যেতে চাও যাবে, আকাশও দিগন্তে বাঁধা, কোথায় পালাবে!
(রাজনীতি বিমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং আরো দুএকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ তরুণী একটা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল । সেই তরুণ তরুণীদের অংশ হিসাবে কয়েকটি পর্বে তুলে ধরার চেষ্টা করব তাদের স্বপ্ন খুনের সত্য ঘটনা ) প্রথম পর্ব - স্বপ্নের শুরু
কি কি কাজ করা হবে এবং কিভাবে করা হবে তা ঠিক হবার পর আমরা সবাই মাঠে নেমে পড়লাম পরবর্তী প্রোগ্রাম শুরু করবার আগে । প্রথমেই ডাক্তারদের কাছ থেকে জেনে নিলাম বস্তিবাসীদের জন্য আমাদের কি কি ওষুধ বেশী দরকার । এরপর ঘুরতে শুরু করলাম বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীগুলিতে ওষুধ গুলি জোগাড়ের জন্য । দেখতে দেখতে বেশ ওষুধের বেশ ভালো দরের একটা স্টক দাড়িয়ে গেল ।
শুরু হলো নতুন উদ্যমে বস্তিতে সাপ্তাহিক (পরবর্তীতে মাসিক) চিকিৎসা সুবিধা দেবার কার্যক্রম ।
নাম পরিবর্তন
প্রথমে সাময়কিভাবে আমাদের সংগঠনের নাম "ষ্টুডেন্টস ফোরাম" রাখা হলও নাম নিয়ে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করলো । অনেকে একে "যুব ফোরাম" "ছাত্র ফোরাম" এর সাথে গুলিয়ে ফেলায় ঠিক হলো নাম পরিবর্তনের । কিন্তু সুবিধাজনক নাম পাওয়াতো দুস্কর । তারপর একদিন কার্জন হলের পরীক্ষা হলের সামনে মিটিং করতে করতে আমি প্রস্তাব করলাম Students Humanitarian Effort in Bangladesh এবং সংক্ষেপে SHEBA যেটি বাংলাতে উচ্চারণ দাড়াবে "সেবা" ।
যেহেতু আমাদের স্বপ্নে সমগ্র বাংলাদেশ ছিল এবং আমরা মুলত ছিলাম একটি মানবতাবাদী সংগঠন তাই নামটি কয়েকজনের আপত্তি সত্বেও টিকে গেল । সংগঠনের শ্লোগান ঠিক হলো "মানবতার সেবায় ছাত্ররাই অগ্রণী" ।
এবার অনেক গোছালোভাবে কাজ শুরু করলাম । সংগঠনের গঠনতন্ত্র ঠিক করা হলো । নতুন পরিপূর্ণ কমিটি গঠন করা হলো ।
আমি হলাম সভাপতি, প্রাণীবিজ্ঞানের ফারহানা রুমা হলো সাধারণ সম্পাদক, ফার্মেসীর সুজন সাহা হলো সহ-সভাপতি, প্রাণীবিজ্ঞানের নুরুল বাশার সরকার হলো ট্রেজারার, একই বিভাগের সুমি হলো দপ্তর বিহীন (আমরা তখন মাঠে ঘাটে মিটিং করি) দপ্তর সম্পাদক আর ঢাকা মেডিকেল কলেজের আয়েশা সানিয়া হলো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা বিষয়ক সম্পাদক। আমরা নতুন গঠনতন্ত্র আর কমিটি সায়ীদ স্যার, মনজুরুল ইসলাম স্যার, মোজাফফর স্যার, হাসান স্যার সবাইকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিলাম। এইবার শুরু হলো কাজে ঝাপিয়ে পড়া ।
বস্তিতে চিকিৎসা সুবিধা
প্রথমে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে শুরু করলেও পরে ডাক্তারের স্বল্পতায় আমরা বাধ্য হলাম মাসিক ভিত্তিতে কার্যক্রমটি চালাতে । ঢাকা মেডিকেল ও সলিমুল্লাহ মেডিকেলের কিছু ইন্টার্নি ডাক্তারদের আমাদের মতই নেশায় পেয়ে গিয়েছিল ।
