আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ রুমানা এখন এইটিন। (Rumana is now 18)

"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “চিলতে রোদে পাখনা ডোবায়,মুচকি হাসে শহরতলী রোজ সকাল পড়ছে মনে, এই কথাটা কেমনে বলি?” ছাদের উপরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে অর্ণবের গান শুনছিলাম। এই গানটা শুনলে ডুবে যাই অতীতে। একটি মেয়ে এসে বারে বারে বিদ্ধ করে যায়। ভালোবাসার ভর্তুকি দিচ্ছি আরকি। প্রতি বিকেলে ছাদে উপরে হাটাহাটি আর গান শুনে সময় পার করা।

বিকেলগুলো খুব মিষ্টি হয় কিন্তু গোধূলি বেলায় আবার কষ্ট ছরিয়ে দিয়ে যায়। অপেক্ষায় থাকতে হয় পরের দিনের বিকেলের জন্য। আজ অর্ণবের এই গানটা রেনডমলি শুনেই যাচ্ছি। গানের কথাগুলো এতটা মিলে যায় ভাবিনি কখনো, “চোখ দুটো খুব পড়ছে মনে এই কথাটা কেমনে বলি?” “এই যে শুনছেন?” মেয়েলী একটা কন্ঠে চমকে পেছনে ফিরে তাকালাম। ব্ল্যাক থ্রি কোয়ার্টার আর পিঙ্ক টি-শার্ট পড়া একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বয়স কত হবে? এই পনেরো বছরের আশেপাশে। গোলগাল ভরা গালের গোলাপি ঠোঁটের ছিমছাম একটি মেয়ে। চোখে আবার কাজল পড়েছে। এতটুক মেয়ে সাহস করে ডেকেছে দেখে কিছুটা অবাক হলাম, বেশী অবাক হলাম মেয়েটা সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুরিয়ে বললাম, -হাই - হ্যালো, আমি রুমানা।

চারতলার বামপাশের ফ্ল্যাটে নতুন এসেছি আমরা। আপনি কি এই এপার্টমেন্টে থাকেন? - হুম। - ও আচ্ছা, তাহলে তো আমরা প্রতিবেশী, আমাদের পরিচয় হওয়া দরকার তাইনা? - হুম মনে হয় দরকার। - হুম দরকার মানে? অবশ্যই দরকার, আমার নাম তো বললাম, এবার অসুবিধা না থাকলে আপনার নাম বলুন। - আমি রিক।

- ওয়াও কি সুন্দর নাম। আমার নামের সাথে মিল আছে। - ও তাই তোমার নাম কি? - অদ্ভুত! আপনার ধ্যান কোনদিকে? আমি বললাম না আমার নাম রুমানা। - ওহ রুমানা, তা তোমার সাথে আমার নামের মিল কথায় পেলে রুমানা? - কোথায় পেলাম মানে কি? আপনার নাম ইংরেজি আর দিয়ে শুরু আমার নামও। - তাইতো! খুব ভালো।

- আমরা যেহেতু প্রতিবেশী তাই আমাদের একে অপরকে ভালো ভাবে জানতে হবে। এবার বলুন আপনি আমার সম্পর্কে কি জানতে চান? - তেমন তো কিছু জানার নেই, আচ্ছা তুমি কোন স্কুলে পড়ো? - আমাকে দেখে কি বাচ্চা মেয়ে মনে হয় নাকি? আমি সেভেনটিন, আর কিছুদিন পরেই এইটিন হয়ে যাব। আমি টুয়েলভে পড়ছি। আপনার সম্পর্কে বলুন এবার। - সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আজ যেতে হবে আরেকদিন নাহয় আমার কথা বলবো।

মাগরিবের আজান পরেছে। হাটা শুরু করলাম সিঁড়ির দিকে। ভাবলাম এসব বাচ্চা মেয়ে ইমোশনাল বেশী হয়। এড়িয়ে চলাই ভালো। পরের দিন আবার ছাদে রুমানার সাথে দেখা।

“গতকাল এভাবে পালিয়ে গেলেন কেন? মেয়েদের সাথে কথা বলতে ভয় পান নাকি?” অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, এই বাচ্চা মেয়ে কি বলে এসব। শুধু বললাম, “ভয় পাওয়ার কি আছে রুমানা? তুমি না আমার প্রতিবেশী। “ “ও আচ্ছা, আমার নাম মনে রাখতে পেরেছেন তাহলে? আজ আপনার সম্পর্কে বলুন, আপনাকে জানতে ইচ্ছে করছে খুব। “ বুঝলাম এই মেয়ে এত সহজে ছারবে না। “ আমি এম বি এ করলাম।

আপাতত বেকার। একটা আইটি ফার্ম করার ইচ্ছে আছে। এক ভাই এক বোন, আমি বড়। “ এরপরে রুমানা যা বললো তাতে আমার চোখ ছানাবড়া। মেয়ে বলে,”আমি এসব জানতে চেয়েছি নাকি? আমি জানতে চেয়েছি আপনি কারো সাথে প্রেম টেম করছেন কি না?” এই মেয়ে কিভাবে সরাসরি এসব কথা বলে ভেবে পাইনা।

