আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আহলে হাদীসদের জঘণ্য মিথ্যাচারঃ পর্ব - ০১, বুকে হাত বাঁধা সংক্রান্ত একটি হাদীস ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা

বুকের উপর হাত বাঁধা প্রমাণ করতে গিয়ে আমাদের আহলে হাদীস ভাইয়েরা যেসব রেওয়ায়েতের সহযোগিতা নিয়ে থাকেন, তার মধ্য থেকে এখানে একটি রেওয়ায়েত সম্পর্কে আলোচনা করছি। মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইলের রেওয়ায়েত তাঁর বিবরণ অনুযায়ী সুফিয়ান ছাওরী রাহ., আসেম ইবনে কুলাইব থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে নামায পড়লাম ... তিনি তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর বুকের উপর রাখলেন। সনদসহ রেওয়ায়েতটির আরবী পাঠ এই- أخبرنا أبو طاهر، نا أبو بكر، نا أبو موسى، نا مؤمل، نا سفيان، عن عاصم بن كليب، عن أبيه، عن وائل بن حجر قال : صليت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم، ووضع يده اليمنى على يده اليسرى على صدره. -সহীহ ইবনে খুযায়মা ১/২৭২, হাদীস : ৪৭৯ আলোচনাঃ মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইলের পূর্ণ বিবরণ সঠিক নয়। হাদীস শাস্ত্রের নীতি অনুসারে এ বর্ণনায় على صدره ‘বুকের উপর’ কথাটা ‘মুনকার’। অর্থাৎ সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর বর্ণনায় তা ছিল না।

মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইল ভুলক্রমে তা বাড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ সুফিয়ান ছাওরী রাহ. থেকে এই হাদীস ১। মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ ফিরয়াবী ও ২। আবদুল্লাহ ইবনুল ওয়ালীদ রাহ.ও বর্ণনা করেছেন। তাঁরা দু’জনই ছিকা ও শক্তিশালী রাবী।

তাঁদের রেওয়ায়েতে على صدره ‘বুকের উপর’ কথাটা নেই। দেখুন : মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৮; আলমুজামুল কাবীর তবারানী ২২/৩৩ রেওয়ায়েত দুটির সনদসহ আরবী পাঠ নিম্নরূপ : قال الإمام أحمد : حدثنا عبد الله بن الوليد، حدثني سفيان، عن عاصم بن كليب عن أبيه عن وائل بن حجر قال : ... ورأيته ممسكا بيمينه على شماله في الصلاة ... وقال الإمام الطبراني : حدثنا عبد الله بن محمد بن سعيد بن أبي مريم ثنا محمد بن يوسف الفريابي ثنا سفيان عن عاصم بن كليب عن أبيه عن وائل بن حجر قال : رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يضع يده اليمنى على اليسرى وإذا جلس افترش رجله اليسرى ... قال الراقم : ومحمد بن يوسف الفريابي ذكره المزي في الرواة عن الثوري وابن عيينة كلهيما إلا أنه يستظهر برواية الدارقطني أنه الثوري. ففي إتحاف المهرة 13/662 تحت حديث : سمعت النبي صلى الله عليه وسلم إذا قال غير المغضوب عليهم ولا الضالين قال آمين، يمد بها صوته : قط في الصلاة ... وعن يحي بن صاعد، عن ابن زنجوية، عن الفريابي، عن الثوري، عن سلمة، نحوه. أي عن حجر أبي العنبس عن وائل بن حجر. وقد ذكرهما صاحب أنيس الساري 10/335 في الرواة عن الثوري. رقم الحاشية : (1) এটা শুধু পাওয়া যায় মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইল রাহ.-এর বর্ণনায়, যাঁর সম্পর্কে জারহ-তাদীলের ইমামদের সিদ্ধান্ত এই যে, তিনি সাধারণভাবে বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী হলেও রেওয়ায়েতের ক্ষেত্রে তাঁর প্রচুর ভুল হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি শেষ জীবনে এসে প্রচুর ভুল করেছেন যখন তাঁকে তাঁর স্মৃতি থেকে রেওয়ায়েত বলতে বলা হত, কারণ তাঁর কিতাবগুলো পুড়ে গিয়েছিল। এমনকি ইমাম বুখারী রাহ. তাকে ‘মুনকাররুল হাদীস’ বলেছেন। আর তিনি এও বলেছেন যাকে আমি মুনকারুল হাদীস বলেছি, তার কাছে থেকে হাদীস বর্ণনা করা যাবে না।

