আমি লেখক খারাপ হতে পারি কিন্তু ছেলে ভাল পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ মারিয়ে ছুটে যাচ্ছে লাল রঙের একটি মিতসুবিশি। ড্রাইভিং সিটে স্টিয়ারিং ধরে আছে শাওন। গাড়িতে মৃদু ভলিউমে রবিন্দ্র সংগীত বাজছে। শাওন তার সাথে তাল রেখে মাথা দুলাচ্ছে। শাওনের পাশের সিটে মহা অস্বস্তি নিয়ে বসে আছেন হুমায়ুন আহমেদ।
শাওন নিতান্তই কাচা ড্রাইভার। তাকে সম্বল করে এত দীর্ঘ সফরে বের হওয়া মোটেই উচিত হয়নি। শাওনের প্রস্তাব শুনেই তিনি জোড়াল আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু শাওন তার সিদ্ধান্তে অটল। হয় সে একা ড্রাইভ করবে, নইলে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম যাওয়ার প্ল্যানই বাতিল।
অবশেষে শাওনের জেদের কাছে তাকে নতি সিকার করতে হয়েছে।
পথের দিকে চোখ রেখে শাওন বলল আচ্ছা, তুমি কি পুরোটা পথ এমন ভয়ে শক্ত হয়েই থাকবে নাকি এখন একটু দম ফেলে স্বাভাবিক হবে?
আমি যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি। হুমায়ুন জবাব দিলেন।
এবং সেই চেষ্টায় তুমি দারুন ভাবে ব্যর্থ হচ্ছ। আচ্ছা তোমার কি মনে হচ্ছে না আমি খুবই ভাল গাড়ি চালাচ্ছি?
হচ্ছে।
তাহলে এত টেনশন কেন?
সামনে এখন অনেকটা পথ পরে আছে। গাড়ি চালাতে চালাতে এক সময় তুমি টায়ার্ড হয়ে পরবে। নিজের অজান্তেই রাস্তার অপর থেকে মনোযোগ সরে আসবে।
সে তখন দেখা যাবে। আর এত চিন্তা করছ কেন? মরলেতো দুই জন একসাথেই মরব।
খুব অল্প মানুষই তার ভালবাসার মানুষটির সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারে। সেটাই বা কম কি।
বাস্তবে তেমনটা ঘটবে না। দেখা যাবে তুমি চিরে চ্যাপ্টা হয়ে গেছ, অথচ আমি ষাট বছরের বুড়ো দিব্যি বেচে আছি। হওয়ার মধ্যে কনুইএ একটা আচর লেগেছে, এইযা।
ভালো তো। আরেকটা বিয়ে করবে তখন।
নাহ, তোমাকে বিয়ের সময় তাওবা যা বয়স ছিল। এখন এই বয়সে আর কুলোবে না।
তবে যে বল লেখকদের কখনো বয়স বাড়ে না।
সেটা তো পাঠকদের বলি।
হুম... আচ্ছা, নিষাদকে যে ঢাকায় ফেলে রেখে এভাবে চলে এলাম, এটা কি ঠিক হল?
সেটা নিয়ে এখন চিন্তা করে আর কি হবে......
মায়ের কাছে ভালই থাকবে। মা বরং আমার চে বেশি যত্নে রাখবে।
তা অবশ্য ঠিক বলেছ।
তবুও কিছু টেনশন তো থেকেই যায়।
যাক, তুমি একটু রিলাক্সড হওয়ার চেষ্টা কর। চার ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালাচ্ছি। এতক্ষনে যেহেতু কিছু হয়নি আশা করি সামনেও আর কিছু হবে না। বেশি ভয় লাগলে চোখ বুজে নতুন গল্পের প্লট খুজতে থাক।
প্লট একটা মুটামুটি রেডি।
পৌঁছেই লিখতে বসব ভাবছি।
বাহ, ভেরি গুড।
সিডিটা অফ করত। এতক্ষন ধরে একই গান শুনতে ভাল্লাগছে না।
আমি একটা গান ধরব?
