আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্রাইম সিন

বিকট শহরের প্রসিদ্ধ মুরগীভাজা প্রস্তুতকারীদের দপ্তরে প্রেমিকা এবং অনুজ ভ্রাতার সাথে প্রাণোচ্ছল সময় কাটানোর আগের কথাগুলো আমি কখনও দিনপঞ্জিতে লিখবোনা। কখনও লিখবোনা বা কাউকে জানাবোনা যে আমার গলায় ছুরি এবং মাথায় পিস্তল ধরা বিশালদেহী নিষ্ঠুর কারো অলঙ্ঘনীয় আদেশের বশবর্তী হয়ে আমাকে একশ পঞ্চাশ টাকা খরচ করে ট্যাক্সি ক্যাবে আসতে হয়েছে সময় বাঁচানোর জন্যে, যদিও আমি দশ টাকা খরচ করে বাসে উঠতে পারতাম, কিন্তু তা আমার দৈন্যতা বং আন্তরিকতার অভাব; বড় কথা অস্বচ্ছলতা প্রকাশ করত। অস্ত্রধারীদের হুমকি এবং জবরদস্তির মুখে আমাকে শার্টের 'ইন' ঠিকঠাক করতে হয়েছে বারেবার, কোথাও যেন কুঁচি না থাকে, অন্তর্বাসের কিয়দাংশ যেন অন্তর থেকে বেরিয়ে না আসে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়েছে। গলায় আড়াআড়িভাবে ছুরি ধরে তাদের একজন কর্কশ কন্ঠে বলেছিলো "একদম কথামত চলবি, কোথাও যেন নড়চড় না হয়। ঠিকমত যাবি, ভুলমত হাসিস ক্ষতি নেই, তবে হাস্যমুখরতা আবশ্যক"।

পিস্তলধারী মাথায় নল তাক করে বলেছিলো " You have no option bro! this ain't a Russian roulette. বুলেট চক্রাকারে ঘুরতে থাকবে চেম্বারে, কিন্তু তোমার পালা কখনও আসবেনা। So, do as I say' তাই লন্ড্রি থেকে মাড় দেয়া চকচকে কাপড় নিয়ে আসার পরে বাসায় এসে নগ্ন হয়ে পোষাক পাল্টে সুসজ্জিত হবার সময় দরজা জানলা আঁটকানোর সভ্যচর্চাটা বাহুল্যই ছিলো বলা যায়। কারণ আমার শুভাকাঙ্খী কিন্তু অবান্ধব অস্ত্রধারীরা সাহচর্য দিচ্ছিলো যাবতীয় অসামাজিক এবং অভব্য আচরণ থেকে আমাকে মুক্ত রাখতে। আমি অপেক্ষা করে ছিলাম মুরগী বিষয়ক শৌখিন সদর দপ্তরের পাশের শৌচাগারের সামনে। মহানগরীর যানসঙ্কুলতা আমার প্রতীক্ষার সময়কে দীর্ঘায়িত করছিলো।

আমার ভীষণ পেচ্ছাপ চেপেছিলো। হয়তোবা শৌচাগারের সামনে অবস্থানের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়তোবা অনিচ্ছুক মনের অপারগতা, অথবা স্রেফ দৈনন্দিন দৈহিক বর্জন প্রক্রিয়া, জানি না কোনটা আসল কারণ, তবে আমার সঙ্গী অস্ত্রধারীরা প্রথম কারণটাকে বিবেচনাধীন রেখে দ্বিতীয় কারণটাকে অগ্রাহ্য করে এবং তৃতীয় কারণটাকে আমলে নিয়ে আমাকে অনুমতি দেয় মু্ত্রত্যাগ করার। আলোকসজ্জিত রেস্টুরেন্টের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আয়েশের বাধ্যতামূলক আকর্ষণ এতক্ষণ আমাকে বিপর্যস্ত করে রেখেছিলো। আমাকে ক্লান্ত করছিলো বর্ণাঢ্য নিয়ন সাইন আর বিলবোর্ডগুলো। আমাকে পর্যুদস্ত করছিলো অপেক্ষা এবং অভ্যর্থিত আর আপ্যায়িত হবার অবশ্যম্ভাবী ক্রুর সময়।

