আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রস্তাবিত নারীনীতি ২০১১: আমাদের ধর্মব্যবসায়ীরা এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ....

আমি দামি কেউ নই যে কিছু লিখতে হবে। বাংলাদেশের মানুষদের নাগরি-জীবনের ভালো জিনিসের দেখা খুব কমই পাওয়া যায়। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে অল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা দু’টি যুগান্তকারী নীতিমাল পেয়েছি যেটি সত্যিকার অর্থেই ইতিবাচক। একটি হচ্ছে শিক্ষানীতি (যদি এটি বাস্তবায়ন-সম্ভাবনা বাংলাদেশের মতো গরীব দেশের জন্য কতটুকু বস্তবসম্মত সে প্রশ্ন নিতান্ত অমূলক নয়) আর একটি হচ্ছে প্রস্তাবিত নারীনীতি ২০১১। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে এ দু’টি বিষয় নিয়ে কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো যারা নারীনীতি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন তাঁদের অনেকেই এ নারীনীতিটি পড়ে দেখেন নি। টিভি কিছু টক শোতে আলোচকদের আলোচনা শুনে বুঝলান তাঁরা এটি না-পড়েই গলা ফাটাচ্ছেন। যেমন কয়েকদিন আগে একজন মহিলা আইনজীবি অনেক যুক্তি তর্ক দিয়ে বুঝাতে চাইলেন নারীকে কেনো উত্তারাধিকার-সম্পদের সম অধিকার দেওয়া উচিত। অথচ প্রস্তাবিত নারীনীতি ২০১১ এর কোথাও নারীকে পিতা-মাতার সম্পত্তির সমান অংশ দেওয়া কথা নেই। আর ইসলামিক আইন বাস্তবায়ন কমিঠির একজন সদস্যও নারীনীতি ঠিক কোন ধারাটি ইসলাম-বিরোধী সেটি নির্দিষ্ট করে বলতে পারলেন না।

অনেক টক শো শোনে এবং পত্র-পত্রিকা পড়ে যেটুকু বুঝলাম তাতে মনে হলো নীতিমালা নির্দিষ্ট করে দুটি ধারাকে ইসলাম-বিরোধী বলে বিরোধিতা করা হচ্ছে। আন্তর্জাল থেকে প্রস্তাবিত নারীনীতি নামিয়ে পুরোটা পড়লাম। বিশেষ করে যে ধারা দুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সে দুটি। ধারা দুটি হচ্ছে ২৩.৫ এবং ২৫.৩। ধারা দুটি পড়ে এর মধ্যে ইসলাম-বিরোধী কিছুই খুঁজে পেলাম না।

আসুন পাঠকবৃন্দ দেখি এতে ইসলাম-বিরোধী কিছু আছে কিনা। ২৩.৫ ধারায় বলা হচ্ছে ‘‘জাতীয় অর্থনীতির সকল কর্মকান্ডে নারীর সক্রিয় ও সমঅধিকার নিশ্চিতকরণ ও সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশিদারিত্ব দেয়া। ’’ এখানেও কোথাও উত্তারিধারসূত্র পাওয়া সম্পদের কথা নেই। এখানে যে সম্পদের কথা বলা হয়েছে তা জাতীয় সম্পদকেই বুঝায়। আর আমাদের সংবিধানেই জাতীয় সম্পদের উপর প্রত্যেক নাগরিকের সমান সুযোগ ও অংশিদারিত্বর কথা বলা আছে।

এটি কোনোমতেই কোরানবিরোধী নয় বরং আমাদের সংবিধানসম্মত। এ ব্যাপারে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় এর পক্ষ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেখানেও একইভাবে বিষটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “উল্লেখ্য যে, ২৩.৫ ধারায় সম্পদ বলতে কোনো উত্তরাধিকার সম্পদকে বোঝানো হয় নি। এখানে বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে একজন নারীকে নাগরিক হিসাবে সম্পদ অর্জন, স্ব স্ব কর্মস্থল ও ব্যবসা-বানিজ্যে তার যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য অংশীদারিত্বের কথা বলা হয়েছে।