দরকার নেই, তুমি রাস্তার দিকে মনযোগ দাও।
শাওন সিডি অফ করে দেয়। এবং একটু পর গুন গুন করে ওঠে “বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে।
*****
হুমায়ুন দম্পতি যখন গন্তব্যে পৌঁছলেন তখন ভর সন্ধ্যা। জায়গাটা দেখেই শাওনের মন খারাপ হয়ে গেল। হুমায়ুন যা বলেছিল তার সাথে বিশেষ মিল নেই।
পাহাড়ের উপরে জংলা মত একটা জায়গায় পুরনো একটা একতলা দালান। দেয়ালের রঙ উঠে গেছে। আশেপাশে বহু দিনের অযত্নে স্বাধীন ভাবে ঝোপঝার বেড়ে উঠেছে। ভেতরে ঘর মোট চারটি। প্রতিটি ঘরই ছোট ছোট এবং স্যাতস্যাতে।
ইলেক্ট্রিসিটির লাইন নেই তবে জেনারেটরের ব্যাবস্থা আছে। পাহাড়ের এত ওপরে সেলফোনের নেটওয়ার্ক পাবার প্রস্নই উঠে না। টেলিফোনের লাইন আছে, তবে জানা গেল লাইনটা মাঝে মাঝেই ডেড হয়ে থাকে।
বাড়িটির আশেপাশে ছয় মাইলের মধ্যে কোন জনবসতি নেই। বাড়িতে একজন কেয়ারটেকার আছে।
সেই বাড়ির আশপাশটা শাওনকে ঘুরিয়ে দেখায়। কেয়ারটেকার রাতে এখানে থাকে না। তার বাড়ি প্রায় পাচ মাইল দূরে পাহারের গোঁড়ায়। প্রতিদিন সকাল দশটার দিকে এসে সে ঘরদোর ঝেরেপুছে রেখে যায়। এম্নিতে রাতে বাড়িটা তালা বদ্ধই থাকে।
এই জনমানবহিন এলাকায় চোর আসার কোন সম্ভবনা নেই। আর চোর এসে নেবেই বা কি? কয়েকটা পুরনো আসবাব ছাড়া বাড়িতে আর কিছুই নেই।
বাড়িটা ছিল লেখকের একজন বন্ধুর। বহুদিন আগে বন্ধুর সাথে একবার এখানে ঘুরতে এসে প্রথম দেখাতেই নাকি জায়গাটার প্রেমে পরে গিয়েছিল হুমায়ুন। বন্ধুকে ফুসলে ফাঁসলে কিনে ফেলেছে বাড়িটা।
অথচ কেনার পর আর একটি রাতও কাটানো হয়নি এখানে। এইসবই শাওনের সাথে বিয়ের অনেক আগের কথা।
****
সামনে একটা স্পাইরাল বাইন্ডিং করা মোটা খাতা খুলে বসে আছেন হুমায়ুন। টেবিলের ওপর মোমবাতি জ্বলছে। কেয়ারটেকার বিদায় নেবার পরপরই জেনারেটরএ কি যেন সমস্যা দেখা দিয়েছে।
গরমে লেখক হাঁসফাঁস করছেন। অনেকক্ষণ যাবত তিনি খাতা খুলে বসে আছেন। লেখা আসছে না। অথচ পুরো গল্পটা তার মাথায় সাজানো আছে। ভেবেছিলেন কলম নিয়ে বসলেই হরহর করে লেখা আসবে।
স্পাইরাল করা খাতাটা নতুন। গত জন্মদিনে শাওন উপহার দিয়েছে। এখনো পর্যন্ত কিছুই লেখা হয়নি। তিনি শুরুটা করতে পারছেন না। এক লাইন লিখছেন, কেটেফেলছেন, আবার লিখছেন।
এভাবে করেই চলছে।
বহুদিন থেকেই ভাল কিছু লিখতে চাইছেন। প্রচুর লিখছেন, কিন্তু ভাল লেখা আসছে না। বাজারে তার বইয়ের চাহিদা অন্য যে কোন সময়ের থেকে বেশি। এই শেষ সময়ে এসেও তার ভক্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বারছে।
প্রকাশকরা তার কাছ থেকে লেখা নেয়ার জন্য হন্যে হয়ে থাকে। যেমন হক একটা লেখা তাদের চাই। লেখার মান কোন বিসয় না। হুমায়ুন আহমেদ যা লিখবেন তাই চলবে। সামনে ঈদ আসছে।
টিভি চ্যানেল গুলো এবার ঝাপিয়ে পরবে নাটকের জন্য। দিন রাত ফোন করবে, বাসায় এসে বসে থাকবে। তিনি কাউকেই ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। অনেক বার ঠিক করেছেন, এইবার “না” বলাটা রপ্ত করবেন। কিন্তু তিনি কখনই না বলতে পারেন না।
লেখক ক্লান্ত। তার সারা শরীর জুরে অবসাদ। তিনি জানেন এই অবসাদের উৎস আত্মার অতি গভীরে। শত বিশ্রামেও এই অবসাদ কাটবে না। শুধু মৃত্যুই বুঝি এর থেকে মুক্তি দিতে পারে।
ইদানিং ছোটখাটো অসুখ লেগেই আছে। বুড়ো শরিরে এই ছোট অসুখই বড় যন্ত্রণা দিচ্ছে। দেহঘড়ি বলছে “অনেক ত হল। আর কত? চল এবার ফিরে যাই”
লেখক ফিরে যেতে চান না। বিদায় নিতে তার বড় ভয়।
বিদায়ের সময় যত নিকটে আসছে ভয় ততই বারছে।
দুই হাতে দুই মগ ভাপ উঠা কফি নিয়ে ঘরে ঢুকল শাওন। লেখা কেমন চলছে?