শুধু বললাম,”আমি এসব রিলেশনে বিশ্বাস করি না। ” শব্দ করে হেসে ফেললো রুমানা। এমন ভাব যে আমি পৃথিবীর সব থেকে বোকা ছেলে। অবশ্য যে কেউ ভাবতেই পারে, কারন আমি নিজেই নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোকা ভাবি। সেদিনের মত কোনভাবে পালিয়ে বাঁচলাম ওর হাত থেকে।

এভাবে প্রায় প্রতিদিন বিকেলে কথা হতে থাকে রুমানার সাথে। আমি ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে ভেবেই কথা বলতাম, তাছারা চুপচাপ জীবনে ওর সাথে কথা শেয়ার করেও ভালই লাগতো। রুমানার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছি, ওর বাবা বড় ব্যাবসায়ী মা একটা ব্যাংকে জব করছেন। দুজনে নিজ নিজ প্রফেশন নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় রুমানা তাদের কাছে খুব কম সময় পেয়েছে। সেজন্য একটু গল্প করতে ছুটে আসে ছাদে।

প্রায় তিন মাস পেরিয়ে যায় এভাবে। এরই মাঝে আমার নিজের ফার্মের প্ল্যানিং নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে যাই। বুয়েটের নাকিব ভাই আর আমি মিলে একটা স্ট্রাকচার দাড় করানো নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরি। চারদিন ছাদে যাওয়া হয়নি। পঞ্চম দিনে যখন ছাদে উঠে দেখলাম রুমানা উদাস নয়নে দূরে তাকিয়ে আছে।

আমিও রেলিংয়ে হাত রেখে তাকিয়ে রইলাম দূরে। মিনিট দশেক নীরবতার পরে রুমানা এসে পাশে দাঁড়িয়ে ভীষণ মাত্রার বিরক্তি চোখে নিয়ে বললো,”রিক তুমি এমন কেন? এই চারদিন কোথায় ছিলে তুমি? আর এখন এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো, আমার সাথে কি কথা বলতে ভালো লাগেনা তোমার?” হা করে তাকিয়ে রইলাম। এ কেমন মেয়ে? চারদিন দেখা নেই তাই আপনি থেকে তুমি তাছারা আজ আবার আমার নাম ধরে সম্বোধন করছে। বুঝলাম এই মেয়ে পুরাই গেছে। আবার বলতে শুরু করলো রুমানা,” তুমি এই চারদিন আসোনি, আমি প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত তোমাকে ফিল করেছি।

আমি তোমাকে না দেখে তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবো না। অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো। “ বুঝলাম সারাদিন স্টারপ্লাস দেখে এই মেয়ের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,”দেখো রুমানা, তুমি এখনো অনেক ছোট।

তাই আবেগ সংবরন করতে পারছো না। এখনো তোমার এইটিন হয়নি। আরেকটু বড় হও,তুমি তখন ভালোবাসা কি বুঝতে পারবে। তাছারা এখন আমি তোমার দুচোখে তো দুটো বড় বড় অক্ষিগোলক ছারা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না” বলেই হাসতে শুরু করলাম। অভিমানে এবার কেঁদেই ফেললো রুমানা।

অভিমানি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি এখনো এইটিন না এটা কি আমার দোষ? আমি তোমাকে লাভ করি, এইটিন না হলে কি লাভ করা যাবে না? আমি সাড়ে নয়মাস পরে এইটিন হবো সেদিন তোমার সামনে আসবো। এর আগে আর তোমার সাথে দেখাই করবো না। “ দৌড়ে চলে গেলো রুমানা। এরপরে প্রায় প্রতিদিনি ছাদে উঠা হতো। কিন্তু পাগলী মেয়েটিকে আর দেখলাম না।

ভাবলাম তেমন কিছু না, নয়মাস এই মেয়ে থাকবে কি করে? হঠাত দেখা যাবে চলে আসবে। কিন্তু রুমানা আর ছাদে আসেনি। এতদিন ওর সাথে এত কথা শেয়ার করেছি যে ওর অভাববোধটা হারে হারে টের পাচ্ছিলাম। ওর দুষ্ট মিষ্টি সৃতিগুলো বারে বারে মনে পড়তো। বুঝতে পারলাম অতীত সৃতিগুলো রুমানা মুছে দিয়েছিল।

এরপরে আমি ওকে মিস করা শুরু করলাম। অনেক কথা জমে গেছে। রুমানাকে না বলে হালকা হতে পারছিলাম না। বুঝলাম পাগলী মেয়েটা সত্যই অনেক অভিমানী। এরই মাঝে আমার ফার্মের কাজ অনেকটাই প্রায় শেষ।

