে পারে। এই নির্জনতার ভেতরই কোরানের প্রথম বাণীটির আবির্ভাব।
এই নির্জনতার ভেতরই রুহুল আমিন তথা হজরত জিব্রিলের প্রথম আগমন এবং প্রথম দর্শন লাভ। অথচ এই নির্জনতার এত বড় মহান গুণগুলোর গুরুত্ব দিনে দিনে হারিয়ে ফেলেছি। এই রকম নির্জনে ধ্যানমগড়ব হবার আদর্শটি কি আমাদের ওপর অন্যান্য আদর্শের মত বর্তায় না? নিজেকে চিনতে হলে, জানতে হলে, রহস্যের পর্দা উঠাবার এতটুকু আগ্রহ থাকলে আমাদেরকে অবশ্যই নির্জনবাস করতে হবে : নির্জনে ধ্যানমগ্ন হতে না পারলে বিদ্যার একটি বড় সাগর হতে পারবো সত্যি, কিন্তু নিজেকে চেনা ও জানার প্রশেড়ব একটা পচা ডোবাও হতে পারবো না-এটা অন্ততঃ অধম লেখক হলপ করে বলতে চায় এবং ফরমান জারি করতে চায় যে, এত কিছু জানবার পরও একটি হতাশার বোবা ব্যথা নিয়ে ইহলোক হতে প্রস্থান করতে হবে। আমরা প্রায় সবাই অন্য কিছুকে জানবার আগ্রহে উৎসাহী। অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা প্রকার মন্তব্য করতে ভালবাসি।
পৃথিবীর মানুষ আর মাটি চেনার কত আগ্রহ আর উৎসাহ, কিন্তু নিজেকে চেনার কথা বললেই কেমন যেন আপসে চুপসে যাই। আর ভাল লাগতে চায় না। মনের ভেতর যে শয়তানটি লুকিয়ে আছে সে নড়াচড়া দিয়ে ওঠে এবং নানা প্রকার যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সুন্দর সুন্দর প্রমাণ হাজির করে মুখটাকে বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করে। কারণ মহানবী নিজেই বলেছেন যে, প্রতিটি মানুষের সঙ্গে একজন করে শয়তান দেয়া হয়েছে। সুতরাং সেই শয়তানের কি কোনো কাজ কর্ম নেই? আপনি আর আমি বেকার থাকতে পারি, কিন্তু আমাদের উভয়ের মাঝে যে দু'টি শয়তান দেয়া হয়েছে তারা কি তাদের ডিউটি ফেলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে? শয়তানের বুদ্ধি দেওয়া এত সূক্ষ্ম এবং সাংঘাতিক যে, মানুষ বুঝতেই পারবে না যে, সে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আছে।
অবশ্য নিজেকে চেনার প্রচণ্ড তাগিদ থাকলেও সবার পক্ষে তা অসম্ভব, বরং অতি অল্পই এই তাগিদের প্রকৃত গুরুত্ব দিয়ে থাকে; যেমন বৈজ্ঞানিক হবার উপদেশ সবাইকে দিলেও অতি সামান্যই বৈজ্ঞানিক হতে পারে। ‘ভবের নাট্যশালায় মানুষ চেনা দায়' তথা অপরকে চেনা দায়, শুনলে প্রত্যেকের মন হি হি করে হাসতে চায়। তার মানে মন সায় দেয় যে বাক্যটি একদম সত্য। কিন্তু যদি বলা হয়, ভবের নাট্যশালায় নিজেকে চেনা দায় রে, তথা খুবই কঠিন, তাহলে আপসে মনের হাসিটুকু চুপসে যায় এবং মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে। সবাই অন্যকে বুঝতে ভালবাসে, কিন্তু নিজকে চেনার কথা অল্পই ভাবে।
কেন অল্প লোকে নিজেকে চেনার কথা ভাবে এই কথারও সুন্দর রহস্য আছে। কিন্তু ইহার ব্যাখ্যা লেখার মত স্বাধীনতা অধম লেখকের নেই। এবং এরপরেও যদি পাঠককে বুঝবার জন্য কিছু লেখতে যাই তবে সঙ্গে সঙ্গে বইটি বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা শুনতে হবে। কারণ ইহা উপন্যাস, নাটক অথবা ছোট গল্প লেখা নয়, বরং ইহা ধর্ম বিষয়ের ওপর আলোচনা। এখানে অধম লেখক অনেকটা কৃষকের বানানো, মুখে মুখোশ লাগানো, গরুর মতো : ফসলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও মুখ লাগাবার স্বাধীনতা নেই।