চলছে না।
কফি খাও। তারপর এসো বারান্দায় বসে গল্প করি।
আজ কি সুন্দর চাঁদ
উঠেছে দেখেছ?
নাহ। এই লেখা শেষ না করে চাঁদ সূর্য কিছুই দেখব না।
তুমি গল্পে এত সুন্দর রোমান্টিক কথা বার্তা লেখ, অথচ বাস্তবের মানুষটা এত কাটখোট্টা কেন?
ভেতরে যা কিছু রোমান্স আছে সব ত গল্পের পাতায়ই শুষে নেয়। নিজের জন্য কিছুই বাঁচাতে পারি না।
শাওন হেসে ফেলল।
লেখক মুগ্ধ হয়ে দেখলেন। মেয়েটা হাসে খুব কম।
গল্পটা কি নিয়ে? শাওন জিজ্ঞাসা করে।
এখনই শুনে ফেলতে চাও? পরে কিন্তু তাহলে আর মজা থাকবে না।
তোমার গল্প পরে আমি আগে বা পরে কখনই মজা পাই না।
ও, তাহলে শুনতে চাইছ কেন?
জানি না কেন। শুনতে চাই, ব্যাস।
এক মধ্য বয়স্ক মানুষের কাহিনী। মানুষটা খুবই ছা পোষা ধরনের। বউ আছে, বাচ্চা আছে।
মানুষটি তার সল্প আয়ের মধ্যেই চেষ্টা করেন স্ত্রি বাচ্চা কাচ্চা সবাইকে খুসি রাখার।
বেশ তো, তারপর?
তারপর একদিন মানুষটি ভাব্ল, যথেষ্ট হয়েছে, এবার তার মুক্তি দরকার। এই সংসার জীবন তার আর ভাল লাগছে না। এমন চিন্তা ভাবনা থেকে সে তার স্ত্রি আর দুই বাচ্চা কে মেরে ফেলল।
শাওন ঠাণ্ডা চখে লেখকের দিকে তাকিয়ে রইল।
কি, এভাবে চেয়ে আছ কেন? ভাল লাগেনি?
নাহ, অতি জঘন্য চিন্তা ভাবনা। তারচে বড় কথা একেবারেই যুক্তিহীন।
কোন জায়গাটা যুক্তিহীন মনে হচ্ছে?
পুরোটাই। ভদ্রলকের যদি সংসার থেকে মুক্তি পাওয়ার এতই শখ হয়ে থাকে তবে সে আত্মহত্যা করুক। সেই সাহস না থাকে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাক।
বউ বাচ্চাকে মেরে ফেলার কী দরকার?
