পর্ব---১ স্বপ্ন চূড়া- ১--- তারেক মাহমুদ
পর্ব---২ স্বপ্ন চূড়া-২--- তারেক মাহমুদ
পর্ব---৩ স্বপ্ন চূড়া- ৩--- তারেক মাহমুদ
পর্ব---৪ স্বপ্ন চূড়া- ৪--- তারেক মাহমুদ
আজও প্রচন্ড শীতে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল । মোবাইল অন করে সময় দেখলাম পোনে ৪টা বাজে । চার পাশে কাঁথা খোঁজলাম……….. পেলাম না। জ্যাকেট গায়ে জরিয়ে বসে রইলাম । বেশ কিছু সময় বসে থাকার পার শেষ রাতের বগালেক দেখার জন্য জানালাটা খুললাম ।
আরে সুবাহানআল্লাহ্…. আল্লাহ্ তুমি আমারে একি দেখাইলা…সামনে লেক, লেকের পর বিশাল বিশাল পাহাড় আর এরপর অবাক করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক রূপালী চাঁদ । পাহাড়ী ঝর্ণার মতো করে যেন চাঁদ থেকে আলো ঝরে পরছে লেকের পানিতে । নীলচে আলোয় লেকটা ভরে আছে, মনে হচ্ছে মায়াবী এক যাদুর দেশে চলে এসেছি । আমার ক্যামেরা বের করে ছবি তুললাম । কিন্তু আমার ক্যামেরায় তোলা ছবিতে চাঁদকে চন্দ্র বিন্দুর ফোটার মত লগছিল।
ছবি তুলতে না পেরে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। রুমের বাহিরে এসে চুপ চাপ বসে বসে চাঁদের ডুবে যাওয়া দেখলাম । মন খারাপ তাই ঘুমও আর আসবেনা । রুমে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম এলামের অপেক্ষায় ।
মোবাইলেই এলামের শব্দ শুনে হালকা ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসলাম।
ব্রাশ নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম, আধাঁর এখনো কাটেনি । গতকাল রাতে যে পাথর গুলোর মাঝে বসে আড্ডা দিয়েছিলাম দাঁত ব্রাশ করার জন্য সেখানে গিয়ে বসলাম । বেশ কিছুটা সময় নিয়ে দাঁত ব্রাশ করলাম । এরপর লেকের পানিতে মুখ হাত ধূয়ে উপরে উঠে এলাম । সবাইকে ডেকে তুললাম ।
শামিম ভাই জানাল সে কেওকারাডং যাবেনা । গতকাল শামিম ভাই কে বিষন্ন লাগছিল আর আজ কেওকারাডং যাবে না বলে জানাল বুঝতে পারছিনা সে কি মনোবল হারিয়ে ফেলল । একে একে সবাই ফ্রেশ হয়ে বের হবার জন্য তৈরি হলাম । রুম থেকে বের হয়ে নিচে লারামের দোকানের সামনে উপস্থিত হলাম । আর এর মাঝে টিচাররা চলে আসল ।
আমাদের বের হতে হতে ৭টার উপরে বেজে গিয়েছিল ।
আমরা গির্জার পাশ দিয়ে পাহাড়ের পাড় ঘেসে সুরু একটা পথ ধরে হাঁটা দিলাম পূর্ব দিকে । আমরা দ্রুত পা চালাচ্ছি । কারণ সূর্য্য উঠে এলে পাহাড়ে হাঁটা কষ্ট কর হয়ে উঠবে । এই পথটাও গাড়ির জন্য তৈরি করা ।
তবে আগের মত খাড়া ছিলনা । আমরা আস্তে আস্তে উপরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি । মনা ভাই জানালেন এই পাহাড়ের পরে একটা পাড়া পরবে ওখানে একটা দোকান আছে ওখানে আমরা হালকা পাতলা কিছু খেয়ে নেব । হাঁটছি তো হাঁটছি পাহাড় আর শেষ হয়না আর ঐ পাড়াও আসছেনা । আর এদিকে ক্ষুধায় পেট চু চু করছে ।
তবে হাঁটতে তেমন কষ্টই (একটু) হচ্ছিল না । এভাবে কিছুদূর যাবার পর আমরা গাড়ীর রাস্তা রেখে হালকা ঘন জঙ্গলের ভিতরে একটা ট্রেইল ধরে হাঁটা দিলাম । রোদের আলো এখনো আমাদের ধরতে পারেনি । গাড়ির রাস্তা ছেরে জঙ্গলের রাস্তায় হাঁটার কারনে আমরা আর ঐ গ্রাম বা দোকানের পাশ দিয়ে যেতে পারবনা তাই বেশ কিছুটা জঙ্গল পথে হাঁটার পর আমরা সবাই বসলাম ব্রেক ফাস্টের জন্য ।
