শৃঙ্খল হতে মুক্তির লড়াইয়ে যুক্ত থাকতে চাই ধনতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার অব্যাহত সংকট মার্কসবাদী বিশ্লেষণের যথার্থতাকে সামনে আনছে। ১৯৯১ সালে সামাজিক সাম্রাজবাদী রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক পতনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রচার মাধ্যমে পুঁজিবাদই শাশ্বত এবং সমাজতন্ত্র ব্যর্থ বলে যে প্রচারণা চালিয়েছিল এবং এই প্রচারণার আনুষঙ্গিক হিসেবে মুক্তবাজারের যে দর্শনকে সামনে আনা হয়েছিল তা এক দশকের পরেই অসত্য ও ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। ধনতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী সংকট, শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্বের পরিণতি সমাজ ব্যবস্থার পরবর্তী ধাপ সমাজতন্ত্র এই মার্কসবাদী বিশ্লেষণই সামনে আসছে। কোন এক সমাজ ব্যবস্থার বিকাশের সম্ভাবনা যতদিন অক্ষুণ্ণ থাকবে ততদিন পরবর্তী সমাজ ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটবে না। আজ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন শক্তির উন্নতি ও বিকাশ এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে তাকে আর এই সমাজ ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে আটকে রাখা যাচ্ছে না।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বুর্জোয়া তাত্ত্বিকেরা নানাভাবে মার্কসবাদী এই বিশ্লেষণকে ভ্রান্ত প্রমাণের জন্য নানা যুক্তির অবতারণা করেছিলেন। তারা বলেছিলেন যে ধনতন্ত্র তার অতি উৎপাদন জনিত সংকট সমাধান করার অনেক আধুনিক কৌশল রপ্ত করেছে, বেকার সমস্যা এখন অতীতকালের ব্যাপার। এমনকি অনেক সমাজতন্ত্রী এবং তথাকথিত মার্কসবাদী পন্ডিত ও এরূপ ভ্রান্ত ধারণার শিকার হয়েছিলেন। এরা নানাভাবে বুঝাবার চেষ্টা করেছিলেন যে মার্কসবাদ সেকেলে হয়ে গেছে। এরা বলেছিলেন যে আধুনিক ধনতন্ত্র এত বিশাল শক্তি ও দারুন কৌশল আয়ত্ত করেছে যে, ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর অসন্তোষ, ক্রোধ, ক্ষোভকে ভোঁতা করে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর বৈপ্লবিক চরিত্রই নষ্ট করে দিতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বৃটেনে শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লব করে না কেন? এ রকম প্রশ্নের উত্তরে তারা উপরি বর্ণিত জবাব দিতেন। তারা আরো বলেছিলেন যে, অগ্রসর ধনতন্ত্র শ্র্রমিকদের মজুরী বাড়িয়ে, নানারকম ফূর্তির ব্যবস্থা করে: রেডিও, সিনেমা, টেলিভিশন দিয়ে স্থূল আরামে ডুবিয়ে বুদ্ধি বিবেচনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে শ্রমিকদের নষ্ট করে দিচ্ছে। শ্রমিকরা আর বিদ্রোহ বিপ্লব করবে না। কিন্তু ঐসব পন্ডিতের বিশ্লেষণ বারবার ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৬০ এর দশকেই ধনতান্ত্রিক বাজারে গভীর মন্দা দেখা দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, বৃটেনে ১৯৭৩-৭৪-৭৫ সালে বড় বড় শ্রমিক ধর্মঘটের জোয়ার দেখা দিলে এরা তখন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই অতি উৎপাদন জনিত সংকটকে সংকট না বলে সাময়িক মন্দা (Stagnation), গতিরোধ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে পাশ কাটাতে চেষ্টা করলেন।
কিন্তু ২০০৭ সাল থেকে উপজাত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার মন্দা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ মন্দা। বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান তিন মৌলিক দ্বন্দ্ব কার্যকর হয়ে বস্তুগত বিপ্লবী পরিস্থিতি এক বিকশিত পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে এ সংকট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের চেয়ে ভয়াবহ সংকট এবং তা গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী।