কিন্তু অস্ত্রধারীদের শাসানির মুখে আমাকে চটপটে ভঙ্গীতে পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো এতটা সময়। আর এখন! ওহ এখন! আমি অনাবৃত করি আমার নিম্নাঙ্গ। শৌচাগারের নোঙরা এবং কটুগন্ধী মুত্রাধারের সামনে অনেক হালকা বোধ করি। এইখানে কেউ আমার মাথায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে নেই, গলায় ছুরি ধরে নেই। আহ! কিন্তু বাস্তব হল বর্জ্যত্যাগকালীন মুহূর্তে কেতা না মেনে চলার আনন্দ থাকলেও সেটা ক্ষণস্থায়ী এবং প্যান্টের চেইন লাগিয়ে বেরুবার সময় আবার আমাকে ঘিরে ধরে অস্ত্রধারীরা।

এবার ওদের আচরণ আরো কঠোর। ছুরিটা গলায় চেপে ধরে, সেফটি ক্যাচ অফ করে মাথায় পিস্তল চেপে ধরে তারা আমাকে টেনে হিঁচড়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে অপেক্ষা করছে আমার খেয়ালী প্রেমিকা অথবা হতে যাওয়া মমতাময়ী স্ত্রী। "মনে রাখিস, এতক্ষণ ধরে যা শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছি তার অন্যথা হলে খুলি ফাটিয়ে দেবো, গলা দু ফাঁক করে দেবো"। ভুল হবার কোন সম্ভাবনা নেই, আমি তাদেরকে জানাই যে অমূলক আশঙ্কা করছে তারা। অযথাই হুমকি দিচ্ছে।

"ভয় নেই, আমি অজস্রবার, অসংখ্য পরিস্থিতিতে এসব মুখস্থ করেছি। ওর ব্যক্তিগত অস্ত্রধারীরাও নিশ্চয়ই ওকে ভালোভাবে শিখিয়ে নিয়েছে!"। হ্যাঁ, আমার ধারণাই সত্যি। আমি দেখতে পাই গোলাপী বর্ণের পোষাক পরিহিত আমার প্রেমিকার কানে ফিসফিসিয়ে দুইজন কী যেন বলছে। এক পলকের জন্যে দেখি, এ দৃশ্য অন্য কারো দেখার কথা না।

তবে কারো অজানাও না যে এই সিরামিক শহরের সমিতিবদ্ধ ছাইরঙা আকাশ থেকে প্যারাট্রুপাররা নেমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে ন্যুনতম স্বচ্ছল মানুষের প্রায়োগিক জীবনযাত্রাকে অস্ত্রতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কনস্টিটিউশনাল করার, যাতে কোনরকম কন্সপিরেসি থাকে না। সার্বক্ষণিক নজরদারীতে তারাও হয়তোবা কখনও ক্লান্ত হয়, কিন্তু দায়িত্ববোধ প্রখর তাদের। এই যেমন এখন- আমি জানি আমার এবং আমার প্রেমিকার গা ঘেঁষে কোন অস্ত্রধারী নেই এই মুহূর্তে, কিন্তু কোন সুউচ্চ অট্টালিকা থেকে স্নাইপার রাইফেল নিয়ে ঠিকই চোখ রাখছে। তার কপালের লাল টিপ অথবা আমার শার্টের লাল বোতাম স্নাইপারদের টেলিস্কোপিক লক্ষ্যবিন্দুর সাথে সখ্যতা করছে, আমরা অবশ্য এগুলোকে পরিচ্ছদ বা প্রসাধন ভবে ভুলে থাকতে চেষ্টা করি, অথবা আমরা এভাবেই আচ্ছাদিত হতে সাচ্ছ্ন্দ্য বোধ করি। -কখন এসেছো? নির্ভুল সুন্দর উচ্চারণে সে সুধোয়।