মানুষটি মুক্তি চায় পিছুটান থেকে। বারি থেকে পালিয়ে গেলে পিছুটান তো থেকেই যায়। আর সংসার থেকে মুক্তি চাওয়া মানে কিন্তু এই নয় যে সে নিজের জীবন কে ভালবাসে না।
তুমি নিজের মত করে যুক্তি দ্বারা করাতে চাইছ। কিন্তু বাস্তবের সাথে এর প্রাসঙ্গিকতা কম।
দুইজন প্রকাশক কিন্তু ইতিমদ্ধে আইডিয়া দারুন পছন্দ করেছে।
তুমি উনাদের দুই পাতা বাংলা খিস্তি খেউর লিখে দিলে উনারা সেটারও প্রশংসা করবেন।
শাওন বরাবরই লেখকের সবচে বড় সমালোচক। কিন্তু এই মুহুরতে ওর কাটাকাটা কথা শুনতে লেখকের ভাল লাগছে না। হুমায়ুন গলা খাকড়ি দিয়ে বললেন, আচ্ছা দেখি আমি লেখাটা শুরু করতে পারি কিনা, কফির জন্য থ্যাংকস।
শাওন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল তুমি নিজের লেখা নিয়ে বড্ড ডিফেন্সিভ আচরণ কর, সমালচনা একেবারেই সহ্য করতে চাও না।
হুমায়ুন তার কথা না শুনার ভান করে বললেন তুমি যাবার সময় দরজাটা ভিরিয়ে রেখে যেও।
শাওন বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আহা, কি চমৎকার চাঁদের আলো। নীলচে আলো চারপাশটা বড় রহস্য ময় দেখাচ্ছে।
যুগপৎ মুগ্ধতায় এবং ভয়ে শাওনের শরীর ছমছম করে উঠে। হুমায়ুন দেখলে বড় আনন্দ পেত। কিন্তু তাকে এখন ডেকে লাভ নেই। লেখলেখির সময় সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। যতক্ষণ লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার এই ঘর কাটবে না।
লেখকের স্ত্রি মাত্রই নিঃসঙ্গ।
কথাটা বলেছিল গুলতেকিন।
বহুদিন আগের কথা। তখন শাওন সবে মাত্র কলেজে উঠেছে। হুমায়ুনের ছোট মেয়ে শিলা আর সে একই সাথে ভিকারুন্নিসায় পরে।
তার সাথে প্রায়ই তাদের বাসায় চলে যেত শাওন। হুমায়ুনের আশেপাশে ঘুরঘুর করত। কি এক সাংঘাতিক আকর্ষণ! শাওনের দম বন্ধ হয়ে আসতো। লেখককে না দেখে থাকতে পারত না, আবার দেখা হলেও মনে হত সে বুঝি মারা যাচ্ছে, তাকে আর কিছুতেই বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। গুলতেকিন হয়তো সবই বুঝত।
একদিন সে চোখের দৃষ্টি মরা মাছের মত করে বলেছিল শাওন, লেখকের স্ত্রি মাত্রই নিঃসঙ্গ। শাওন বরাবরই গুলতেকিন কে হিংসা করত। এখনও করে। হুমায়ুন তার জিবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু সে
এই মহিলাকে দিয়ে এসেছে।
হুমায়ুন কি এখনও গুলতেকিন কে ভালবাসে? নিশ্চয় বাসে।
গুলতেকিন মারা গেছে বছর দেড়েক হতে চলল। তার মৃত্যুতে তৎক্ষণাৎ লেখকের মধ্যে বিশেষ ভাবান্তর দেখা যায়নি। মুটামুটি স্বাভাবিকই ছিল বলা যায়। তারচে তার ছেলেমেয়ের আচরণ ছিল অনেক অস্বাভাবিক। ছোট ছেলে নুহাস চিৎকার করছিল খবরদার কেউ বাবাকে সামনে আস্তে দেবে না।
একদম খুন করে ফেলব, একদম খুন করে ফেলব। শিলা সেই সময়টা আমেরিকাতে ছিল। মায়ের মৃত্যুর সময় কাছে থাকতে পারেনি। এতে ভালই হয়েছে। শিলার সাথে দেখা হলে কি হত কেজানে?
গুলতেকিনের প্রতি হুমায়ুনের কি কোন গোপন অপরাধ বোধ আছে? হঠাত তার এই অদ্ভুত আচরনের আর কোন ব্যাখ্যা নেই।
সমস্যাটা দেখা দেয় মাস্খানেক আগে। এক রাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে হুমায়ুন বলল সে নাকি কয়েক দিন থেকেই গুলতেকিন কে দেখতে পাচ্ছে। যখন আশেপাশে আর কেউ থাক না তখন সে দেখা দেয়।
শাওন সমস্যাটাকে যথেষ্ট গুরুত্তের সাথেই নিয়েছে। হুমায়ুন নিজে অত্যন্ত সচেতন একজন মানুষ।
বাস্তবের সাথে কল্পনা বা হেলুসিনাসনের পার্থক্য বুঝতে পারার ক্ষমতা তার আছে। সে হুমায়ুনকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। শেষমেশ হুমায়ুন আর রাজি হয়নি। হুমায়ুন সমস্যাটা নিয়ে এরপর আর কোন কথা বলেনি। কিন্তু তার সমস্যা কেটে গেছে বলে মনে হয় না।
শাওন এরপর প্রায়ই আবিষ্কার করেছে লেখক খালি ঘরে একে একা কথা বলছে। শাওন নিজেই একজন পরিচিত সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেছে। সাইকিয়াট্রিস্ট সাহেব পরামর্শ দিলেনপরিবেশটা চেঞ্জ করার। সম্ভব হলে দেশের বাইরে থেকে ঘুরে আসতে বললেন।
একটুকরো মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে ফেলল।
আজ রাতে বোধ হয় বৃষ্টি হবে।
গভির রাত। বাইরে ঝম ঝম বৃষ্টি হচ্ছে। শাওন এক ঘুম দিয়ে উঠে এসে দেখল তখনও বসার ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। হুমায়ুন তখনও এক মনে লিখে যাচ্ছেন।
শাওন পেছন থেকে ডাকল, এই যে ঘুমুবে না? রাত কত হল খেয়াল আছে।
হুমায়ুন জবাব দিলেন না। মনে হল যেন শুনতেও পাননি। শাওন কাছে গিয়ে তার কাধে ঠেলা দিয়ে বলল এইযে, শুনছ?