দিনের পর দিন একের পর এক বস্তিতে যাচ্ছি । মানুষের সাড়া আর ভালবাসা দেখে আমাদের নিয়মিত কাদতে হয়, কত সামান্যে যে মানুষ খুশী হয় সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয় । একটা প্রোগ্রামের পর আমরা কয়েকজন মিলে ফলোআপে যাই । খোজ নেই গত প্রোগ্রামে আসা নতুন মা হওয়া কিশোরী মেয়েটির যে সন্তানটি পাচদিন ধরে জ্বরে ভুগছিল, ওষুধ দেবার পর সে এখন কেমন আছে? কিংবা সেই যে বৃদ্ধ চাচা যার প্রতি রাতে জ্বর আসে, এখনও কি তার জ্বর আসে? এই রকম হাজারো রোগী আমাদের আপনজন হয়ে যান । আমাদের দেখে মুখ আলো করে ছুটে আসেন ।
মুখের উজ্জলতা দেখেই বুঝি ভালো হয়ে গেছে, আবার কারো মলিন মুখ এখনও রোগে হয়তো কষ্ট পাচ্ছে । আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করে আবার কবে আসবো? ঠিক যেমন পরিবারের কাউকে জিজ্ঞাসা করছে ।
দেখা গেল বস্তিতে ৯০ ভাগ রোগ অপুষ্টি আর স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে । কিছু কমন এন্টিবায়োটিক, গ্যাসের ওষুধ, প্যারাসিটামল এইজাতীয় ওষুধেই কাজ হয়ে যাচ্ছে । কয়েকটি বস্তিতে যাবার পর খেয়াল করলাম সব ছোট ছোট ছেলে মেয়ে পেটফোলা ।
পেট ভর্তি কৃমি । তারপর থেকে শুরু করলাম আলাদা করে কৃমির ওষুধ বিতরণ । এক একটি শিশু হাতে একটি কৃমির ওষুধ পেয়ে এমন করত যেন ওর হাতে একটা বিশ্বকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে । ওষুধ গুলো একেকটা আলাদা স্ট্রিপের মধ্যে থাকতো আর খেতেও কিছুটা চকলেটের মত চুষে খেতে হয় । সেই দৃশ্য দেখে মনে হতো আহারে আমার অনেক টাকা থাকলে এদের প্রত্যেককে একটা করে বড় চকলেটের প্যাকেট কিনে দিতাম ।
মাঝে মাঝে অনিয়মিত হলেও পাচ বছর ধরে চললো আমাদের এই বস্তিতে যাবার কার্যক্রম । বন্ধ হলো স্বপ্ন খুন হবারও এক বছর পরে ।
এসিড নিক্ষেপের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি
প্রথম আলো তখন এসিড নিক্ষেপের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে দেশব্যাপী কার্যক্রম চালাচ্ছে । আমরা যোগাযোগ করলাম প্রথম আলোর সাথে । তখন এই ব্যাপারটি দেখছেন সুমনা শারমীন আর আনিসুল হক ।
দীর্ঘ আলাপ হলো তাদের সাথে । তাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করলাম এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের মনিরা রহমানের সাথে । আমরা শুরু করলাম আমাদের মত করে কর্মসূচী । আমরা এসিড নিক্ষেপের ভয়াবহ দিক তুলে ধরে একটা লিফলেট ছাপালাম । তারপর একটা ব্যানার লিখে শাহবাগ, প্রেসক্লাব (তখনও প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করা যেতো) এর সামনে মাইকে এসিড নিক্ষেপের ভয়াবহতার ব্যাপারে কথা বলে সামনে দিয়ে যাওয়া রিকশা আর বাসের যাত্রীদের সাথে একটা করে লিফলেট ধরিয়ে দিতাম ।
