www.theeconomist2011@yahoo.com গ্রামীন/লোকজ সংস্কৃতিকে ক্ষেত হিসাবে খেতাবিত করে জাতের উঠার আপ্রাণ চেষ্টায় যারা নিজেদের কাজল কালো চোখ দুটোকে বিলীন করে দিচ্ছে আধুনিকতার মাসকারায়-তাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। একজন সত্যিকার সঙ্গীত প্রেমিকের পৃথিবীর সব ধরণের সঙ্গীতের প্রতিই থাকে শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু আমাদের অতি আধুনিকতায় অভিনয়কারী অনেকেই বাংলার প্রাচীনতম সঙ্গীত গুলোর প্রতি নাক সিটকায়। জীবনভর জীবন ব্যয় করে, অনাহার-অর্ধাহারে, সংসার-লোভ-লালসা ছেড়ে কখনো গ্রামের হাট-বাজার, কখনো রেললাইনের ধারে জমায়েত জনতার দিনমানের ক্লান্তি দূর করার জন্য যারা গাইলেন-জীবনের কথা, মানুষের কথা, দেশ প্রেমের কথা-তাদের আমরা কোথায় রেখেছি, তাদের জন্য আমাদের কোনো দুঃখবোধ নেই। এটা কি আমাদের সচেতন অবহেলা? নাকি সময়ের নির্মম বাস্তবতা?
লিংকসহ মাটি ও মানুষের বিখ্যাত কিছু গান নিয়ে কথা বলতে চাই ব্লগারদের সাথে।
নায়িকা সাজু, জন্মদাতা কবি জসিম উদদীন, সম্প্রতি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন নায়ক রুপাই। নিশ্চয় ‘‘নকঁশী কাঁথার মাঠ’’-এর কথা মনে পড়ছে আমাদের। এই করুণ কাহিনীকে অবলম্বন করে পাগল বিজয় সরকার লিখেছিলেন এবং বাণী চক্রবর্তী গেয়েছিলেন-
‘‘নকঁশী কাঁথার মাঠের লোকে আজো শুনতে পায়-সাজুর ব্যথায় রূপাই মিয়া বাশঁরী বাজায়”
জীবনে প্রতিষ্ঠা আর নুন্যতম বেচেঁ থাকার প্রয়োজনে বৃহত্তর সিলেট থেকে কোলকাতায় চলে গেলেও যিনি ভুলে যাননি- হাওড়ের তাজা মাছ, সুনামগঞ্জের ডাহুক/কুড়া আর হবিগঞ্জের কবুতরকে। নিজের ভিতর নিত্য দেখেছেন এই বাংলাদেশকে। ক্লান্ত নগর জীবনে নিঃসঙ্গ রাতে বাউল স্বাগতদাস গেয়ে উঠেন-
‘‘……………………… বাধঁতে সুখের ঘর- ডানা ভেঙ্গে পড়লাম আমি কোলকাতার ’পর।
দাদীর বিয়ে হয়েছিলো গরুর গাড়ীতে করে-এই গল্প শুনতে শুনতে খুব ইচ্ছা হতো গরুর গাড়ীতে গ্রাম ঘুরবো, হয়নি। কিন্তু বন্ধ চোখে গরুর গাড়ীর অসাধারণ একটি দৃশ্য চোখে পড়ে বাউল পরীক্ষিত বালার এই গানটি শুনে-
‘‘কৃষান কন্যা কলসি কাখে জল আনতে যায়, ঘোমটার ফাঁকে নতনা দিয়ে বারেক ফিরে চায়। ”
ডিজিটাল প্রেমিক হতে পারেননি বাউল আমির উদ্দিন। কিন্তু তার প্রেম নিশ্চয় কম ছিলোনা। বিরহ যন্ত্রনাবিদ্ধ বাউল অতি সাধারণ ভাবে নিজের কষ্টগুলোকে কিভাবে প্রিয়তমাকে বুঝাতে চাচ্ছেন, শুনুন তার কাছ থেকে-
‘‘বলে আমির উদ্দীন, রয়েছি তব অধীন”
তবুও এই বাংলার ফ্যাশনেবল প্রেমিকদের বিরহ শেষ হয়না-অনিবার্য্য হিসাবেই থেকে যায় হৃদয়ে, হৃদয় থেকে হৃদয়ে।
অবশ্য যাদের হৃদয় আছে তাদের কথাই লিখলেন রাধারমন। অসাধারণ এই গানটি গাইলেন কালা মিয়া বাউল-
‘‘প্রাণতো বাঁচেনা শ্যাম, তুমি বিনে”
বাংলার ঘরে ঘরে নির্যাতিত আমাদের কন্যা/ভগিনী বেহুলারা জীবনভর সাজাভোগ করছে নদের চাঁদের ভুলের মাশুল দিতে। কোনো অপরাধ ছাড়াই কেন বেহুলাদেরকে বিধবা হতে হবে? লখীন্দরদের বাচাঁতে, নিজেকে সবল প্রমান করতে সকল বেহুলাকে জাগিয়ে দিতে ক্ষণজন্মা দিনাজপুরের বাউল গোষ্ঠ গোপাল গেয়ে উঠেন-
‘‘ঘুমাইও না আর বেহুলা, জাইগ্যা দেখো রে”
বিবাহের জন্য আমাদের পাত্রদের বাহারী যোগ্যতাকে কিভাবে মূল্য দিবে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, চরিত্রহীন হলেও নেতা থেকে মন্ত্রী হয়ে কিভাবে যোগ্যতার প্রমান দেয়া যায়-বাউল স্বপনবসুর কাছ থেকেই শুনুন-