ঝাকুনি খেয়ে হুমায়ুন ফিরে তাকালেন। তার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে।
মনে হচ্ছে যেন শাওনকে চিনতে পারছেন না। শাওন কিছু না বলে পিছিয়ে গেল। হুমায়ুন আবার কিছুই হয়নি এমন ভাবে লেখায় মন দিলেন। লেখক এখন গভির ঘোরের মধ্যে আছেন। এই মুহুরতে তাকে ঘাঁটানো যাবে না।
শাওন পায়ে পায়ে নিজের বিছানায় ফিরে গেল। কেন জানি তার মনে হতে লাগল এইবারের এই সফরটা বড় দীর্ঘ হতে চলেছে।
****
পরের দিনের সকালটা অসম্ভব সুন্দর। ঘণ্টা খানেক আগে বৃষ্টি থেমে নরম রোদ উঠেছে। প্রকৃতির মাঝে একটা ঝক ঝকে সজীবতা চলে এসেছে।
ঘর ছেরে বাহিরে এসেই শাওন একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। গতকাল সন্ধায় আলোর অভাবে বুঝা যায়নি।
পাহাড়ের কিনারে এসে দাঁড়াল শাওন। এহান থেকে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সরু একটা পথ এঁকেবেঁকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেছে।
যতদূর চোখ যায় কোথাও কোন মানুষ নেই। ইসস, জায়গাটা এতো নির্জন কেন?
হঠাত শাওনের মনে হল কেউ তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চট করে ঘুরে দাঁড়াল সে।
কেউ নেই।
কিন্তু মন থেকে অস্বস্তি গেল না শাওনের।
মনে হল এখন দূরে গাছের আড়াল থেকে কেউ একজন তাকিয়ে আছে তার দিকে। শাওন জোরে জোরে কয়েক বার বলল, হেই, কে ওখানে?
কোন সাড়া মিলল না।
দ্রুত ঘরে ফিরে এল শাওন।
কেয়ারটেকার ছেলেটা এসেছে। হাতে একটা রেঞ্চ নিয়ে ঝুকে জেনারেটরটায় কি যেন খুটখাট করছে।
কি মনে হয়? ঠিক করতে পারবে?
জবাবে ছেলেটা লাজুক হাসি দিল।
এই ছেলেটাই কি একটু আগে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিল?