-এই তো আধাঘন্টা হবে। আমিও প্রায় নিখুঁত হিসেব বলি। -তোমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতে হল তাই না? কী করব বল, রাস্তায় যা জ্যাম! -আরে না, তোমার জন্যে এতটুকু অপেক্ষা তো করতেই পারি! আমি পিস্তলের সেফটি ক্যাচ অফ করার শব্দ শুনতে পাই। সেও পায় নিশ্চিত! যার যার অস্ত্রধারী তার তার কাছে! আমরা ভেতরে গিয়ে বসি। আমাদের পারস্পরিক অনুজ যার কী না আগামীকাল সকালে দেশের বাড়িতে গিয়ে অনাবশ্যক অবকাশকালীন সময় কাটানোর পরিকল্পনা, তার এখানে বসে পুরোনো কোন এক বাজী রক্ষার্থে গাঁটের পয়সা খরচ করার সদিচ্ছা আছে কী নেই আমরা জানি না, তবে তার ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাসেবক অস্ত্রধারীদের সংখ্যা যে আমাদের দুজনের চেয়ে বেশি হবে তা অনুমান করা যায়।

তার বাচিক অনুশীলন নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে খারাপ হবে না! -আরে ভাই, কী খবর! ম্যালাদিন পর দেখলাম আপনারে! -তোমারও তো কোন খবর টবর নাই। আছো কিরম? -আমার আর খবর! খবর তো আপনাদের! ঈঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গীমায় চোখ মটকে সে এক মুহূর্তের বিরতি নেয় আমাদের গর্বিত এবং অপ্রতিভ করার যৌথ প্রয়াসে। "কী খাবেন বলেন!" - না আমি কিচ্ছু খাবো না। আই এ্যাম স্টাফড! -এইটা বললে তো ভাই হবে না। কিছু তো খাওয়াই লাগবে।

-ওকে জিজ্ঞাসা করো কী খাবে। -আমিও কিছু খাবো না! কিছুক্ষণ এরকম খাদ্যনির্লিপ্ততা প্রকাশ করার পরে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে তিনটি সুপুষ্ট মুরগী, আলু ভাজা আর খানিকটা পানীয় নিতে পারি। খেতে খেতে আমরা একে অপরের মুটিয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ এবং খাদ্যে ভেজাল মেশানো নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করি। আমাদের চোয়াল একইসাথে চিবুতে এবং কথা চালিয়ে যেতে দক্ষ। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।

ভদ্রোচিত এবং জ্ঞানগর্ভ, সাথে রসিকতার মিশেল। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চলছে অদৃশ্য অস্ত্রধারীদের তদারকিতে। তবে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে মুরগীর রান চিবুতে গিয়ে আমার মাড়ির গোড়ায় হাড্ডিচূর্ণ জমলে। আমি টুথপিকের বদলে হাত দিয়ে ওটা বের করতে গেলে গলায় ছুরির আঁচড় অনুভব করি। "এত শিখিয়ে দেবার পরেও ভুল করিস! আরেকবার ভুল করলে গলা কেটে দু ভাগ করে দেব!" এই হুমকির পরে আমি খুব সাবধান হয়ে যাই।

আর কোন ঝামেলা হয় নি। -তো, চলো এখন ওঠা যাক। -হ্যাঁ ভাই অনেক ভালো সময় কাটলো আপনাদের সাথে। -তুমি তো উল্টাদিকে যাবা, আমি তাহলে ওকে আগায় দেই! -ঠিক আছে। দেখা হবে আবার।

আমরা করমর্দন করে বিদায় নিই। আমি ছিলাম ভীষণ ক্লান্ত। আমার প্রেমিকাও। আমি ওকে বাসে তুলে দেবার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। -বাসে যা ভীড়! ট্যাক্সি নেয়াই ভালো।

-হু। ঠিকই বলেছো। আমার ক্লান্ত দেহটাকে মার্চপাস্ট করে এগিয়ে নিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা। কঠিন পাহারা, এড়ানোর কোন উপায় নেই। ট্যাক্সির ড্রাইভারকে গতির নেশায় পেয়ে বসেছে।

আর আমরা নিমজ্জিত অন্য এক নেশায়। এখন ক্লান্তি উধাও! এখন কোন পাহারাদার, সৈন্যসামন্ত বা ব্যাটেলিয়ান নেই। থাকলেও তোয়াক্কা করতামনা। নাউ ইট ইজ আনজিপিং টাইম! রেস্তোরার সামনে অপেক্ষা করে থাকার সময়টায় মাঝখানে কিছুক্ষণ পাহারাবিহীন ছিলাম। সেই শৌচাগারে।