এই লিফলেট দেওয়া নিয়েও কম বিব্রত হতে হয়নি আমাদের । দেখা যেত আমাদের পাশেই হয়ত কেউ মঘা ইউনানীর লিফলেট বিলি করছে । ফলে রিকশা/বাস যাত্রীদের অনেকেই লিফলেট না পড়েই ফেলে দিতো । যত্ন করে সেই লিফলেট তুলে আবার গুছিয়ে রাখতাম । অনেকে অবশ্য মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারতো ।
তারা ফেলে না দিয়ে ঠিকই পড়তো ।
এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর ঠিক করলাম একটি বড় আকারের কিছু করবো । শহীদ মিনারে একটা প্রোগ্রাম করলাম যেখানে এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন থেকে তিনজন এসিড দগ্ধ নারী আমাদের সাথে সহযোদ্ধা হিসাবে যোগ দিলেন। বর্ণনা দিলেন তাদের উপরে চলা পাশবিকতার । একইভাবে একটা বড় প্রোগ্রাম করলাম টি এস সি থেকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত Rally , তারপর সেখানে মানববন্ধন ও সমাবেশ ।
এবারও আমাদের সাথে যোগ দিল এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন । আবারো সংগ্রামী সেই তিন নারী । তাদের বর্ণনা শুনতে শুনতে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরেছে আমাদের আর সেই চোখের জলে শপথ নিয়েছি এসিড সন্ত্রাসী শকুনদের প্রতিরোধের। আমাদের সেই প্রোগ্রাম প্রথম আলো সহ প্রায় সব পত্রিকায় ছবি সহ আসলো । আমরা যত্ন করে সেইসব পোর কাটিং সংগ্রহ করে রাখতাম ।
এরপর আমাদের চারুকলার বন্ধুদের সহায়তায় এসিড আক্রান্তদের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য পেইন্টিং প্রদর্শনী করলাম । প্রাপ্তদ অর্থ দিলাম প্রথম আলোকে । তারপর এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথভাবে করলাম একটা চলচ্চিত্র উৎসব । মজার অভিজ্ঞতা । আমরা নির্বাচন করলাম সত্যজিতের চলচ্চিত্র, চাকার মতো ছবি ।
হল খালি । আমাদের কাছে খবর পাঠানো হলো হিন্দি ছবি আর ইংরেজী মারদাঙ্গা ছবি না চালানো হলে হল খালিই থাকবে । আমাদের লক্ষ্য যেহেতু এসিড দগ্ধদের জন্য তহবিল সংগ্রহ তাই সত্যজিত বন্ধ, চললো নতুন নতুন সব হিন্দি ছবি । প্রথম দুইদিনের ব্যর্থতা কাটিয়ে অডিটরিয়াম পূর্ণ । আমরা মোট ২৬ হাজার টাকা তুললাম সব খরচ বাদ দিয়ে।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান আসলেন, শিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা আসলেন । আসিস ভাই আসতে পারলেননা। মতি ভাইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হলো টাকা । প্রথম আলো আর চ্যানেল আই কাভার করলো । এখন সাথে রিপোর্টের কপি নেই ।
তবে বাংলাদেশে আছে ।
এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইট থেকে সংবাদটির একটি লিংক । Film Festival to Help Acid Victims
মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে আমাদের এই কার্যক্রম চললো স্বপ্ন খুনের আগ পর্যন্ত ।
পরিবেশ সচেতনতায় আন্দোলন
