আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রিয়তমেষু

আমিই সেই জন, যাকে খুঁজিয়াছ অকারন... আজ বাসে ঐ গন্ধটা পেয়েছিলাম। অনেকদিন পর পেলাম গন্ধটা- তোমার কাছাকাছি হলে হুট করে বুকে এসে লাগে যে গন্ধটা। মৃদু আর মিষ্টি। হয়ত কোন পারফিউমের গন্ধ। যে পারফিউমটা তুমিও ব্যবহার কর।

বা মেয়েটাও করে। অথবা অন্যকিছুর। জানি না ঠিক। আমি শুধু গন্ধটা জানি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম।

কি দেখছিলাম ঠিক খেয়াল নেই। হয়ত দেখছিলাম কোন মধ্যবয়সীর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শব্দ তুলে চা খাওয়ার দৃশ্য। বা কোন মুদির দোকানের অলস চালের বস্তা। বা হয়ত কিছুই না; অস্পষ্টচোখে তাকিয়ে থাকা। কিংবা হয়ত ভাবছিলাম অনেকদিন গল্প লেখা হয় না; এইসেই।

অথবা কিছুই না। শূন্যভাবনা। আর ঠিক সেসময় গন্ধটা নাকে এসে লাগল। বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। যদিও জানি তুমি এখন অনেক অনেকদূর।

এই মধ্যদুপুরে বনশ্রীতে তোমার কোন কাজ নেই। তবুও আমি চারিদিক দেখে নিলাম একবার। না কেউ নেই। প্রচন্ড গ্রীষ্মদিনে পুড়তে পুড়তেও 'বৃষ্টি হতে পারে' এই বিশ্বাসের দুঃসাহসটা মনে আশা জাগায়। আশাভঙ্গের বেদনা নিশ্চিত জেনেও মানুষ আশাবাদী হয়।

ক্ষেত্রবিশেষে মানুষ বড্ড বোকা। মেয়েটা বসেছিল আমার ঠিক সামনের সিটেই। মসৃন চুলগুলো দেখতে ঠিক তোমার চুলের মতই। পিঠে ছড়ানো। আর মসৃন।

মেয়েটা তুমি হলে ভাল হত। কারন সেই মুহূর্তে চুলগুলো খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছিল আমার। কিন্তু সবাইতো আর চুল ছুঁতে দেয় না। একজনই দেয় শুধু। পরেরবার যখন দেখা হবে তোমার চুলগুলো হয়ত ছুঁয়ে দেখব।

বা হয়ত ছোঁব না। দীর্ঘদিনের বিরহে ভুলেই যাব যে একদিন তোমার চুল ছুঁতে চেয়েছিলাম। তার পাশেই ছেলেটা বসে ছিল। মেয়েটির প্রেমিক হয়ত। মুখে একচিলতে হাসি ফুটে আছে।

সকাল ঘাসে চিকচিক করা শিশিরের মত। ছেলেটার চোখে চশমা। আর কাচের ওপাশে থাকা চোখগুলো যে কি নিদারুন সুখের চিহ্ন ধরে রেখেছিল তা যদি দেখতে। ছেলেটাকে দেখে আমার আমার কথা মনে পড়ে যায়। বেশ কিছুদিন আগের আমি।

অথবা কল্পনায় ভাসি কিছুদিন পরের আমি'র হাত ধরে। ছেলেটা কিছু একটা বলল। দুজন হেসে উঠে। আর মেয়েটা 'তার মানুষটা'র কাঁধে মাথা রাখে আলতোস্পর্শে। তারা কি হাত ধরে ছিল? হয়তবা।

প্রকৃতির নিয়ম তেমনই। আমার খুব হিংসা হিংসা লাগছিল। চিনচিনে একটা ব্যথা নিয়ে বসে ছিলাম। মানুষ এত সুখী হয় কেন? আর হলে সবাই হয় না কেন? বুকের ভেতর কিছু একটা বেজে যায়। ভায়োলিন সম্ভবত।

কষ্ট কষ্ট সুর। বুকজাত একটা দীর্ঘশ্বাস যাত্রা করে অনন্তের দিকে। হয়ত তোমাকে ছোঁবে বলে। তুমি কি সেদিন কোন অতিকরুন দীর্ঘশ্বাসের স্পর্শ পেয়েছিলে? পেয়ে থাকলে জেনো সেটা আমার ছিল। পূর্বপরিচিত গন্ধটা নাকে আসছিল মুহুমুহু।