ব্রেকফাস্টের মেনু ছিল বিস্কুট ও পানি ।
খাওয়া দাওয়া শেষে বিস্কুটের প্যাক বকর ভাইয়ের ব্যাগে ভরে নিলাম আর একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার হাঁটতে লাগলাম । পথটা ছিল পাথুরে আর ঝোপ ঝারে ভরা । হাঁটতে বেশ ভাল লাগছিল অন্তত গতকালের থেকে । হঠাৎ আমাদের পথ রুখে সমনে এসে দাঁড়াল এক বাচ্চা গয়াল । গয়াল আমাদের দেখে কিছু সময় গুল গুল চোখে তাকিয়ে ছিল এর পর পাহাড়ের গাঁ বেয়ে ধাপপুর ধুপপুর করে সুজা নেমে গেল জঙ্গলা পাহাড়ি ঢালে ।
কিছু দূর হাঁটার পর দূর থেকে এক ঝিরির শব্দ আমাদের কানে এসে রিনিঝিনি শব্দে বেজে উঠল । আমরা মনে অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি । এরপরের পথটা ঢালু হয়ে ঝিরিতে নেমে গেছে । আমরা আস্তে আস্তে ঝিরির দিকে এগুচ্ছি । ঝিরির কাছে আসার পর মনটা খারাপ হয়ে গেল ।
এখানে পানির পরিমান খুবই কম । ঝিরিকে পিছনে ফেলে আমরা আবার উপরের দিকে উঠতে লাগলাম । উপরে উঠেই পাহাড়ের বাঁক । আর চারপাশে পাহাড়ি বাঁশ ফুল । পথটা ছিল নুরি পাথরে ভরা আর তার উপরে ছিল শুকনো বাঁশ পাতা ।
একটু সাবধানে পা ফেলে আমরা সামনের দিকে এগুচ্ছি । এরপর বেশ কিছু পাহাড় চড়াই উতরাই করে আমরা আবার হাজির হলাম এক ঝিরির কাছে । এই ঝিরিটা বেশ বড় আর বিশাল বিশাল পাথরে পরিপূর্ন । এই ঝিরির পানি আসছিল বেশ উপর থেকে এক ছোট সুন্দর এক ঝর্ণা থেকে, আমি শুনেছিলাম বগালেক থেকে কেওকারাডং যাবার পথে চিংড়ি ঝিরি নামে একটি সুন্দর ঝর্ণা আছে । আর এটাই সেই চিংড়ি ঝর্ণা কিনা আমার জানা নাই ।
আমরা ঝিরির পাশেই বসে পাঁচ মিনিটের ব্রেকে নিলাম । আমাদের খালি হয়ে যাওয়া পানির বোতল গুলো ঝর্ণার পানিতে ভরে নিলাম । ঝিরি থেকে উপরে উঠার পথটা একটু এবরু থেবরু ও একটু খাঁড়া ছিল আমারা সাবধানে পা ফেলে আস্ত আস্তে উপরে উঠে এলাম । এভাবে কিছু সময় পাহাড়ি জঙ্গলে হাঁটার পর আমরা আবার সেই গাড়ির রাস্তায় উঠে এলাম । আবার সেই ঢালু পথ বেয়ে উপরে উঠা; ওঁহ… কি যে কষ্ট তা শুধু আমরা কয়েক জন ছাড়া আর কেউ মনে হয় জানে না ।
আজ আমার থেকে বেশি ক্লান্ত হয়েছে রাকিব ভাই । বেচারা আজ আমার থেকে অনেক পিছনে পরে রয়েছে । পেছনের গ্রুপে ইস্তি, জাকারিয়া, আমি আর রাকিব ভাই অন্যতম ।
এভাবে হেঁটে হেঁটে আমরা এক সময় চলে দাজিলিং পারায় । দার্জিলিং পাড়ার পরেই কেওকারাডং ।
এই পাড়া থেকেই কেওকারাডং এর চূঁড়া দেখা যায় । আর তাই এই পাড়াকে কেওকারাডং পাড়া নামেও ডাকা হয়। এই পাড়ার এক দোকানে আমরা চানাচুর, বিস্কুট আর পাহাড়ি কফি খেয়ে আমরা আমাদের খালি হয়ে যাওয়া বোতল গুলি পানি ভরে আবার হাঁটা দিলাম । কিছুদূর যাবার পর দূরে কেউক্রারাডং এর চূড়াঁর উপরে পর্যটকদের জন্য আর্মিদের তৈরি ছাউনি দেখতে পেলাম । মনে হল ৫ কি ১০ মিনিটের ভেতর আমরা কেওকারাডং এর চূঁড়ার চলে যেতে পারব ।