পরিবেশ নিয়ে আমাদের চিন্তভাবনার আশ্রয় স্থল হিসাবে পেলাম বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনকে । আর এর সুবাদেই কাছে আসতে পারলাম অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, ড, বদিউল আলম মজুমদার আর আবু নাসের খানদের মত স্বপ্ন দেখানো মানুষদের ।
পলিথিন নিষিদ্ধ আন্দোলন, খাদ্যে ভেজাল বিরোধী আন্দোলন, জলাভূমি ভরাট এর বিরুদ্ধে আন্দোলন, বুড়িগংগা বাচাও আন্দোলন, শব্দ দূষন বিরোধী আন্দোলন, গুলশান লেক ভরাটরে বিরুদ্ধে আন্দোলন এরকম লিখে শেষ করা যাবেনা এরকম অজস্র আন্দোলনে পরিবেশ আন্দোলনের সহযোদ্ধা হলো "সেবা" । বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কিবরিয়া ভাই, বুড়িগঙ্গা বাচাও এর মিহির বিশ্বাস, এশিয়া প্যাসিফিক এর ড. মাহবুব হোসেন সবার সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠলো আমাদের । আমাদের "সেবা" এর উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিলো পরিবেশ আন্দোলনের অন্তর্গত নানা সংগঠন । সেবা তালিকাভুক্ত হলো পরিবেশ আন্দোলনের সহযোগী একটা সংগঠন হিসাবে ।
বড় মজার ছিলো সেই সব দিনগুলি যদিও মাঝে মাঝে সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করে নিয়ে যাওয়াটা একটা কষ্টের ব্যাপার ছিলো।
পরিবেশ আন্দোলনের প্রায় সব প্রোগ্রামই হতো হঠাত নোটিশে এবং শুক্রবার সকালে। নাসের ভাই এর মত কাজপাগল লোক খুব কম দেখেছি । ফোনে কথা হতে হতে মাথায় আইডিয়া পরবর্তী শুক্রবার শাহবাগের সামনে প্রোগ্রাম । মিরাজ তোমার ছেলে মেয়েদের নিয়ে হাজির থেকো । এভাবেই হয়েছে অনেক আন্দোলন।
এখন প্রতি শুক্রবার ছেলে মেয়েরা সব কাজ কর্ম বাদ দিয়ে রোদের মধ্যে দাড়িয়ে থাকবে কেন? তারপরও দেখা যেত আমরাই সবচেয়ে বড় গ্রুপ ।
মানুষও মজা পেত আমাদের (পরিবেশ আন্দোলনের) কাজে। অধিকাংশ প্রোগ্রামই হতো শাহবাগ মোড়ে । দেখা যেত লোকজন রিকশা করে যাচ্ছে আর অবাক হয়ে দেখছে এইসব ছেলেমেয়ের কি কোন কাজকর্ম নেই? পোষ্টার ব্যানার হাতে প্রতি শুক্রবার এখানে দাড়িয়ে থাকে আর কি কি বলে । মানুষের দৃষ্টিতে কৌতুহল, তাচ্ছিল্য, বিরক্তি সবই টের পেতাম ।
এটাও ছিল একটা আলাদা রকমের ব্যাপার । মানুষের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপারগুলিকে মানুষ কিভাবে দেখছে । এটা নিয়ে আমরা আলোচনাও করতাম ।
পরিবেশ আন্দোলন আর পরিবেশ নিয়ে "সেবা" এর আন্দোলনের অনেক রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল পত্রিকায় । মিডিয়া এই ব্যাপারটিতে সব সময়ই গুরুত্ব দিয়েছে।
মাঝে মাঝে দেখা যেত আমরা যারা ব্যানার নিয়ে দাড়িয়ে আছি তাদের সংখ্যা আর ফটোসাংবাদিকদের সংখ্যায় খুব বেশী হেরফের নেই । সেই সব সংবাদের পেপার কাটিং যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম ।
পরিবেশ আন্দোলনের সাথে আমাদের কয়েকটি লিংক (অনলাইন থেকে কয়েকটা খুজে পেলাম, তাও শুধু ইংরেজী সংবাদ পত্রের)
লিংক ১
লিংক ২
লিংক ৩
লিংক ৪
লিংক ৫
লিংক ৬
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।