‘‘এমনিতে ভালো ব্রাম্মণছেলে, মাঝে মাঝে একটু পেয়াজ খায়”
এই লম্পট যখন রাজনীতিবিদ হয়, নেতা হয়, মন্ত্রী হয়- তখন সাধারণ মানুষকে কিভাবে বিভ্রান্ত করে তা আমাদের নতুন করে জানতে হয়না। আমাদের ভারতবর্ষের নেতাদের সার্বিক চরিত্র বুঝানোর জন্যই স্বপন বসু গেয়ে উঠেন-
‘‘ওরে ভাইরে ভাই, মোর মতন আর দেশপ্রেমিক নাই,
অথচ মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে আমি/আমরা কি করলাম নিজের জন্য, পরিবারের জন্য কিংবা দেশের জন্য? কিন্তু অতি সাধারণ বাউল হারাধন দাস তার দায়িত্ববোধ আর বিবেকের দায় নিয়ে গেয়ে উঠেন-
‘‘বাল্যকাল গেলো খেলাতে, যৌবনকাল গেলো রসে”
যে গান শুনে আমাদের নানারা প্রেমে পড়েছিলেন। শব্দহীন কেবল চেয়ে থাকার প্রহর গুলো তাদের কাটতো স্বপ্না চক্রবর্তীর কোকিল কণ্ঠ শুনে।
স্বপ্না যেন সমাজের রক্তচক্ষুকে এড়িয়ে নানাদের জন্য প্রেমিকা হয়ে গেয়ে উঠেন-
‘‘আমি তোমারই নয়নে নয়ন রাখিয়া, সবই যে যাই ভুলে”
প্রচারবিমুখ মানবতাবাদী শিল্পী অমর পাল সাতক্ষীরা বর্ডার পার হয়ে নীরবে সিডর আক্রান্ত বাংলাদেশীদেরকে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য দিয়ে ফিরে যান ভারতে। সিডর আক্রান্তদের আহাজারি অমর পালের হৃদয়কে ভিজিয়ে দেয় অথচ তখন আমাদের উলংগ মিলারা ফ্যান্টাসীতে উদ্দাম নৃত্যরত। অমর পালের কন্ঠে কেবল কীর্তনই যেন মানায়। বন্দনা সঙ্গীত নিয়ে কৃষ্ণকে স্মরণ করে তিনি গেয়ে উঠেন-
‘‘জাগো জাগো জাগো হে নগরবাসী। ”
আমাদের নগর জীবনের যন্ত্রনায় অতিষ্ট বাউল বাড়তি জনসংখ্যার দিকটি তুলে ধরেণ একটি নিত্য যন্ত্রনার মেশিন হিসাবে, তবুও আমাদের সংগ্রাম চলছে, চলবে-
‘‘আমি বনগাঁ লোকালের ডেইলি প্যাসেঞ্জার”
সাধক বাউল তার সাধনার জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সন্দেহ পোষন করেন ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে।
জানাতে চান নিজের সীমাবদ্ধতার কথা। নিজের অক্ষমতাকে স্বীকার করে গেয়ে উঠেন-
‘‘আমি দেখিনি নয়নে, শুনেছি শ্রবণে, তুমি আছো কিনা আমার জানা নাই।
বিবর্তিত সমাজ থেকে হারিয়ে যায় বাহন, জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয় বহু পেশাদার মানুষ। আক্ষেপ থাকে আধুনিক জীবন ব্যবস্থার উপর। ভরাট কন্ঠের অবহেলিত উত্তরবঙ্গের শিল্পী ভূপতি ভূষণ বর্মার কন্ঠে শুনুন-যাপিত জীবনের পরিবর্তনের গান-
‘‘আগের দিন আর নাই, রিক্সাওয়ালা কাড়িয়া নিল মোর গাড়িয়ালের কামাই।
’’
ময়মনসিংহ অঞ্চলের গীতিকার কথা শুনেছি সবাই। শেরপুরের গাড়োপাহাডের পাদদেশে বসবাসকারী মান্দাই গাড়ো দম্পতির একটি ঝগড়াকে তুলে ধরেছেন কিসসাকার দুলাল বয়াতি। শুনুন স্বামী-স্ত্রীর নিত্য ঠুনকো ঝগড়ার একটি গান। --
‘‘হাল বাওয়াতে যামু মুই, .....................নিবি তুই। ’’
এই পোস্টটিই গত ঈদের আগের দিন রাতে দেওয়া হলে, ঈদ মোবারকের চাপে পড়ে হারিয়ে যায়।
কয়েকজন প্রিয় ব্লগারের পরামর্শে সংশোধিত করে, একটু বর্ধিত আকারে পোস্ট করা হলো। আগামীতেও এরকম মাটির গান নিয়ে পোস্ট দেওয়ার আশা আছে। ব্লগারদের মতামত প্রত্যাশা করছি, গ্রহনযোগ্যতা পেলে আগামীতে পোস্ট দেওয়ার আশা রাখছি।
এই পোস্টটির জন্য যেসব ব্লগারদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকলামঃ পাগলাঘোড়াসিটিজি >>মতিউর রহমান সাগর >>তন্ময় ফেরদৌস >>চশমখোর >>মুখোশে ঢাকা আমি মুকিত >>বৃষ্টি ভেজা সকাল ১১ >>ইশতিয়াক আহমেদ চয়ন । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।