চার পাশের পাহাড়, প্রকৃতী দেখতে দেখতে আমরা আবার পেছনে পরে গেলাম । আমার অনেক আগে চলে গেল ইস্তি ও জাকারিয়া আর আমার পেছনে অন্য কাউকে দেখতে পেলাম না তার মানে আমিই সবার পেছনে । এবার আমি দ্রুত পা চালিয়ে ইস্তিদের ধরে ফেললাম । ইস্তি আমার কাছে রাকিব ভাইয়ের কথা জানতে চাইল । আমি বললাম আমার পেছনেতো কাউকে দেখতে পেলাম না, মনে হয় উনি সামনের দলের সাথে আগে চলে গেছে ।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমাদের আবিস্কার করলাম কেওকারাডং পাহাড়ের পাশে আর এর মাঝে ১৫-২০ মিনিট সময় চলে গেছে । ইট সিমেন্টের বাঁধানো পাকা সিড়ি বেয়ে স্বপ্ন চূড়া কেউক্রারাডং এর চূড়ায় উঠে এলাম । উপরে উঠেই পথের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল, মন ভরে গেল এক অনাবিল আনন্দে । চারিদিকে দৃষ্টি দিলাম; চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য, বাংলার পড়তে পড়তে এত সৌন্দর্য লুকিয়ে ছিল যা বান্দরবান না এলে আমার দেখা হতো না । শামিম ভাইয়ের জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল ।
বেচারা আহত সৈনিকের মত পরে আছে বগালেকে । আগে যদি জানতাম বগালেক থেকে কেউকারাডং এর রাস্তায় তেমন কষ্ট হবে না তাহলে শামিম ভাইকে জোর করে ধরে নিয়ে আসতাম ।
উপরে মনা ভাই সৌম্য ভাই তাদের ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন, বকর ভাইকে দেখলাম শুকরানা নামাজ পরতে । আর বাকিরা ছাউনির নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে । চূঁড়ার উপরে পাথরের তৈরি দুইটা ফলক দেখতে পেলাম ।
প্রথমটা উন্মোচন করেছিলেন ইস্টবেঙ্গলের এক মেজর আর দ্বিতীয় ফলকটা উন্মোচন করেছেন লেফট্যানেন্ট্ আরিফ, যিনি কেওকারাডং আরহদের জন্য নিজ খরচে এই ছাউনি তৈরি করে দিয়েছেন । প্রথম ফলকে কেউক্রারাডং এর উচ্চতা ৩১৭২ ফিট উলেক্ষ করা আছে । আর জিপিএস এ রিডিং পাওয়াগেছে ৩২৩৩± ফিট।
ছাউনির গায়ে মার্কার পেন দিয়ে অনেক হাবিজাবি লিখে রেখেছে ব্রাক ইউনিভার্সিটির ফিল্ম ক্লাবের কিছু ইডিয়েট । ছাউনিকে এখন আর ছাউনি মনে হচ্ছেনা, মনে হলো একটি গোয়াল ঘর।
ব্রাক ইউনিভার্সিটির ফিল্ম ক্লাবের কিছু গরুকে মনে হয় এখানে বেঁধে রাখা হয়েছিল। আর পাহাড়ের চার পাশে ময়লার স্তুপ দেখতে পেলাম ।
শুরু হলো পর্বত আড়হিদের নিয়ে ফটোশেসন । ফটোশেসন এর মাঝে দেখি রাকিব ভাই মাত্র উঠে আসছে !!! কি রে ভাই আপনি কই গেছিলেন ?
ছবি তোলা শেষ করে আমরা বিস্কুট, রুটি ও কমলা খেয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি আর মনা ভাই তার মোবাইলে আমাদের মিনি ভিডিও ইন্টারভিউ নিলেন । কেউক্রারাডং এর চূঁড়া থেকে নেমে যাবার আগে আশেপাশে ছরিয়ে ছিটিয়ে থাকা অপচনশিল ময়লাগুলো কুড়িয়ে মনা ভাই ও বকর ভাইয়ের ব্যাগে ভরে নিলাম ফেরার পথে দার্জিলিং পাড়ায় এসে পুরিয়ে ফেলার জন্য ।
এর পর বিজয়ী সৈনিকের আনন্দ নিয়ে স্বপ্ন চূড়া কেওকারাডং থেকে নেমে এলাম । মনা ভাইকে জানালাম এবার আমি একটু আস্তে আস্তে হাঁটবো, আপনারা টেনশন নিয়েন না । পিছনে পরে রইলাম বান্দরবানের প্রকৃতীর নেশায় । এই অপার সৌন্দর্য ফেলে আমার ফিরতে ইচ্ছে করছে না । কিন্তু উপায় নেই, তাই ক্যামেরার সাটার রিলিজ করছিলাম একের পর এক ।
ছবি তুলতে তুলতে দার্জিলিং পাড়া চলে এলাম বিশ্রাম খাওয়াদায়া ও ফটোশেসন শেষে আবার হাঁটা দিলাম সবাই এক সাথে । এভাবেই একসময় চলে এলাম বগালেক… বান্দরবান… চট্টগ্রাম… ঢাকা । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।