কেবল চোখে দেখেই যেতে হবে, কিন্তু মুখ দিয়ে চেখে দেখার কোন উপায় নেই। আমরা যদি একটু ভাবি তাহলেই পরিষ্কার বুঝতে পারবো যে, বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত প্রতিটি জিনিস আমাদের উপকারে আসে (অবশ্য মারণাস্ত্র নয়)। কিন্তু সেই আবিষ্কৃত জিনিসগুলো নিজেকে চেনার জন্য কতটুকু সহায়ক? হয়তো অনেক ক্ষেত্রে অনেক, আবার হয়তো অনেক কম। প্রতিটি বৈজ্ঞানিকের দানকে মানবজাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে এবং করা উচিত; কিন্তু সেই বৈজ্ঞানিকেরাও নিজেকে চেনার সাধনার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। কারণ, এটাই ছিল তাদের তকদিরের লেখা।
তকদিরে যতটুকু পৃথিবীকে দেবার ছিল ঠিক ততটুকু একজন বৈজ্ঞানিক দিতে পেরেছে এবং এর চেয়ে একচুলও এগিয়ে যাবার ক্ষমতা কোন বৈজ্ঞানিকের নেই। জন্মচμের ঘূর্ণায়মান মঞ্চের বিভিনড়ব নাটকের বিভিনড়ব চরিত্রের বিশেষণ করার এক একটা অপূর্ব ভঙ্গিই কেবল। এই চরিত্রের ভঙ্গিগুলো কি চক্রাকারে ঘুরছে না অন্য কিছু? চক্রাকারে ঘোরার নামই কি পুনর্জন্ম? তবে কি এই পুনর্জন্মের কথা কোরানের পাতায় পাতায় আছে? না একদম নেই? কোনটার কথা কোরান বলছে? অধম লেখক জানলেও তা বলবে না। কারণ, প্রচলিত শরিয়তের আইনকে একান্ত বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হবে। কম্পিউটার আপনাকে অনেক রকম নতুন নতুন হিসেব দিতে পারবে এবং আরো অত্যাধুনিক হিসাব ভবিষ্যতে দিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
রোবট আজ আধুনিক কারখানার জটিল কাজগুলো অপূর্ব নৈপুণ্যে সমাধা করে দিচ্ছে, যা একটা রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে সময় সাপেক্ষ এবং এ রকমভাবে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি খণ্ডিত ক্ষেত্রে প্রতিভাত হয়ে চলছে এবং চলবে। কিন্তু এই চরম আধুনিক বিজ্ঞান তো দূরে থাক, চরমতম আধুনিক বিজ্ঞানও কি পারবে কোনো দিন নিজেকে চেনার মেশিন বা যন্ত্র আবিষ্কার করতে? যদি পারে তবে ধন্য এই বিজ্ঞানকে। আর যদি না পারে তাহলে বলার কিছু নেই। কারণ, এই বিষয়টির প্রশ্নে বিজ্ঞান কোনদিন পারে কিনা তা প্রায় সন্দেহজনক বলেই অধম লেখকের মনে হয়। যদিও মনেপ্রাণে দোয়া করি যে, অচিরেই যেন অধম লেখকের সন্দেহটি একদম বরবাদে পরিণত হয় এবং ধর্মের নামে নানা প্রকার উদ্ভট মতবাদগুলো আপনা আপনি আগুনের ধোঁয়া বাতাসে মিলিয়ে যাবার মতো মিশে যায়।
