জব্বার হোসেন
http://www.shaptahikkagoj.com
লেখাটি মিডিয়াওয়াচেই লিখেছিলাম। প্রায় মাস ছয়-সাত আগে। শিরোনাম ছিলÑ ‘বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশেষ সংখ্যার মলাটে মেয়েরা। ’ অনেকটা অপ্রয়োজনীয়ভাবে কেন কীভাবে মেয়েদের পত্রিকার প্রচ্ছদে আনা হয়, ব্যবহার করা হয় তার একটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। শুধু বাণিজ্যিক কারণে, পুরুষ পাঠকদের চাহিদা মেটাবার জন্য যে তা করা হয়, তা নয়, কখনো কখনো সম্পাদকদের ব্যক্তিগত বিলাস এবং বিকৃতি ও যে কাজ করে এর নেপথ্যেÑএ কথাটিও জোর দিয়ে, সততার সঙ্গে, নিশ্চিত হয়ে বলেছিলাম।
তুমুল আলোড়ন তৈরি হয় লেখাটি প্রকাশিত হলে। প্রশংসা কুড়োই পাঠকের কিন্তু নিন্দে করতে, রীতিমতো গালমন্দ করতে ছাড়েননি সম্পাদকদের অনেকেই। একজন সম্পাদক আমাকে রীতিমতো কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করেন। বলেন, তুমি সুস্থ চিন্তা করতে পারো না। অসুস্থ, বিকারগ্রস্ত।
তুমি কী করে এসব ভাবতে পারো! জঘন্য তোমার রুচিবোধ!
আমি কিছুই বলিনি, চুপ করে থাকি। বলিনি এ কারণে যে আমার লেখাটিই তো বরং সম্পাদকদের রুচিহীনতা ও বিকৃতির প্রামাণ্য। কী দরকার প্রতিবাদ করবার। আমার লেখাটি কি নষ্ট পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিবাদেই যথেষ্ট নয়?
তিনি হয়তো ক্রোধ ও উত্তেজনায় লক্ষই করেননি যে, আমি ‘কখনো কখনো’ লিখেছি, ‘কারো কারো’ কথা বলেছি; সকলের কথা অবশ্যই নয় সেটা। সকলকে ঢালাওভাবে দায়ী করা ও উদ্দেশ্য নয় আমার।
খুব সম্প্রতি একজন পত্রিকা সম্পাদকের একটি গোপন ভিডিও প্রকাশিত হয়। ভিডিওটি সম্পাদকের অফিসকক্ষে এক তরুণীকে যৌন হয়রানির। পাক্ষিক আনন্দধারার সম্পাদক তিনি। অরুণ চৌধুরী, যিনি একই সঙ্গে সম্পাদক, নাট্যকার, নাট্যনির্মাতা। বলা যায়, খ্যাতিমান একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তিনি।
তার মতো একজন নামজাদা সম্পাদকের এমন যৌন হয়রানির ভিডিওচিত্র আমার ‘বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশেষ সংখ্যার মলাটে মেয়েরা’ লেখাটিকে বোধ হয় আরও বেশি যৌক্তিক করে তোলে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নানাভাবে পণ্য হয় মেয়েরা কিংবা তাদের পণ্য করে তোলা হয় নানাভাবে। চারপাশে পুরুষদের যে ফাঁদ, তাতে পা না দিয়ে উপায় নেই মেয়েদের। আসলে একজন সম্পাদক যদি ‘বিকৃত পুরুষ’ মানসিকতার হন, অনৈতিক সুযোগ খোঁজেন, পত্রিকাকে ব্যবহার করেন তার নোংরা স্বভাব চরিতার্থে, তবে গণমাধ্যমের জন্য তা দুর্যোগই বটে।
আমি বিশ্বাস করি উদারতায়, মুক্তচিন্তার মানুষ আমি।
পর্নো ভিডিও সারা দুনিয়া জুড়েই আছে। সেখানে লোকে অভিনয় করে। উপার্জন করে। সেটি অন্য প্রসঙ্গ। সেটির নৈতিকতা-অনৈতিকতা, পর্নো ভিডিওর বাজার, পুঁজির বাণিজ্যÑসেসব ভিন্ন প্রসঙ্গ।
কিন্তু একজন খ্যাতিমান সম্পাদক, মিডিয়াকর্মী তার অফিসকক্ষে যখন একজন তরুণীকে যৌন হয়রানির গোপন ভিডিও প্রকাশিত হয়, তখন বিষয়টি মিডিয়ার জন্য উদ্বেগ ও হতাশার। অন্ধকার ও আশাহীনতার। তিনি যদি কাউকে মিডিয়ায় কাজের সুযোগ দেবেন এই শর্ত কিংবা আশ্বাসে তাকে ব্যক্তিগতভাবে পণ্যের মতো ব্যবহার করেন, যৌন হয়রানি করেন, তবে এর চেয়ে বেদনা আর হতাশার আর কী থাকতে পারে! এমন ঘটনা এই মিডিয়ায় হরহামেশাই পুরুষ কর্তৃক ঘটে বলে নানাজনের অভিযোগ রয়েছে।
ব্যক্তিগত একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আমি আরও সহজে বুঝতে ও বোঝাতে চাই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগ থেকে আমি রচনা কৌশলে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছি।
আমার যে সহপাঠী মেয়ে বন্ধুরা ছিল, তারা পরবর্তী জীবনে কেউই আর যুক্ত থাকেনি নাটকের সঙ্গে। কেউ চাকরি করছে ব্যাংকে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ বহুজাতিক কোম্পানিতে। এই মেধাবী মেয়েগুলো নাটকের সঙ্গে, কালচারাল মিডিয়ার সঙ্গে নেই কেন? প্রশ্নটি আমারও। আমি না-হয় ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির সঙ্গে, গবেষণাধর্মী কাজের সঙ্গে, পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তারাÑযারা অভিনয় নিয়ে, নাট্যনির্দেশনা নিয়ে এত দিন পড়াশোনা করল, তারা কেন নেই? তাদের উত্তরটি খুব স্বাভাবিকÑলোকে ভালোভাবে নেয় না, দেখে না।