যে কারণে আমরা মনে করি এই সংকট এবং সংকট থেকে উপজাতক মন্দা যা মহামন্দার দিকেই ধাবিত হচ্ছে।
পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর এই সংকটের সমাধান নেই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গত শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর সামগ্রিক উৎপাদন ও পুঁজি কয়েকটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাতে কেন্দ্রীভূত হয় এবং শিল্পপুঁজি ও ব্যাংক পুঁজির মিলনের ফলে ফিনান্স পুঁজি এবং মালিকদের Oligarchy গড়ে উঠে। মালিকদের কার্টেল, ট্রাস্ট ও সিন্ডিকেট এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি নিজেদের মধ্যে পৃথিবীটাকে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে।
এতসব কিছুর পরও সাম্রাজ্যবাদ সংকটমুক্ত না। মুষ্টিমেয় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর মালিকবৃন্দ তাদের পুঁজি খাটিয়ে সুদ ও মুনাফার উপর নির্ভর করে প্রাচুর্যের সঙ্গে থাকছে, নয়া উপনিবেশ থেকে অসম চুক্তি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে নিজ দেশে গড়ে তুলেছে এক বিশাল অর্থ ভান্ডার এবং এই লুটপাটের সামান্য অংশ ব্যয় করে নিজ দেশের শ্রমিকদের মধ্যে গড়ে তুলছে এক উগ্র জাত্যাভিমান দালাল গোষ্ঠী।
বাইরের অর্থ, বাইরের শ্রম, বাইরের কাঁচামাল পুঁজিবাদের বিকাশ ও গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যাকে লেনিন বলেছিলেন পরজীবী (Parasite)। এতসব সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদ মুমূর্ষু কারণ ১) অসম প্রবূৃদ্ধির ফলে কোথাও না কোথাও সংকট বা স্থবিরতা লেগে থাকবে প্রবৃদ্ধি একটানা হবেনা, ২) অসম প্রবৃদ্ধির কারণে সাম্রাজ্যবাদী অন্তর্বিরোধ এড়ানো যাবে না, ৩) সাম্রাজ্যবাদী বিশালাকার উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যক্তিগত মালিকানা ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাবে না, ৪) মুষ্টিমেয় মালিকের সঙ্গে শ্রমিক জনগণের দ্বন্দ্ব এড়ানো যাবে না ৫) নিজ দেশের শ্রমিক শ্রেণীকে কিছুটা কিনতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত তা পারবে না, যার সবগুলি লক্ষণই আজ সুষ্পষ্টভাবে বিদ্যমান। ফলে তিনটি মৌলিক দ্বন্দ্ব- পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব, নয়া উপনিবেশিক দেশগুলির ব্যাপক জনগণের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব এবং বাজার ও প্রভাব বলয় নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্য আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব- এই তিনটি মৌলিক দ্বন্দ্ব আজ অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ক্রিয়াশীল।
পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে অতি উৎপাদন জনিত সংকটের ফলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই ও লে-অফ এর কবলে পড়ে তাদের চাকুরী হারিয়েছে। অতি মুনাফার লোভে ব্যাংক, বীমা ও বিভিন্ন মর্টগেজ কোম্পানীগুলি যাদের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নেই তাদেরকে ঋণ দিয়েছে।