হজরত আদম (আ.) হতে হজরত মোহাম্মদ (আ.) পর্যন্ত একটিমাত্র ধর্ম প্রচারিত হয়েছে। সেই একটিমাত্র ইসলাম ধর্মের মূল এবং একটিমাত্র কথাটি হল নিজেকে চেনা। যুগের চাহিদা অনুযায়ী কেবল শরিয়তেরই পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন সাধিত হয়েছে, কিন্তু মূলনীতির পরিবর্তনের প্রশ্নই অবান্তর। কারণ, আমরা দেখতে পাই, কোরান পূর্ববর্তী নবীদের সালাত কায়েমের উপদেশ দিয়েছেন। সুতরাং মহানবীর আগের নবীদের সালাত কায়েমের প্রয়োগগুলো এক একজন নবীর এক এক রকম, কিন্তু মূল বিষয় ও বক্তব্য মাত্র একটি, তথা আলাহ্র সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করা, তথা সালাত কায়েম করা, তথা ফারসি ভাষায় যাকে নামাজ আদায় করা বুঝায়।
যখন নিজেকে চেনা হয়ে যায় তখন আলাহ্কেও চেনা হয়ে যায়। একথা ঘোষণা করতে গিয়ে ইসলাম একটি শব্দ ব্যবহার করছে এবং সেই শব্দটি হল ‘ফাকাদ', অর্থাৎ কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই, অবশ্য অবশ্যই। অর্থাৎ নিজেকে চেনার অপর নামই হল আলাহ্কে চেনা। একটি বিষয় লক্ষ করার মতো আর তা হল, এখানে আলাহ্কে চেনার আহ্বান না জানিয়ে নিজেকে চেনার আহ্বান জানানো হয়েছে। নিজেকে চিনতে পারলেই সব কিছুর সমাধান হয়ে গেল।
এমনকি যে স্রষ্টাকে জানার একটা আকাঙ্ক্ষা কমবেশি মানুষের মনে উদয় হয়, সেই আকাঙ্ক্ষাটিও পূর্ণ হয়ে গেল বলা হয়েছে। আলাহ্ থাকলেই বা আমাদের কী লাভ হবে, আর না থাকলেই বা আমাদের কী ক্ষতি হবে-ঐ বিষয়টির প্রশ্নে যুক্তিতর্ক, দার্শনিক মতবাদের নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে স্থূল মনের বিকারগ্রস্ততাই প্রকাশ পাবে এবং এই বিকারের হা-হুতাশ দার্শনিকদের দর্শন পড়লেই পরিষ্কার বুঝা যায়। তাই ইসলাম এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে বরং নিজেকে চেনার ও জানবার আহ্বান করেছে। এবং এই একটি মাত্র বিষয়ের মধ্যেই সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণার চির অবসান হবার কথাও বলা হয়েছে। অবশ্য দার্শনিকদেরও দোষ দিতে চাই না, কারণ চিন্তার বিভিন্নতা এবং জটিলতা না থাকলে এ রকম উপদেশ দেবার সার্থকতাও থাকে না।
রোগ আছে বলেই বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসার নিয়ম-কানুন চালু দেখতে পাই, কিন্তু রোগ না থাকলে কি চিকিৎসার প্রয়োজন হতো? অভাব আছে বলেই তো সমস্যা, পাপ আছে বলেই তো ত্রাণ পাবার উপদেশগুলোর এত দাম। নিজেকে চেনার প্রশ্ন উঠলে নির্জনবাস করতেই হবে। তা ঘরে থেকে হোক অথবা ঘরে না থেকে হোক সেই প্রশ্নটি মুখ্য নয়। মুখ্য হল নির্জনবাস করতেই হবে এবং সেই শিক্ষা মহানবী তাঁর নিজের জীবনের ওপর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন হেরা পর্বতের গুহায় একাকী নির্জনবাসের ধ্যানমগ্ন সাধনার মাধ্যমে। আপনি যদি এ রকম সাধনাকে অস্বীকার করতে চান তাতে কারো কিছু বলার নেই; কারণ, সাধনা করা না- করার স্বাধীনতা আপনাকে দেয়া হয়েছে এবং এই স্বাধীনতার সময়সীমা মৃত্যু নামক ঘটনা পর্যন্ত।
উপদেশ দেবার তাগিদ থাকতে পারে, কিন্তু উপদেশ গ্রহণ করা না-করার ইচ্ছাটি একান্ত ব্যক্তিগত। অর্থাৎ, উপদেশ গ্রহণ করতেই হবে, এ রকম শক্তি খাটানোর আদেশ বিশেষ করে এই বিষয়টিতে নেই, বরং এই বিষয়টিকে গ্রহণ করা অথবা বর্জনের আছে প্রত্যেকের পূর্ণ স্বাধীনতা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।