দিনটা কাটছে যেন গড়িয়ে গড়িয়ে। লেখক নিজেকে বসার ঘরে আটকে ফেলেছেন। লোকটা পাগলের মত লিখে চলেছে। অনেক ডাকাডাকি করেও শাওন তাকে বসার ঘরের বাইরে আনতে পারল না।
লেখলেখির সময় তিনি একা থাকতে পছন্দ করেন। ঘরে দ্বিতীয় কেউ থাকলে নাকি তার লেখা আসে না। দিনটা তাই শাওনের একা একাই কাটল। দুপুরের খাবার পৌঁছে দিতে হল তার ঘরে। ঘণ্টা খানেক পর গিয়ে দেখা গেল সেই খাবার লেখক ছুঁয়েও দেখেননি।
তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাটা আরো বাড়ল। এখানে এসে সে কিছুটা অদ্ভুত আচরন করছে। বেড়াতে এসে সাধারনত সে লেখালেখি নিয়ে ব্যাস্ত হয়না। কিন্তু এখানে আসার পর থেকে সে একরকম নেশাগ্রস্তের মত লিখে যাচ্ছে।
দিন গড়িয়ে রাত নামল।
হুমায়ুন আহমেদ লিখে চলেছেন। তার হাত চলছে যন্ত্রের মত। যেন অন্য কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। নিঃশ্বাসের গতি বাড়ছে।
তিনি লিখে চলেছেন। এক মুহূর্তের জন্যেও তার হাত থামছে না। লিখতে লিখতে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। চারপাসের সবকিছু একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তার বুক ধক ধক করছে।
কিন্তু তিনি লেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার লেখার গতি আর বাড়ছে। কাগজের ওপর তার কলম চেপে বসছে।
প্রচণ্ড ঘর্ষণে কাগজ ছিরে গেল। তার হাত থেকে কলম খসে পড়ল।
লেখক জ্ঞান হারালেন।
ঘাসে ঢাকা সবুজ মাঠের ওপর লেখক দাঁড়িয়ে আছেন। তার চার পাশে ছোট ছোট গাছে নীল রঙের অদ্ভুত সুন্দর ফুল ফুটেছে। নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। পরিবেশটিতে চমৎকার একটা প্রশান্তির ভাব লেগে আছে।
একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে লেখকের ছেলে নিষাদ। দুই হাত নেড়ে সে বাবাকে ডাকছে। মুখে স্নেহের হাসি মেখে লেখক এগিয়ে গেলেন। নিষাদ তাকে দূরে একটা বিশাল দিঘির কাছে নিয়ে গেল। দিঘির পানি স্থির কাচের মত।
লেখক ঝুকে দেখে বুঝলেন দিঘিতে পানি নেই, পুরো দিঘি রক্তে থিক থিক করছে।
দেখতে দেহতে চোখের সামনে দিঘির পানি বারতে লাগল। কুল ছাপিয়ে রক্তের স্রোত তাদের পা স্পর্শ করল। লেখক ভয় পেয়ে ছেলেকে নিয়ে পিছিয়ে গেলেন। রক্ত আরও বাড়ছে।
দিঘিতে সমুদ্রের মত ঢেউ জেগে উঠেছে। প্রচণ্ড গর্জনে তাদের ওপর রক্তের ঢেউ আছড়ে পড়ল। আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে তারা দুজন ছুটতে শুরু করলেন। জলোচ্ছ্বাসের মত পাহাড় প্রমান রক্তের ঢেউ তাদের তাড়া করছে। তাদের হাঁটু পর্যন্ত রক্তে ডুবে গেছে।
লেখকের পা পিছলে গেল। রক্তের মাঝে তিনি মুখ থুবড়ে পরলেন। তার মুখে রক্ত ঢুকে গেল। রক্তের স্রোতে তিনি ডুবে যাচ্ছেন। সাহায্যের আশায় তিনি ছেলের দিকে হাত বারিয়ে দিলেন।
নিষাদ তার হাত ধরল না। বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল।
একটা ঝাকি খেয়ে হুমায়ুন আহমেদের ঘুম ভেঙে গেল। তার সাড়া শরীর ঘামে ভিজে গেছে। এখনও বুক ধক ধক করছে।
অনেক্ষন লাগল তার ধাতস্থ হতে। তিনি জোরে জোরে কয়েকবার দম নিলেন। দুই গ্লাস পানি খেয়ে কিছুটা সাভাবিক হলেন।
খুট করে তার পেছনে কিসের যেন শব্দ হল। চট করে তিনি ঘুরে তাকালেন।
এবং দেখতে পেলেন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে গুলতেকিন।
(পরের পর্ব: একজন লেখক ও একটি রক্তাক্ত চিঠি )
Click This Link
(বাস্তব চরিত্রকে উপজীব্য করে অনেক সময়ই অনেক উপন্যাস লেখাও হয়েছে। তবুও এই গল্পটি লেখার সময় মন খুতখুত করছিল। তবে গল্পের হুমায়ুন কিন্তু আমদের জগতের হুমায়ুন আহমেদ নয়। এই সত্তাটির অবস্থান কোন এক alternative reality তে অথবা কোন এক parallel universe এ।
গল্পটি মনযগ দিয়ে পরলেই বৈসাদৃশ্য গুল ধরা পড়বে। আমাদের হুমায়ুন আহমেদ অসুস্থ অবস্থায় বিদেশে চিকিৎসাধীন। আসুন আমরা তার জন্য প্রার্থনা করি। লেখক)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।