(মিজান আল ইতিদাল ১/১১৯) তিনি তাঁর কিতাব “আল মীযান ” এ উল্লেখ করেছেন, তাঁর(মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইল রাহ.) হাদীস বর্জনীয়। আবু হাতিম (রহঃ) বলেন, তিনি সুদুক, কিন্তু প্রচুর পরিমাণে ভুল করেছেন। আবু যুরাহ (রহঃ) বলেন, তার রেওয়ায়েত প্রচুর পরিমাণে ভুলে ভরা। ইমাম তাহাবী (রহঃ) বলেন,তিনি সাদুক, কিন্তু প্রচুর পরিমাণে ভুল করেছেন। ইবনে সাদ বলেন, তিনি সিকাহ, কিন্তু প্রচুর পরিমাণে ভুল করেছেন।

ইয়াকুব বিন সুফিয়ান বলেন, তিনি অনেক মুনকার হাদীস বর্ণনা করেছেন, তবে তাকে আমাদের ক্ষমা করা উচিত। সাজি বলেন, তিনি অতিরিক্ত ভুল করেছেন, তিনি সুদুক, কিন্তু প্রচুর পরিমাণে ভুল করেছেন। তার ভুল এতই বেশি যে তা উল্লেখ করতে প্রচুর সময় লাগবে। মুহাম্মদ বিন নাসর আল মারওয়াজী বলেন, তিনি প্রচুর পরিমাণে ভুল করেছেন। (তাহযীব আল তাদ্গীব) ইমামগণের মন্তব্য নীচে উল্লেখ করা হল- قال البخاري : منكر الحديث، وقال أبو حاتم الرازي : صدوق شديد في السنة كثير الخطأ، يكتب حديثه، وقال أبو زرعة الرازي : في حديثه خطأ كثير، وقال ابن سعد : ثقة كثير الغلط، وقال الساجي : صدوق، كثير الخطأ وله أوهام يطول ذكرها. وقال الدارقطني : ثقة كثير الخطأ. দেখুন : তাহযীবুল কামাল ১৮/৫২৬; তাযীবুত তাহযীব ১০/৩৪০; মীযানুল ইতিদাল ৮৯৪৯; আলমুগনী ফী যুআফা ৬৫৪৭ শায়খ আলবানীও সিলসিলাতুয যয়ীফার অনেক জায়গায় তাঁকে জয়ীফ বলেছেন এবং তাঁর সম্পর্কে ইমামগণের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন।

দেখুন : সিলসিলাতুয যয়ীফা ১/১৩১; ২/২৪৬, ৩/১৭৯; ৩/২২৭; ৪/৪৫৫ ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত : সুফিয়ান ছাওরী রাহ. ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর বিবরণ বর্ণনা করেছেন আসিম ইবনে কুলাইব থেকে। আসিম ইবনে কুলাইব থেকে এই হাদীস আরো বর্ণনা করেছেন : ১. শোবা ইবনুল হাজ্জাজ, ২. বিশর ইবনুল মুফাদ্দাল ৩. কায়স ইবনুর রাবী ৪. যাইদা ইবনে কুদামা ৫. আবদুল ওয়াহিদ ইবনে যিয়াদ ৬. খালিদ ইবনু আবদিল্লাহ ৭. আবু ইসহাক ৮. আবুল আহওয়াস ৯. আবদুল্লাহ ইবনে ইদরীস, ১০. মুসা ইবনে আবী আয়েশা ১১.আবু আওয়ানা প্রমুখ হাদীসের বিখ্যাত ইমাম ও ছিকা রাবীগণ। তাঁরা সকলে আসিম ইবনে কুলাইব থেকে নামাযে হাত বাঁধার হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কেউ على صدره ‘বুকের উপর’ কথাটা বর্ণনা করেননি।