মৃদু আর মিষ্টি। আর তুমিশূন্যতার আগুনে ক্ষনে ক্ষনে উস্কানি। হাতের মাঝে একটা হাতের স্পর্শের অভাবটা মনে ভীষন আকুতি জানাচ্ছিল অবুঝের মত। আর বুকটা প্রচন্ডধরনের এক শুন্যতা নিয়ে জেগে থাকে। ভীড়ের মাঝেও যে এমন নিঃসীম একাকিত্ব বোধ করা যায় জানা ছিল না আমার।

চোখ জ্বালা করে। ঢাকার বাতাসটা যে দিন দিন আরো বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে সে খবর রাখো? জানালা দিয়ে অনেকদূর তাকিয়ে থাকি। নাইলে কে আবার কি ভাবে। নিঃসঙ্গতার অভিশাপের বিপরীতে পুরনো স্মৃতিগুলো এগিয়ে আসে। আমাদের দ্বিতীয় দেখার কথা মনে পড়ে তোমার? আমি চুপচাপ।

তুমিও চুপ। সবাই চুপ। কবরের নীরবতা সাক্ষী রেখে পাশাপাশি বসে ছিলাম আমরা। যদিও স্থানটা কোন গোরস্থান ছিল না। সঙ্কোচেরা আমাকে ঘিরে ছিল।

আর ইতস্ততরা কাঁদছিল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। কিছু একটা বলতে গিয়েও কি বলব বুঝে উঠতে না পেরে চুপ করে যাই আবার। কেউ একজন আবার উপদেশ দিয়ে দিয়েছিল আসার আগে। 'খবরদার উল্টা-পাল্টা কিছু বলিস না। কিছু বলার আগে মনে মনে কমপক্ষে সাতবার ভেবে নিবি।

' মনে মনে কয়বার ভেবেছি গুনতে গুনতে কি ভেবেছিলাম সেটাই ভুলে বসি। আমার আর কিছু বলা হয়ে ওঠে না। প্রবল তৃষ্ণা পুষে বসে ছিলাম। চোখে-বুকে তৃষ্ণা। কি সর্বগ্রাসী আর জ্বলন্ত।

রবিবাবু হয়ত এমন কোন সময়ই ভেবেছিলেন, 'চক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে। আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন, সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে। ' কিন্তু সেই দুর্যোগমুহূর্তে পানি পাওয়ার সম্ভবনা শূন্যের ঘরে ছিল। তাই চুপ করে থাকি এক বুক তৃষ্ণা আর আড়ষ্টতা নিয়ে। নিরুপায়।

তুমি কি মনে মনে একচোট হেসেছিলে? হয়তবা। স্বাভাবিক। 'এতদূরে বসে আছ কেন?' শুনতে পেলেও বুঝে উঠতে পারি না কি বলা হয়েছে। আস্তে আস্তে শব্দরা পরিষ্কার হয়। শীতের সকালে বেলা বাড়ার সাথে সাথে কুয়াশার আস্তরন যেভাবে পাতলা থেকে হালকাতর হয় ঠিক তেমনি করে।

আর শিশিরেরা শুকাতে থাকে ঘাসের বুক থেকে। চোরের মত কাচুমাচু ভঙ্গিতে সরে আসি খানিকটা। প্রায় সাথে সাথে হালকা একটা গন্ধের তীব্রস্পর্শবোধ করি। এই গন্ধটা। স্নিগ্ধ আর সুস্পষ্ট।

লোভীর মত নিঃশ্বাস নিই খুব গোপনে। কিছু একটা বলা দরকার। কি বলব সাতবার ভেবেও ঠিক করতে পারিনা। শুধুই অবৈধ নিঃশ্বাসের বিকিকিনি। 'আরেকটু কাছে আসতে পারছ না?' মনে মনে চমকে উঠি।

আসলেই তো। আরো অনেকটা কাছেতো যাওয়াই যায়। কতবড় হাদা আমি। নিজের বোকামীতে নিজেই লজ্জা পাই। তবে এইবার আর ভুল হয় না।