পেচ্ছাপের সময়। তখন আমাকে প্যান্টের চেইন খুলতে হয়েছিলো এক কারণে আর এখন অন্য কেউ খুলছে অন্য কারণে। একটা খাদ্যজ আরেকটা কামজ। তবে দুটোর মধ্যে সাদৃশ্য একটাই, দুটোই প্রাকৃতিক। -ইয়াহ বেইবি! আদিম কামনারা গুহা থেকে বের হতে থাকে।

তার কুচাগ্রে আমার ঠোঁট লেপ্টে থাকে প্রাচীন বাড়ির দেয়ালে গজিয়ে ওঠা শ্যাওলার মত। -উমমম! এই আলিঙ্গন, মুখমেহন আর দলিতমথিতকরণে মিসমার হয়ে যায় অস্ত্রধারীদের তত্ত্বাবধানে নিয়মবই মেনে চলা ভালোবাসার কথা বলা, হাতে হাত রাখা আর চুম্বন। এখন কেউ কারো হাত ধরে নেই। হয়তোবা আমাদের কোন হাত আমাদের কোন পা নেই, জেনিটাল আছে কেবল। আমাদের জেনিটালের কোন এক অন্ধপ্রকোষ্ঠে যে লাভবার্ডগুলো পুষছিলাম, সেগুলো ছেড়ে দেই।

তারা উড়ে উড়ে অস্ত্রধারীদের কাছে যায়। মারণাস্ত্রের পাশে পাখি, সুন্দর একটা দৃশ্যকল্প তৈরী করে। অস্ত্রধারীরা অবসর সময় কাটাচ্ছিলো বলে লাভবার্ডগুলোর সাথে খেলা করে, মশকরায় মেতে ওঠে, আর আমরা পরস্পরের শরীরে শরীর দিয়ে এক ধরণের ধ্রুবকচিহ্ন এঁকে দিই। আদিম এবং ধ্রুব। মৃত্যুর মত! কেমন কাকতাল না? মৃত্যুর কথা মনে আসতেই সত্যি সত্যি মৃত্যুদৃশ্যের মুখোমুখি হতে হল আমাদের।

নিয়ন আলোর প্রখর ঘোলাটে অন্ধকারে বুঝতে পারিনি শহরজুড়ে রায়ট লেগেছে, নাকি ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, নাকি জাগ্রত বিবেকগোষ্ঠীর নিজস্ব প্রক্রিয়ায় অপরাধী নিধনের মহৎ কর্ম-গণধোলাই! নাকি ক্রসফায়ার? ক্লিন হার্ট অপারেশন? স্যাবোটাজ? নেকি স্রেফ একটা সাধারন সড়ক দুর্ঘটনা? নাকি একাধিক? শহর মেতেছে মৃত্যুৎসবে। শহর ভরে গেছে শবে। মৃত্দেহগুলোকে ধাক্কা দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে আমাদের গাড়ি চলতে থাকে উদ্দাম গতিতে। একটা আহত শরীরকে গাড়িটি চাপা দিয়ে চলে যাবার সময় বেশ বড় একটা ঝাঁকুনির সাথে মৃত্যুচিৎকার শুনতে পাই। কিন্তু সেই শব্দ ঢাকা পড়ে যায় আমার প্রেমিকার শীৎকারে।

এই দাঙ্গাবিক্ষুব্ধ অথবা অপরাধচর্চিত বা দুর্ঘটনাকবলিত শহরে কতজন মারা গেলো আজ? একজন? দশজন? একশজন? একহাজার জন? কত মানুষ মারা গেছে আমরা জানি না। দৈনিক কতজন মারা যায় সেটা পরিসংখ্যানবিদ অথবা সমাজতাত্ত্বিকদের ভাবনার বিষয়। কিন্তু এত লাশ আমরা রাখবো কোথায়? রাখার জায়গার অবশ্য অভাব নেই। প্রতিটা গাড়িতে একটা করে তুলে দিলেই হয়। প্রতিটি বাড়িতে বা কমুইনিটি সেন্টারেও রেখে আসা যেতে পারে।