এখানে লোকের ধারণা, মেয়েদের সুযোগ দেওয়া হয়, সুযোগ নিয়ে। কী ভয়াবহ! এখনো লোকে নাটকের সঙ্গে আরেকটি শব্দ জুড়ে দেয়। বলে নাটক-ফাটক! লোকের শ্রদ্ধা নেই, সম্মান নেই সামাজিকভাবে। এখনো লোকে মনে করে একধরনের অনৈতিকতার বিষয় রয়েছে এর আড়ালে-আবডালে। অরুণ চৌধুরীদের যৌন হয়রানির ভিডিও এই বিশ্বাসকে, সামাজিক সম্মানহীনতাকে, অনাস্থাকে আরও দৃঢ় করে, উসকে দেয়।
ফলে সহজ কথায় অরুণ চৌধুরীদের রুচি ও বিকৃতি পুরো মিডিয়ার জন্যই ভয়ংকর ক্ষতি।
আমাদের মিডিয়া পুরুষ। তার আচরণটি স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক। যখন প্রভা ভিকটিম হয়, তখন সিরিজ নিউজ হয়। ‘চৈতির নগ্ন ভিডিও বাজারে’ এমন খবর দেয় দৈনিকগুলো।
ভিডিওগুলোর স্থায়িত্ব রগরগে বর্ণনা কোনো কিছুই বাদ যায় না। কেবল মেয়েদের নাম আসে। ভিডিও ক্লিপগুলোও ফাইল করা হয় প্রভা, চৈতিÑএমন নামে। ছেলেদের নাম নেই, আসে না, থাকে না। স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের একটি পর্নো ভিডিও বাজারে আসার পর তা কেবল চৈতির ভিডিও বলে প্রচার দেয় মিডিয়া।
প্রভা-চৈতিরা মিডিয়া থেকে হারিয়ে যায়। নির্ঝরদের হয় না কিছুই। অরুণ চৌধুরীর এই অফিসকক্ষে যৌন হয়রানির ভিডিও ফুটেজটিরও নাম দেওয়া হয়েছে বিন্দু নামে একটি মেয়ের নামে!
আমরা বড় অদ্ভুত সমাজে বাস করি। অত্যাচারিতের পাশে না দাঁড়িয়ে, দাঁড়াই অত্যাচারীর পাশে, যাতে তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে নিজেরাও অত্যাচার করতে পারি আরেকবার।
এই লেখাটি লেখার অন্তত ন্যূনতম সাত দিন আগে অরুণ চৌধুরীর যৌন হয়রানির ভিডিওটি প্রকাশিত হয়েছে, পৌঁছে গেছে ই-মেইল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশ থেকে দেশের বাইরে।
অথচ আমাদের মিডিয়া নিশ্চুুপ। গণমাধ্যমকর্মীদের মুখে রা নেই। এখন আর আমরা ‘গাজী গাজী’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ছি না। আমাদের হাত বাঁধা, মুখে কুলুপ, চোখ অন্ধ। আমাদের সুশীল সমাজ ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদেরও জিভে ফোঁড়াÑএই হলো অবস্থা!
অরুণ চৌধুরী পুরুষ।
পুঁজি ও ক্ষমতা তার দখলে। তিনি সম্পাদক, মিডিয়া তার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে। এই তো বিষয়, এই তো সমাজ আমাদের! কী ভয়াবহ! ভাবা যায় অরুণ চৌধুরী না হয়ে এই জায়গায় কোনো মেয়ে হলে কী হতো! কী বীভৎস নোংরা বর্ণনাই না লিখতেন আমাদের মহান সাংবাদিকেরা। অথচ এই লেখাটি লিখবার সময় পর্যন্ত মিডিয়া নিশ্চুপ একেবারে, যেন কেউ কিছু জানে না!
আনন্দধারা পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় মিডিয়া ওয়ার্ল্ড থেকে। মিডিয়া ওয়ার্ল্ড দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া গ্র“পের একটি।
তারা অরুণ চৌধুরী আর আনন্দধারার সঙ্গে নেই এমন শিরোনামে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানাই এমন সিদ্ধান্তের জন্য। কিন্তু কেন অরুণ চৌধুরী নেই, কী কারণে নেই, তা কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেননি। বরং অরুণ চৌধুরীর নৈতিকতার স্খলনটি প্রকাশ করলে, জানালে অন্য আরও অনেকে হয়তো নিজেদের সুধরে নিতে পারত। এমন অসভ্য ও পাশবিক আচরণ থেকে বিরত থাকত নিদেনপক্ষে অফিসকক্ষে!
আমরা সত্যকে আড়াল করি।
লুকোই, ভান-ভণিতা বেশি আমাদের। সামাজিক অসুস্থতা স্থায়িত্বের এটাও তো একটি যথার্থ কারণ বটে।
পুনশ্চ: লেখাটি যখন লিখছি তখন কেবল একটি কথাই বারবার আন্দোলিত করছে আমাকে। একজন সম্পাদক অরুণ চৌধুরীর কথা জানলাম আমরা, জানলাম যৌন হয়রানির গোপন ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে বলে। আরও অনেক অরুণ চৌধুরী আছে আমাদের চারপাশে, যাদের কথা এখনো জানি না।
তাদের এমন ভিডিওচিত্র এখনো প্রকাশিত হয়নি বলে।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
সাপ্তাহিক কাগজ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।