কিন্তু যখন ঋণ পরিশোধের সময় আসে তখন তা শোধ করতে না পারায় রিয়েল এস্টেটকে ঘিরে যে বুদবুদ সৃষ্টি করেছিলো সেটাই বর্তমান সংকটের সৃষ্টি করে ক্রমান্বয়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্যাংক, বীমা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলি দেউলিয়া হয়ে যায়। নব্য উদারনীতি বা বিশ্বায়ন অতি মুনাফার লোভে ফাটকাবাজ লগ্নীপুঁজিকে মুক্তকচ্ছ করতে সাহায্য করেছে। ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শ্রমশোষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংসের মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত সৃষ্টির চিরাচরিত কাঠামোর মধ্য দিয়ে যখন পুঁজিবাদীদের আরও বেশী মুনাফা ক্ষুধা মেটাতে ব্যর্থ হয়, তখন তারা অর্থনীতির মূলভিত্তিকে স্থানান্তরিত করে আর্থিক ক্ষেত্রে ফাটকা কারবারের দিকে। একে বলে অর্থনীতির আর্থিকীকরণ বা ‘ফাইনান্সিয়ালাইজেশন’ অব ইকনমি। বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও বিভিন্ন পরিসেবার উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ এর পরিবর্তে ফাটকাবাজী উদ্দেশ্যে পুঁজিকে ব্যবহার করা হয়েছে।
ইনভেস্টম্যান্ট ব্যাংক, হেজফান্ড, পেনশন ফান্ড ইত্যাদির মাধ্যমে এ কাজ করা হয়েছে। বিনিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক ক্ষেত্রে নব আবিষ্কারের নামে অত্যন্ত জটিল ও অস্বচ্ছ ব্যবস্থাদি যেমন ফিউচারস, অপশন, সোয়াপ্স, সিডিও (Collateral Debt Obligation) ইত্যাদির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ফাটকাবাজী চলতে দেওয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থাগুলির দাম সেই সময় বেলুনের মত ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলম্যান্টের হিসাব অনুসারে নিয়ন্ত্রিত বেচাকেনার বাইরে এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে বেচাকেনার পরিমাণ ২০০৭ সালে ৫৯৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। যা সারা বিশ্বে মোট আভ্যন্তরীণ পুঁজির (৫৪ ট্রিলিয়ন ডলার) দশ গুণের বেশি।
এই ফাটকাপুঁজি বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটিয়েছে, শক্তির বাজারে দ্রুত মুনাফার লক্ষ্যে এ ধরনের হেজ ফান্ডের মাধ্যমে তেলের আগাম (Future) বাজারে বিনিয়োগ এর মাধ্যমে তেলের দাম ২০০৮ সালের জুনে ব্যারল প্রতি ১৪৭ ডলারে পৌঁছে দেয়। বুশ ঐ সময় তেলের দাম বাড়ার জন্য চীন ও ভারতের শক্তির চাহিদা বৃদ্ধিকে দায়ী করেছিল। ২০০৮ এর অক্টোবরে যখন বিশ্বের বাজারে মন্দা ঘনীভূত হতে শুরু করল তখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারল প্রতি ৭০ ডলারে নেমে এসেছিল। এর থেকেই পরিষ্কার হয় যে, তেলের দাম বাড়ার পেছনে প্রকৃত চাহিদা অপেক্ষা ফাটকা পুঁজির খেলাই ছিল প্রবল। একইভাবে ২০০৮ সালে খাদ্যবাজারেও এই ফাটকা পুঁজির কারণেই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পায়।
কার্ল মার্কস ধনতন্ত্রের অসামান্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছিলেন ‘‘যথেষ্ট মুনাফায় পুঁজিবাদ সাহসী, ১০% মুনাফার নিশ্চিত হলে সে যেকোন স্থানে বিনিয়োগে রাজি, ২০% মুনাফা হলে তার আগ্রহ আরো বাড়বে, ৫০% হলে তার স্পর্ধা দেখা দিবে, ১০০% হলে কোন আইন ভাঙ্গতে দ্বিধা করবে না। আর ৩০০% হলে এমন কোন অপরাধ নেই যা সে করতে দ্বিধা করবে না, এমন কোন ঝুঁকি নেই যা সে নিবে না, এমনকি তার জন্য যদি নিজেকে ফাঁসিতে ঝুলাতে হয় তাও’’ ইতিহাস মার্কসের সেই কথারই আজ শ্র“তিধ্বনি করছে। ফাটকাপুঁজি তার পতন জেনেও মুনাফাতাড়িত অবস্থায় উপরি বর্ণিত অপরাধগুলি করেছে এবং আজ তার পতন ডেকে এনেছে।
এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদকে রক্ষার জন্য তথাকথিত মুক্তবাজারী দর্শন এর বিপরীতে জাতীয়করণের পথ গ্রহণ করে বেসরকারী ব্যাংক, বীমা এবং মর্টগেজ সংস্থাগুলিকে জাতীয়করণের মাধ্যমে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথম দফায় বেল আউট এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ডলার প্রদান করে পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষার চেষ্টা ব্যর্থ হলে পুনরায় ‘প্রণোদনা প্যাকেজ’ হিসেবে লক্ষ লক্ষ ডলার বাজারে ছেড়ে সংকট কাটানোর চেষ্টা করে।
ফাটকাবাজীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়না। সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আজ ব্যাপক শ্রমিক জনগণের বিরুদ্ধে কঠোর কৃচ্ছ্রতা সাধন নীতির মাধ্যমে শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরির হার কমানো, পেনশন ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি কাটছাট করে দরিদ্র জনসাধারণের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলছে। এই ঘৃণ্য প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে শ্রমিক জনতা যখনই রুখে দাঁড়াচ্ছে, তখনই সরকার ও মালিকগণ বর্ণবাদ, অভিবাসী, উগ্রজাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই OSLO এর ঘটনা ঘটানো হয়েছে। Brevik কোন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি নয়।
সারা ইউরোপ আমেরিকা জুড়ে শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব বিস্ফোরণ এর দিকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে একক সুপার পাওয়ার আমেরিকার ডলার আধিপত্য পতনোন্মুখ।
পৃথিবীর সববৃহৎ অর্থনীতি ও একক সুপার পাওয়ার আমেরিকা আজ বাজেট ঘাটতি ও বাণিজ্য ঘাটতির Twin Deficit এর ফলে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ঋণগ্রস্থ দেশ। ২০১১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকার ঋণ করার কোটা ১৪.২ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১৬.৬ ট্রিলিয়ন বৃদ্ধির অনুমোদন পাওয়ার ৩ দিন পরই স্ট্যান্ডার্ড এন্ড পুওর আমেরিকার ক্রেডিট রেটিং (ঋণমান) একধাপ নিচে নামিয়ে দেয় অর্থাৎ AAA থেকে AA তে নামিয়ে দেয়, যা আমেরিকা ১৯৪১ সালে অর্জন করেছিল। এর সহজ অর্থ দাঁড়ায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ ঋণ পরিশোধের স্বক্ষমতার দিক থেকে জি-৭ এর অন্যান্য দেশ যেমন বৃটেন, কানাডা, জার্মানি ও ফ্রান্স এর নিচে নেমে যায়।
এর ফলে ডলার বাজারের অস্থিরতা নেমে আসে। চীন সঙ্গে সঙ্গে ডলার রিজার্ভ এর পরিবর্তে অন্য কোন নিরাপদ মুদ্রা রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে রাখার পক্ষে মত দিয়েছে এবং বৃটেনের বাণিজ্যমন্ত্রী পরোক্ষভাবে তাকে সমর্থন দেয়। এর ঠিক পূর্বে ইউরোপের ইতালি ও স্পেনের কৃচ্ছ্রতার দিকে যাওয়ার খবরের আতঙ্কে সারা বিশ্বে স্টক মার্কেট থেকে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯২৯ সালে Wall Street Crash- এ ঠিক এভাবেই বিশ্ব স্টক মার্কেটে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। যাকে তারা Black Thursday নামে অভিহিত করে এবং বিশ্ব মহামন্দার সূচনা বলে গণ্য করে।
এসবই নির্দেশ করে পুঁজিবাদ আজ বিপন্ন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কথা ভাবা ভুল হবে যে ধনতন্ত্র শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড একদিকে মুক্তবাজার বলছে অপর দিকে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে পুঁজিবাদকে রক্ষা করা ইত্যাদি কারণে শ্রমজীবী মানুষের সামনে এই ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেছে। এই মুহুর্তের কাজ হচ্ছে লগ্নী পুঁজির এই সংকটের কারণকে তুলে ধরা এবং পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের পরিণতি এবং সমাজতন্ত্রই বিকল্প জনগণকে বোঝানো। লন্ডনের রাস্তায় গত সপ্তাহে যা ঘটলো তা পুঁজিবাদী নিউলিবারেল ব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলিকেই প্রকাশ করেছে।