কবরস্থান মোটেও নিরাপদ জায়গা না লাশেদের জন্যে। শেয়াল কুকুর টেনে নিয়ে যেতে পারে। অন্তর্জালি অনুষ্ঠানের পরে সবাই যে যার মত চলে যাবে, অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে অস্ত্রধারীরা শোকের সুবিন্যাস করবে, কিন্তু তারপরে? মৃত্যুর মুহুর্তে তারা থাকে না। থাকে না মৃত্যুপরবর্তী বাসভূমেও। তবে শৌচাগার মৃতদের রাখার জন্যে ভালো একটা স্থান হতে পারে।

পেচ্ছাপের তোড়ে ভেসে যাবে সকল লৌকিক এবং অলৌকিক অসদাচরণ! এখন লাশের বিলিবন্টন চলছে। "হল্ট! ট্রাক থামা। দশটা লাশ নিয়া যাবি"। হয়তোবা গণপিটুনিতে নিহত কেউ, হয়তোবা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কাউকে তুলে দেয়া হচ্ছে ঊর্ধতন আদেশে। "ভাই...ভাই...আমার লাশটা একটু রাখবেন আপনার গাড়িতে?" কিছু কিছু লাশ থাকে এমন, নিয়ম মানেনা কিচ্ছু! মরে গিয়েও খোঁচাতে থাকে, খোঁচাতে থাকে, খোঁচাতেই থাকে! তবে এই খোঁচানোতে কটনবাডস দিয়ে কান পরিস্কারের আনন্দ নেই।

অস্বস্তিকর। "প্লিজ গাড়িটা থামান, ও এখনও বোধ হয় বেঁচে আছে!" আকুল অনুনয়ে দ্রবীভুত হয়ে না, স্পিডব্রেকারের কারণে গতি কমাতে গিয়ে আমাদের ক্যাবের এই দলটার মুখোমুখি হতে হয়। সেই দলে ছিলো ক্রন্দনরত শিশুরা, উদ্বিগ্ন আত্মীয়রা আর উদ্বাহু হয়ে উদ্ভাসিত মৃত্যুদূত। প্রেম, অপ্রেম, ভোজন, পেচ্ছাপ আর যৌনতার পরে এই অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে হবে এটা অনুমিতই ছিলো। আমাদের গাড়িতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় একটা লাশ তুলে দেয়াই যথেষ্ঠ মনে করেছে সৎকারবাহিনী।

লাশটার চোখ খোলা। আমাদের দিকেই যেন তাকিয়ে রয়েছে একদৃষ্টিতে। তার সাথে কোন অস্ত্রধারী নেই। দরকার নেই আর। আমাদের সাথেও ততক্ষণ ছিলো না যতক্ষণ আমরা উদ্দাম শারীরিক প্রেমে মত্ত ছিলাম।

আমাদের সাথে থাকে না যখন আমরা শৌচাগারে বর্জ্য পদার্থ ত্যাগ করি অথবা স্বমেহন করি। এতক্ষণ তারা ছিলো না। কিন্তু মৃত্যু এবং মৃতদেহ বিষয়ক জটিলতায় আমাদের মধ্যে সংকোচের সৃষ্টি হলে, শরীর নিস্প্রভ হয়ে এলে, ক্লান্তি জেঁকে ধরলে তারা স্বরূপে আবির্ভূত হয় পুনরায়। "Anything wrong dude? why did you stop?" "এই মৃতদেহটা..." "স্টপ টকিং বুলশিট! হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। তাতে কী কিছু থেমে থাকবে? তোমার শিশ্ন এখনও জীবিত।

তুমি তোমার প্রেমিকার প্রতি লয়াল, বহুগামী তো আর নও! তাহলে সংকোচ কিসের?" আমার প্রেমিকাও সম্ভবত আক্রান্ত। মৃতদেহের জ্বলজ্বলে চোখ আর ফাটা খুলি থেকে বেরিয়ে আসা মগজ দেখে সে শারীরিক এবং মানসিক দুই প্রকার ধাক্কাই খেয়েছে। হয়তো বা তার বমি পাচ্ছে। হয়তো বা তার কান্না পাচ্ছে। হয়তো বা তার মানবিক বোধ জেগে উঠছে।