কিন্তু ভুল হয়ে যায় অন্যকোথাও। কিছু একটা গড়বড় হয়ে যায় বুকের ভেতর। অনবরত ড্রাম পেটানোর আওয়াজ তুলে তুলে বুকটা কাঁপতে থাকে হালকা হালকা। ছোটবেলায় স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টসের আগে যেভাবে বেজে যেত ড্রামগুলো। ঢিম ঢিম ঢিমঢিমঢিম।

ভয় হচ্ছিল। তুমি আবার শুনে ফেল কিনা। বিরাট লজ্জার ব্যাপার হবে তাহলে। তোমার গা ঘেষে বসে ছিলাম অন্যদিকে তাকিয়ে। যেন দু'টি অবলা প্রানী।

চারিদিকে শুনশান নীরবতারা এখানে সেখানে হেলান দিয়ে দিয়ে দাঁত খিলাল করছিল। আর আমি জেগে রইলাম একবুক ড্রাম নিয়ে। তারা বেজেই চলল। বেজেই চলল গগনবিদারী শব্দ মুখে। এইভাবে চলতে থাকলে যেকোন সময় তোমার কানে ড্রামধ্বনি টোকা মারতে পারে- এই সন্দেহে আমিই নীরবতা ভাঙ্গি।

'তোমার হাতটা কি একটু দেওয়া যায়?' বলেই দ্বিতীয়বারের মত চমকে উঠলাম। আমি কখনোই এই কথাটা বলতে চাইনি। কোনভাবেই না। কিন্তু ততক্ষনে তীরটা ধনুকছাড়া হয়ে গেছে। আবার খানিকক্ষনের অস্থিরতা মেশানো নীরবতা।

'কেন? তুমি নিতে পারছ না?' এবার আর কোন চমকাচমকি না। পাশের মানবীর হাতটা ধরে তড়িতগ্রস্ত হয়ে বলে ফেললাম 'ভালোবাসি'। চাপা হাসির শব্দে তোমার পাশ থেকে ছিটকে আসি। বাসটা জ্যামে আটকে আছে। আর আমার সামনে কিছু সুখ।

একজীবনের জন্য যথেষ্ঠ। সুখ নাকি দেখা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। বিশ্বাস কর আমি সেদিন সুখ দেখেছিলাম। আর অনুভবে একগুচ্ছ থকথকে হালকা নীল বিষন্নতা।

হালকা গন্ধটা বাতাসের ঝাপটায় আবার বিদ্রুপ ছোঁড়ে। আর আমি ডুবে ডুবে যেতে থাকি। বাস্তব থেকে অতীতে। অতঃপর স্মৃতিশহরে। আপনস্বত্তা বিলীন হতে চায় আপনতরস্পর্শের অতীততায়।

এক চিলতে হাসি, মন্থর রিকশা, পাশাপাশি, হালকা রোদ। আজীবনের অভিশাপপুষ্ট জ্যামের প্রতি নিখাদ কৃতজ্ঞতা। আর কালো চাদরটা, নাছোড়বান্দা টোকাইদল। আমি ডুবতে থাকি। আটলান্টিকের অতলতায়।

অসহায় ভীষন। কতক্ষন ডুবে ছিলাম জানিনা। দ্বিতীয়বারের মত বাস্তবতায় পা পিছলে আছাড় খাই শান্তিনগরের ময়লার ডিপোর নিষ্ঠুরতায়। শুনেছোতো বোধহয় ঢাকা শহরের ময়লার ডিপোগুলো ইদানীং ভীষন নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। আর আমি অনৈতিক স্পর্শে হারিয়ে ফেলি অসত্য ছোঁয়াটুকু।

পরিচিত গন্ধটা হারিয়ে যায় অদূর থেকে অদূরবর্তী হয়ে। অনেক চেষ্টাতেও আর মুঠোবন্দী হয় না। এই হারানোটা বুকে বাজে তুমিশূন্যতাটার চেয়েও খানিক গাঢ় হয়ে। আমার স্টপেজ চলে এসেছিল। নতুন এক স্তর বিষন্নতা নিয়ে উঠে দাঁড়াই।

আর গুমোট বাতাসে অযত্নে তুলে রাখি কিছু আনকোরা দীর্ঘশ্বাস। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।