দিলকুশায় মামার অফিসের একটা সাইড পেয়েছি। নিজের মত করে ছোট পরিসরে সাজিয়ে নিলাম আমার ছোট খাটো অফিস। এখন শুধু ভালো কিছু ভার্সিটির ছেলে মেয়ে রিক্রুট করতে হবে আর ক্লায়েন্ট ধরতে হবে। ব্যাস্ততার মাঝেও মনে পড়ে যেতো রুমানার কথা। আমিও দিন গুনে যাচ্ছিলাম রুমানা কবে এইটিন হবে।

একসময় বুঝতে পারলাম রুমানাকে ছারা আমার চলবে না। এই মেয়ে নতুন করে এসে আমার একাকীত্ব দূর করেছে আর আমি ওকে একা করে রেখেছি। একই এপার্টমেন্টে থাকা স্বত্বেও কি অদ্ভুত আমার সাথে ওর দেখা হতো না। তিনমাস পরে একদিন জানতে পারলাম রুমানার বাবা তার এই ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে বাড়িধারায় অন্য ফ্ল্যাটে চলে গেছে। একটু অবাক হলাম আমি।

রুমানা আমাকে না জানিয়ে চলে গেলো? এমন তো হওয়ার কথা না। যাইহোক, নিজেকে মানিয়ে নিলাম, অফিসে কাজে নিজেকে ব্যাস্ত করে নিলাম। আমার ফার্মে ক্লায়েন্ট বাড়তে শুরু করলো। একসময় অফিস আর বড় করলাম। রুমানার সৃতি ততদিনে ভুলিনি।

প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে যখন ছাদে উঠে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়াতাম, ভাবতাম এই বুঝি পেছন থেকে ডাকবে রুমানা। চোখেচোখ রেখে কথা বলবে। কিন্তু না, অভিমানী মেয়েটি আর আসতো না, আসবেই বা কেন? আমিতো ওকে কোন আশা দেইনি। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। এসব ছোট ছোট সৃতি ভুলে যাওয়াই ভালো।

এতটুক বাচ্চা মেয়ে হয়ত এসব ভুলে বসেছে। একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেলো। বাসার দরজায় নক করতেই ছোট বোন দরজা খুলে মিটমিট হাসি শুরু করলো। বুঝলাম নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে বাসায়, নইলে ও এমন রহস্যের হাসি হাসে না। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম কাহিনী কি? ভিলেন মার্কা হাসি দিয়ে বললো,”ভাইয়া তুই বিয়ে করেছিস সেটা আমাদের জানাস নাই কেন? তোর রুমে যেয়ে দেখ ভাবি বাসায় চলে আসছে।

” ভাবলাম দুষ্টামি করছে কিন্তু আমার রুমে ঢুকে পারলে ভিমড়ি খাই। আমার মা আর রুমানা বসে গল্প করছে। শাড়ি পরেছে রুমানা। ম্যাচ করে চুড়ি, টিপ কানের দুল। এ আমি কি দেখছি! আগের সেই বাচ্চা মেয়ে একয়দিনে এত বড় হয়ে গেলো কিভাবে? মা আমাকে ঘরে রেখে বাইরে চলে গেলো।

রুমানা উঠে এসে আমার চোখে তাকিয়ে বললো, “ দেখো, আমি আজকে এইটিন হয়েছি, তোমাকে বলেছিলাম এইটিন না হওয়ার আগে আসবো না। আজকে চলে এলাম। এবার বলো আমাকে লাভ করবা কি না?” কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমিতো সত্যিই প্রেমে পরে গেছি। ওর চোখে তাকিয়ে বললাম,”হ্যাপি বার্থডে রুমানা।

” এই উইশ হয়ত আশা করেনি, অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। বুঝলাম কেন এই অভিমান। ঘুরে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,”লাভ ইউ পিচ্চি। ” পুরাই স্টারপ্লাসের কাজ কারবার। আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলো।

পেছন থেকে দেখি আমার ছোট বোন খিলখিল করে হাসছে। রাতে রুমানাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে যেয়ে জানলাম আসল ঘটনা। রুমানারা এখান থেকে চলে যাওয়ার পরে নিয়মিত আমার মায়ের সাথে যোগাযোগ করতো ও। এভাবেই আমার মায়ের সাথে সখ্যতা করে নেয়। আমার মা পছন্দ করে রুমানা কে।

দুজনে মিলে প্ল্যান করে এই দিনে আমাকে চমকে দেয়ার জন্যে। মা নিজে যেয়ে রুমানার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে বাসায় নিয়ে আসে ওকে। তাছারা আমার মা স্টারপ্লাসের দারুন ভক্ত। কাহানি ঘার ঘার কি। উৎসর্গঃ প্রথম কেউ যে আমার কোন গল্পে নায়িকার ভূমিকায় নিজেকে কিংবা নিজের নাম দেখতে চেয়েছিলেন।

কুমুদিনি মেডিকেল কলেজের ছাত্রী লেখিকা রুমানা ফেরদৌস । তিনি ব্লগার ক্ষনিকের আগন্তকের “ভালোবাসা এবং কিছু আবেগের গল্প” নামের ফেসবুক ফ্যানপেজে নিয়মিত গল্প লিখেন। অর্নবের গানটির ডাউনলোড লিংক।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।