দ্বিতীয় মূল দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, ১৯৯১ সালে সংশোধনবাদী সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর আমেরিকার নেতৃত্বে যে একমেরু বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তা দ্রুতই ক্ষীয়মান হচ্ছে। চীন রাশিয়ার নেতৃত্বে BRICK-এর পর SCO আজ ন্যাটো জোট এর মুখোমুখি। ডলারের আধিপত্য (৬/৮/২০১১ ইং তারিখে আমেরিকার ক্রেডিট রেটিং নিচে নেমে যাওয়ার কারণে) থাকছে না। এই টাল মাটাল অবস্থা আন্তর্জাতিক ভারসাম্যকে বিনষ্ট করে দ্বিমেরু বিশ্ব ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যা অচিরেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
যে কারণে বাজার ও প্রভাব বলয় নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বকে তীব্র করে তুলছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে অর্থাৎ সংকট মুক্তির লক্ষ্যে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের দিকে যাবে। এজন্য দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করে বিপ্লবের দিকেই এগুবে।
সাম্রাজ্যবাদী দেশের সাথে নিপীড়ত জাতি ও জনগণের দ্বন্দ্ব নয়া উপনিবেশিক বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদ তাদের সংকটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে গণ জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র আরব দুনিয়া আজ উত্তাল।
সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট স্বৈরাচারী শাসকগণ যারা এতদিন জনগণের সম্পদ, তেল-গ্যাস সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠন এর পথ সুগম করে দিয়ে নিজেদের গদি রক্ষা করেছিল তার বিরুদ্ধে সৃষ্টি হয়েছে গণজাগরণ। এ গণজাগরণের মূল লক্ষ্য সাম্রাজ্যবাদ ও তার সৃষ্ট স্বৈরাচারী শাসকেরা। জনগণের আন্দোলনের ফলে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের বাছাই করা স্বৈরাচারী শাসকদের পরিত্যাগ করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণামূলকভাবে তাদেরই বাছাইকরা এজেন্টদের বসানোর চেষ্টা করছে। সেসব দেশের জনগণ সাম্রাজ্যবাদী শয়তানির বিরুদ্ধে সজাগ ও সচেতন। নয়া উপনিবেশিক বিভিন্ন দেশে ক্রমেই জনগণের মুক্তি সংগ্রামের পথ অগ্রসর হচ্ছে।
ঐ সকল দেশসমূহের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের যে আন্দোলন ঐ সকল আন্দোলন ও আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের প্রভাব বিদ্যমান। লিবিয়াতে গাদ্দাফিকে উৎখাতের জন্য ন্যাটো জোটের বিমান আক্রমণ এর বিরুদ্ধে রাশিয়া, চীন কিংবা সিরিয়া সম্পর্কে আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী রুশ-মার্কিন বিরোধ প্রকাশ্য। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশে সংকটের মাত্রা যত তীব্র হবে ততই তাদের সংকটের বোঝা নিজ দেশের ও নয়া উপনিবেশিক দেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়ে সংকট মুক্তির চেষ্টা করবে। যার বিরুদ্ধে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং পুঁজিবাদী দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ক্রমেই বিকল্প হিসেবে সামনে আসছে।
তাই বলা যায় যে মুনাফা নির্ভর বিশ্বায়িত পুঁজির এই সংকট এক সুসময়েরও ডাক শোনাচ্ছে ।
-অনিরুদ্ধ রায় ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।