তবে আমি জানি আমার মত তাকেও বাহাস করতে হচ্ছে ব্যক্তিগত অস্ত্রধারীদের সাথে। যাদের কথা কেউ কাউকে বলে না। কিন্তু সবাই জানে। যাদের কথা কেউ কখনও ভুলেও লিখবে না। ভুলেও কাউকে জানাবে না।

অবশ্য জানাবার দরকারও নেই। অবশেষে শোকপ্রকাশ প্রক্রিয়া স্থগিত রেখে আমরা ধীরে ধীরে আবার ঘনিষ্ঠ হই। আমি তার কোমড় জড়িয়ে ধরি। মৃতচোখ সাগ্রহে দেখছে। পিস্তলের নলটা আর আগের মত চেপে বসে নেই।

আমি তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখি। আমাদের শরীর জেগে ওঠে আগ্নেয়াদ্রির মত। লাশটার চোখ বুঁজতে থাকে। হয়তোবা ঘুমিয়ে যায়! সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। নাউ ইট ইজ আনজিপিং টাইম ওয়ান্স মোর! লাশটা হেলে পড়ে যায় ঝাঁকিতে।

অস্ত্রধারীদের আর দেখা যায়না কোথাও। আবার গতি ফিরে আসে ট্যাক্সিতে। আমাদের শরীরে। অস্ত্রধারীরা আমাদের যথেষ্ঠ প্রাইভেসি দিয়ে সটকে পড়ে। ...বিপরীত দিক থেকে একটা প্রকান্ড লরি ছুটে আসে প্রবল গতিতে।

আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হয়তোবা ধাক্কা দিয়ে চূর্ন বিচূর্ণ করে দিতে পারে আমাদের ট্যাক্সিকে, যদি না চালক অসাধারন দক্ষতায় পাশ কাটিয়ে যায়। আমার প্রেমিকার প্রসাধনচর্চিত মুখ ঘামে ভিজে কুৎসিত দেখায়। গলে গলে পড়ে প্রসাধনসামগ্রী। আমি প্যান্টের চেইন লাগাই আবার। ওটার ভিতরে কিছু আছে বলে অবশ্য অনুভূত হয় না! অসহায়ের মত তাকাই অযথাই চারপাশে অস্ত্রধারীদের সাহয্যের আশায়।

কিন্তু জানি তারা থাকে না উদ্দাম যৌনতায় শয়নকক্ষে বা গাড়িতে, প্রবল পেচ্ছাপের সময় শৌচাগারে অথবা যেকোন মৃত্যুদৃশ্যে। ক্রাইম সিনের সঙজ্ঞা তাদের কাছে ভিন্ন। এবার যদি বেঁচে যাই তাদের কাছ থেকে আরো ভালোভাবে ট্রেইনড হতে হবে। হাহ! কাদের সম্পর্কে কী ভাবছি! মহাপরাক্রমশালী অস্ত্রধারীরা গুঁটিসুটি মেরে আমাদের কাঁধের আড়াল খুঁজছে সম্ভাব্য মৃত্যুর ভয়াল চেহারা সহ্য না করতে পেরে। "হেল্প!" আমি চিৎকার করে উঠি, নাকি আমার অস্ত্রধারীরা, নাকি সেটা সম্মিলিত সাহায্য আহবান ছিলো বলা দুষ্কর! ...অন্যান্য অজস্র মৃত্যুর জন্যে না হলেও, আজকে আমাদের সহযাত্রী লাশটার জন্যে বাসায় গিয়ে আমরা শোক বিনিময় করব; প্রেমিকার শরীরে শরীর রেখে আমি ভাবি; লরিটাকে ট্যাক্সি ক্যাব দক্ষতার সাথে পাশ কাটিয়ে গেলে।

আমাকে ভাবতে বাধ্য করে আবারও প্রবল হয়ে ওঠা অস্ত্রধারীরা।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।