এঁদের রেওয়ায়েতগুলোর জন্য দেখুন যথাক্রমে : ১. মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৯, হাদীস : ১৮৮৭৮ ২. সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৭২৬; সুনানে নাসায়ী, কুবরা, হাদীস : ১১৮৯; মুজতাবা, হাদীস : ১২৬৫; মুসনাদে বাযযার-আলবাহরুয যাখখার, হাদীস : ৪৪৮৫; আলমু’জামুল কাবীর তবারানী ২২/৩৭ ৩. আলমুজামুল কাবীর, তবারানী ২২/৩৩ ৪. মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৮; আলমুজামুল কাবীর ২২/৩৫ ৫. মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৬ ৬. সুনানে কুবরা বায়হাকী ২/১৩১ ৭. আলমুজামুল আওসাত তবারানী ২/৪২৩ ৮. মুসনাদে আবু দাউদ ত্বয়ালিসী ২/৩৫৮, হাদীস : ১১১৩; আলমুজামুল কাবীর তাবারানী ২২/৩৪ ৯. সহীহ ইবনে হিববান ৫/২৭১; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৩/৩১৭ ১০. মুসনাদে বাযযার আলবাহরুয যাখখার, হাদীস : ৪৪৮৯ ১১. মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার বায়হাকী ৩/৫০ এ থেকে বোঝা যায়, আসিম ইবনে কুলাইব বুকের উপর হাত বাঁধার কথা বর্ণনা করেননি। তাহলে সুফিয়ান ছাওরীর সঠিক বর্ণনায় তা কীভাবে থাকতে পারে? তো এই সকল ইমাম ও ছিকা রাবীর বর্ণনার সাথে তুলনা করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, এ হাদীসে على صدره অংশটা মুনকার তথা অগ্রহণযোগ্য। হাফেজ ইবনে হাজার (রহঃ) তাঁর “ফাতহুল বারী” কিতাবে নিশ্চিত করেছেন যে, সুফিয়ান ছাওরী থেকে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইল রাহ. এর সনদটি দুর্বল। (ফাতহুল বারী ২০৬) তাছাড়াও সবচেয়ে বড় আরেকটি বিষয় হচ্ছে এই সনদের মূল রাবীদের একজন সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) নিজেই নাভীর নিচে হাত বাঁধার পক্ষে মত দিয়েছেন। (ইবনে কদামাহ, আল মুগনী ২/২৩) সুতরাং যেহেতু এই রেওয়ায়েতটি তার মতামতের বিরুদ্ধে যায়, তাই বিচারের নীতির মাধ্যমে এটিকে গ্রহণ করা যায় না।

তাছাড়া ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে যেসব রাবী এই হাদীস বর্ণনা করেন, তারা কুফার বাসিন্দা ছিলেন এবং কুফার লোকদের এই আমল ছিল যে, তারা নাভীর নিচে হাত বাঁধতেন। উল্লেখ্য, কুলাইব ইবনে শিহাব ছাড়া অন্যদের সূত্রেও ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর এই হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনো সহীহ সনদে على صدره ‘বুকের উপর’ কথাটা পাওয়া যায় না। দেখুন : বুগয়াতুল আলমায়ী ফী তাখরীজিয যায়লায়ী, নসবুর রায়াহর হাশিয়ায় ১/৩১৬ ইবনে আল কাইয়িম আল জাওযিয়াহ ইলাম আল মুওয়াক্কিয়ীন এ বলেন, মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইল ব্যতীত অন্য কেউই বুকের উপর কথাটি বলেনি। ( ই’লাম আল মুওয়াক্কিয়ীনঃ ২/৩৬১ ) ইমাম নববী তার তা’লীক আল হাসানে এ বলে উপসংহার টানেন যে,অতিরিক্ত শব্দ “ বুকের উপর ” যুক্ত হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.