অর্থাৎ একজন নারী যদি কোনো যৌথ ব্যবসায় অংশগ্রহণ করে এবং অর্থ বিনিয়োগ করে তাহলে তার অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এটি কোরান-সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো বিধান নয়। বরং কুরান-সুন্নাহ নারীর জন্য যে অধিকার নিশ্চিত করেছে তারই বাস্তবায়নের রূপরেখা রয়েছে এ ধারাটিতে”। এবার দেখা যাক নারীনীতির ২৫.২- ধারায় কী আছে ? ২৫.২ ধারায় আছে ‘‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন-এ উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা। ’’ এখানে কোথাও উত্তারাধিকারের ক্ষেত্রে সম-বণ্টনের কথা উল্লেখ নেই।

বরং বলা হচ্ছে প্রচলিত মুসলিম উত্ত্রাধিকার আইনে বা স্ব স্ব ধর্মীয় আইনে উত্তরাধিকারসূত্রে একজন নারী যে অংশটুকু পাবেন বা অর্জন করবেন তাতে তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে। এটি কোনোভাবেই কোরান-সুন্নাহ্‌ বিরোধী নয়। বরং প্রবলভাবে কোরানের একটি আয়াতের মূলকথাকেই উপস্থাপন করছে। পবিত্র কোরাআনের সূরা-নিসার ৩২ নাম্বার আয়াতটি কষ্ট করে একটু খেয়াল করুন: “যা দিয়ে আল্লাহ্‌ তোমাদের কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা কোরো না। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য, আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য।

আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ প্রার্থনা করো, আল্লাহ্‌ তো সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ”। (৪:৩২) এখানে অর্থাৎ পবিত্র কোরাআনেই নারীনীতির ২৫.২ ধারাটি প্রায় হুবুহ আছে – “পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য, আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য"। অথচ এ ধারাটিকেই আমিনীর মতো ধর্মব্যবসায়ীরা কোরান-বিরোধী বলে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশের কিছু ধর্মভীরু মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপচেষ্টা করে যাচ্ছেন আর তাতে না-বুঝে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে কিছু সাধারণ মানুষ যাদের একটি বিরাট অংশ প্রস্তাবিত নারীনীতিটিকে একাবারের জন্যও পড়ার প্রয়োজন মনে করেন নি। অন্যদিকে সরকারে উচিত ছিলো এ ধরণের একটি নারীনীতি করার আগে সংশ্লিষ্ট সকলে সাথে আলাপ-আলোচনা করা। কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে করার চেষ্টা করেন নি।

যখন এটি নিয়া ধর্মব্যবসায়ীরা বিভ্রান্তি ছড়ানো শুরু করল তখন তাঁরা আলেম-ওলামাদের সাথে আলোচনা শুরু করলেন। তাছাড়া নারীনীতির ব্যাপারে আগে থেকে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়ার সরকারের উচিত ছিল। এখন যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলো আরও আগে নিলে আজকে কিছু সুবিধেবাধী মানুষ মুসলিম নাগরিকদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাঁদের বিভ্রান্ত করতে পারতো না। এ ব্যাপারে সরকারে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে যা তাদের ব্যার্থতা বলেই গণ্য করা যায়। আহমেদ সফা তাঁর “বাঙালি মুসলমানের মন” গ্রন্থের ভূমিকায় বলছিলেন, “আওয়ামীলীগ যখন জিতে তখন মুষ্টিমেয় কিছু নেতা বা নেত্রীর বিজয় সূচিত হয়।

কিন্তু যখন পরাজিত হয় তখন গোটা বাংলাদেশটাই পরাজিত হয়। “ এটাই হচ্ছে আওমীলীগের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। তারা যখন ক্ষমতায় আসে তাদের মধ্যে অনেক সময় একনায়ক-তান্ত্রিক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। কোনো বড়ো ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় জনগন এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ-আলোচনা করার বিষয়টি তাদের মনেই আসে না। তাঁদের মনে অনেক সময় এরকম একটি ধারণা গড়ে উঠে যেহেতু জনগন তাঁদেরকে নির্বাচিত করছে সেহেতু সকল ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও জনগন তাঁদের কাঁধেই দিয়ে দিয়েছে।

