"বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংস্কৃতির জন্য অপমানজনক কোনকিছু এই ব্লগে লেখা যাবে না। "শিহরণে সত্তায় তুমি, হে আমার জন্মভূমি" এক একটা বয়স থাকে তখন মানুষের ব্যতিক্রম কিছু করার ইচ্ছা থাকে। চুরি করে আঁচার খেলেও তখন মানুষ বিরাট ঘটনা ঘটাতে পেরেছে বলে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দেয়। ক্লাস টেনে উঠে যাওয়াটা স্কুল জীবনে মনে হয় সবচাইতে বড় প্রাপ্তি। নিজেকে কেমন বড় বড় লাগে।
মনে হতে থাকে এবার আর অন্য কারো কথা নয় নিজের যা মন চায় তাই বুঝি করার এক্তিয়ার আমাদের হাতে এলো বলে!
মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ২১, ১৯৯৩। আমাদের ক্লাস টেন ও শেষ। টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। নতুন ফর্মেটে পরীার ফরম পূরণ হবে। এই ফরমের নাম ”ওএমআর”, গোল্লা পূরণ করে নাম লিখতে হয়।
ভুল করার কোন সুযোগ নেই। তাই একটা ট্রেনিং কাসের দিন ধার্য করা হয়েছে এই ২১.১২.৯৩ মঙ্গলবারে। আমরা কাসের লিডার টাইপের জিনিস। আমাদের কি এসব ট্রেনিং কাসে যাওয়া সাজে! তার উপর এইদিন আমাদের এক বান্ধবীর জন্মদিন। কাজে কাজেই আমরা প্ল্যান করলাম স্কুলের নাম করে ঠিকই বের হওয়া হবে।
কিন্তু যাওয়া হবে অন্য কোথাও অন্য কোনখানে।
আমাদের তখন ৬জনের গ্রুপ। তার মাঝে দুজন ভীষণ আপত্তি জানালো, তারা যেতে চায় না। ভুজুং ভাজুং দিয়ে ঐ দুজনকে আমরা রাজি করে ফেললাম। ঢাকা শহরে এত এত বছর থাকি আমরা, কেউ ম্মৃতিসৌধ দেখতে যাইনি।
আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের জায়গা ঠিক হলো সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ। কথা মতো মীরপুর এক নম্বর বাসস্ট্যান্ডে একে একে সবাই জড়ো হলাম। দুটা বেবী ট্যাক্সিতে ৩জন ৩জন করে উঠলাম। মনের ভেতর শংকা তো আছেই, এই প্রথম বাসায় বড় মাপের কোন মিথ্যা বলা সবার। তবু নিয়ম ভাঙ্গার খুশি আমাদের মনে আনন্দের বুদবুদ জড়ো করেই চলেছে।
এক সময় পৌঁছে গেলাম স্মৃতিসৌধ এলাকায়। না এখনো গেট খুলেনি। কি আর করা যাবে! আমরা আশপাশের এলাকায় হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম। এক মহিলা মাটির চুলাতে রান্না করছে। আমরা জোর করে তার সাথে ছবি তুললাম।
সবাই আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখছে। ছ’টা ১৫ বছর বয়সী মেয়ে সাথে কোন অভিভাবক ছাড়া ঘুরছে ব্যাপারটা খুব একটা সহজে মেনে নেয়ার ব্যাপার তখন ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে খুব পানির পিপাসা পেল। এক বাসায় কলিং বেল চাপলাম আমরা নির্ভয়ে। আমাদেরকে হাসতে হাসতেই সেই বাসা থেকে পানি খেতে দিল।
এবার সময় হলো স্মৃতিসৌধ তে প্রবেশের। দেখলাম। সামনের পানিতে যে ছায়া পড়ে স্মৃতিসৌধের তা বারবার ঘুরে ঘুরে দেখলাম, প্রথম যখন কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়েছিলাম তখন সেই স্কুল থেকে আমি একবার এখানে এসেছিলাম আমার মনে পড়লো। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পানির রং দেখতে থাকলাম। কারণ আমার মনে হচ্ছিলো সেই শিশু বয়সে আমি এখানে সবুজ পানি দেখেছিলাম।
আমাদের কাছে জায়গাটা খুব একটা ছোট মনে হলো না। কত রকমের ফুল! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখলাম। নির্মাণ শৈলী নিয়ে আমাদের বিস্ময়ের শেষ নেই। টিভিতে যা দেখি খবরের আগে সেটা একটা মিনিয়েচার ছাড়া আর কিছুই না। অনেক দর্শনার্থী দেখলাম জুতা নিয়ে একদম উপরে উঠে যাচ্ছে।
আমরা সেটা করলাম না, জুতা খুলেই উঠলাম। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শান্তির পরিবেশটা কেমন মিইয়ে যেতে থাকলো। ২-৪টা ছবি উঠানোর পর আমরা গাছের ছায়ায় গিয়ে বসলাম। দুপুরে কোথায় খাওয়া যায় এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। কাছেই পর্যটনের রেস্টুরেন্ট আছে।
আমরা ঠিক করলাম সেখানেই লাঞ্চ সারব।
পর্যটনের রেস্টুরেন্ট যে এমন গলা কাটা এবং ভয়ংকর রান্নার হবে তা আমাদের জানা থাকার কোনই কারণ নেই। আমরা ধরা খেলাম। শুধু বাসায় ফেরার ভাড়াটুকু বাঁচিয়ে কোনমতে বিল দিয়ে আমরা সম্মান হাতে নিয়ে বের হলাম। ও মা, সাভারে কিসের যেন মেলা হচ্ছে...মনের ভয় মনে চেপে মেলা দেখলাম খানিকক্ষণ।
তারপর আবার বেবীট্যাক্সি দুটাতে ৬জন।
প্রথম ট্যাক্সির পেছন পেছন দ্বিতীয় ট্যাক্সি। কিছুক্ষণ পরে দেখি পেছনের ট্যাক্সি আর আসছে না। আমরা থামলাম, বাকী বান্ধবীদের কি হয়েছে বুঝতে। ২০মিনিট পর সেই ট্যাক্সি এলো আমাদের কাছে।
জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছিলো - ওদের পুলিশ আটকেছিলো কারণ আজকেই ৩টা মেয়ে কোথা থেকে যেন পালিয়েছে, ওরাও ট্যাক্সিতে ৩জন থাকাতে সন্দেহবশত ওদের আটকেছে। আমাদের ভয়ের ষোল এর উপর দুই আঠারো কলা পূর্ণ হবার উপক্রম।
আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে মীরপুর এক নম্বর বাসস্ট্যান্ডে তো পৌঁছলাম। বাসায় সবার জন্য দারুণ সারপ্রইজ অপেক্ষা করছিলো সেটা কি আর আমরা জানি! এতবছরের স্কুল জীবনে যা হয়নি তাই ঘটেছে। স্কুল থেকে বাসায় সবার ফোন গিয়েছে।
আমরা যে ফরম পূরণের অনুশীলন ক্লাসে যাইনি তা বাসায় জানাজানি হয়ে গিয়েছে এবং যারা অনুশীলন ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল তাদেরকে ২২.১২.৯৩ তে ফরম পূরণ করতে দেয়া হবে না। অনুপস্থিত সবার ফরম পূরণ হবে ২৬.১২.৯৩ তে তাও হেড স্যার সফদার আলীর তত্ত্বাবধানে।
২১ তারিখ শুধু আমরা ৬জন নই, অনেক ছেলেও অনুপস্থিত ছিল। কারণ তখন সাফ গেমস চলছে এবং ২১ তারিখে মেয়েদের মীরপুরের সুইমিং পুলে প্রতিযোগীতা ছিল। সেই প্রতিযোগীতা বিনা টিকিটে দেখা যায়।
আমাদের স্কুলের ছেলেরা বিনা টিকিটে সুইমিং কস্টিউম পরিহিতা নারীদের দেখতে দল বেঁধে গিয়েছিলো এবং ওরাও দল বেঁধে ধরা।
একদিনের একটা মিথ্যা বাসায় আমাদের সবার গ্রহণযোগ্যতা নামিয়ে আনলো একনিমিষেই। ২২,২৩,২৪,২৫ চারটা দিন আমাদের অপরাধবোধ না দিলো ঘুমাতে, খেতে, না পড়া লেখা করতে। ২৬ তারিখে স্মৃতিসৌধ মাথায় রেখে গেলাম ফরম ফিলাপে। ছেলেদের সারি করে পেটানো হচ্ছে।
তারপরে আমাদের পালা। হঠাত আমরা সবাই থমকে গেলাম। কারণ পাপ্পু নামে আমাদের এক ক্লাস মেট ঢুকেছে রুমে এবং সে হেড স্যারের হাতে ধরা। আমাদের বোধবুদ্ধিহীন চেতনায় শুনতে পেলাম ”কিস্ কি এখন পশ্চাতদেশে খায় না কি?” সবাই হতভম্ব অবস্থা কাটিয়ে পাপ্পুর দিকে তাকালাম, সে পরে এসেছে একট জিন্স এবং সেই প্যান্টের পকেটের উপর লিখা ”কিস্ মি”। হেড স্যার হাত মুঠি করে পাপ্পুর সেই পকেটের উপর ঘুষি দিলেন এবং আবার বললেন এত শক্ত জায়গায় কিভাবে কিস্ করা যাবে!
হেড স্যারের পিটানো পর্ব এভাবেই শেষ হয়ে গেল।
আমাদের কাছ পর্যন্ত বেত ঘুরে আর এলো না। আমরা এসএসসি পরীক্ষা দেবার যোগ্যতা অর্জন করলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।