এ ব্যাপারে দ্বিতীয় কারোর মতকে বিবচেনার করা সময়ে অপচয়মাত্র। আওয়ামীলীগকে এ মনোভাব ত্যাগ করতে হবে এবং জনগণের বৃহত্তর অংশের মনের ধরণ-ধারণ এবং প্রবণাগুলোকে নির্মোহভাবে জানার চেষ্টা করে সে অনুযায়ী কর্মোপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। আর বি এন পির ভোটের একটি বিরাট উৎস হচ্ছে নারীরা। এটা সর্বজনস্বীকৃত যে নারীদের একটি বড়ো অংশই বি এন পিকে ভোট দেয়। সে নারীদের অধিকারের প্রশ্নের বি এন পির পক্ষ থেকে জনগন পরিষ্কারবক্তব্য আশা করেছিল।

কিন্তু তাদের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ মনোভাব অনেককে হতাশ করেছে এবং অনেকের মনের মধ্যেই এ ধারণাটাই পোক্ত করেছে যে আমিনীর এ হরতালের সাথে বি এন পির শুধু নৈতিক সমর্থনই নয়, পিছনে তাদের মদদও আছে। যে নারীরা বি এন পির প্রধান শক্তি তাঁদের ন্যায্য ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে বি এন পির এ অবস্থান তাঁদের রাজনৈতিক ভুল পদক্ষেপ হিসাবে চিহ্ণিত হবে। বি এন পির নেতৃত্বকে এখন ঠিক করতে হবে তারা কি প্রগতিশীল দল হিসাবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করবেন নাকি এভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে প্রভাবিত করার খেলা খেলে যাবেন। নারীরা আমাদের দেশে এমনিতেই বঞ্চিত, অবহেলিত। তাঁদেরকে বঞ্চিত রেখে একটি জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।

জনসংখ্যার অর্ধেক অংশকে বাদ দিয়ে কীভাবে জাতির ভাগ্য-উন্নয়ন সম্ভব? তাই সচেতন নাগরিক হিসাবে আমাদের উচিত সংবিধান এবং ধর্ম নারীকে যে অধিকার দিয়েছে সে অধিকারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকা। বাংলাদেশে প্রতিদিন এসিডে ঝলসে যাচ্ছে কতো বোনের মুখ, ইভ-টিজিং এর শিকার হয়ে জীবন-ফুলের সকল পাঁপড়ি শুকিয়ে অকালে ঝড়ে পড়ছে ফুলের কতো কিশোরী, কতো নারীকে ধর্ষণ করে চলেছে কিছু মানুষরুপী পশুস্বভাবী অমানুষের দল। যৌতূকের মতো চরম ইসলাম-বিরোধী ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কতো কন্যা-দায়গ্রস্ত অসহায় পিতার বুকের ভিতরে বোবা-কান্নার করুণ আর্তনাদ ঘুমরে মরছে, ননপুংষকদের লালসার শিকার হয়ে যৌতূকের অর্থ দিতে না পেরে লাশ হচ্ছে কতো গৃহবধু। ধর্মান্ধতার চশমার নীলাভ কাচের ভিতর দিয়ে এগুলো আমিনীরা দেখেন না। এদের কান্নার আওয়াজ আমিনীদের কানে পৌঁছায় না।

“নারীনেত্রীত্ব হারাম” বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেও ক্ষমতার লোভে একজন নারীর নেত্রীত্ব মেনে নেওয়ার সময় আমিনীদের ধর্মীয়বোধ বাঁধা দেয় না। তাদের শাসনামলে যখন ২০০৩-০৪ অর্থবছরে মদ, বিয়ার এর শুল্ক কমানো হয় তখন সামান্য প্রতিবাদ করার কথাও তাঁদের মাথায় আসে নি। কিন্তু যখনই অবহেলিত নারীদেরকে তাঁদের সংবিধানসম্মত এবং ধর্ম-মতানুসারে অধিকার এবং সুযোগ দেওয়ার কথা উঠে তখনই তাদের (আমিনী গং) প্রবল ধর্মবোধ এবং পৌরুষ জেগে উঠে। আমিনীদের এ চরম সাম্প্রদায়িক এবং প্রবল পুরুষতান্ত্রিক ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে সকল ধর্মভীরু, প্রগতিশীল নাগরিকের সচেতন হওয়া উচিত। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.