পর্ব--- ১ স্বপ্ন চূড়া-১ --- তারেক মাহমুদ
পর্ব---৩ স্বপ্ন চূড়া- ৩--- তারেক মাহমুদ
পর্ব---৪ স্বপ্ন চূড়া- ৪--- তারেক মাহমুদ
পর্ব---৫ স্বপ্ন চূড়া- ৫--- তারেক মাহমুদ
ভোরের কুয়াশা ভেদ করে আমরা ঘন্টা দুয়েকের মাঝেই বান্দরবান এসে পৌঁছালাম । বাস থেকে নেমে রিক্সা নিয়ে আমরা চলে এলাম রুমা যাওয়ার চাঁন্দের গাড়ির স্টান্ডে ।
অভাগা যে দিকে তাকায় সাগর শুকিয়ে যায় । আমরা চান্দের গাড়ি পেলাম না । রাজপূন্যাহ অনুষ্ঠানে এলাকার কারবারি/গ্রাম প্রধানরা সবাই চাঁন্দের গাড়ি নিয়ে গেছে ।
আমাদের এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে তাই আমরা চাঁন্দের গাড়ীর অপেক্ষা না করেই বাসে করেই রওনা দিলাম বলিপাড়ার উদ্দেশ্যে । এই পথে গত এক-দেড় বছর ধরে নাকি বাস চালু হয়েছে।
আমাদের বাস আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে ছুটে চলল এক পাহাড় রাজ্যের পথ ধরে দিগন্তের দিকে । আমদের গ্রুপের প্রায় সকলেই ছিলাম বাসের সামনের দিকে। চারিদিকের প্রকৃতি দেখে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল।
প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার আসার পর মিলন ছড়িতে আমার দৃষ্টি আটকে গেল শংখের বাঁকে। সবুজ পাহাড়ের বুকে চিড়ে আছে মায়াবী এই শংখ । নদী ও পাহাড় মিশে গেছে আপন ভালবাসায় । যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়, নীল আকাশ, দূরে পাহাড়ের গাঁ ঘেঁসে যাওয়া সাদা মেঘের ভেলা আমাকে মুগ্ধ করেছে । আর যখনি নিচের দিকে তাকাই তখনি দেখি আমাদের গাড়ির রাস্তার গাঁ বেয়েই ঢালু পাহাড় নেমে গেছে হাজার খানেক ফুট নিচে ।
বান্দরবান টু রুমার রাস্তাটা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে ।
এই রাস্তাটা যেমনি সুন্দর, তেমনি ভয়ানক । কখনও ডানে কখনো বা বায়ে মোড়, আবার কখনো আকাশের পথে কখনো বা পাতালের পথে । আমার কাছে মনে হচ্ছে আমরা সবাই একটি রোলার কোস্টারে বসে আকাশ ভ্রমণ করছি । আর যদি আমাদের রোলার কোস্টার একটু এদিক সেদিক হয় তাহলে সোজা নিচে এবং তার পর সোজা উপরে চলে যেতে হবে।
সৌম্য ভাই জানালেন আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের দলেরা এই অসাধারন সুন্দর রাস্তাটি তৈরি করেছেন । সী লেভেল থেকে এর উচ্চতা প্রায় দেড় হাজার/ আড়াই হাজার ফিট উপরে, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উপরের হাইওয়ে । এর নাম দেয়া হয়েছে ‘পিক ৫৯’।
এভাবেই কখন যে আমরা চিম্বুকের ওয়াই (Y) জাংসন এর কাছে চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি ।
আমাদের বাস দশ মিনিটের জন্য চিম্বুকের ওয়াই জংসনে এসে থামল চেকিং এর জন্য ।
এখানে বিডিয়ারের একটি ছোট দোকান আছে । আমরা এখানে নেমে দূরে পাহাড়ের কিছু ছবি তুললাম । সৌম্য ভাই ও রাকিব ভাই এখান থেকে সিংঙ্গাড়া ও বয়েল করা কিছু ডিম কিনে নিলেন । এখানে আমি একটা বিষয় খেয়াল করলাম- বিডিয়ারদের রেস্টুরেন্টে দুই টাকার ভংতির পরিবর্তে ওরা কাস্টমারের হাতে চকলেট ধরিয়ে দিচ্ছে।
আমাদের বাস আবার চলতে শুরু করল ।
আমরা বাসে বসে সিংঙ্গাড়া ও ডিম সাবার করে দিলাম। এভাবেই আমরা দুপুরের দিকে বলিপাড়া বাজারে এসে পৌঁছলাম। আমরা বাস থেকে নেমে কিছু দূর আসতেই বাসের চাকা পাংচার হবার বিকট শব্দ কানে ভেঁসে এলো। আমি মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই এই বলে আমাদের এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, যদি চাকা আরো আগে পাংচার হতো তবে আমাদের আরো অনেক দেরি হতো । আর এদিকে সকাল নয়টার ভেতর মনা ভাইয়ের বলিপাড়া বাজারে এসে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকার কথা ।
আমরা বাজারে এসে একটি দোকানে আমাদের ব্যাগ প্যাক রেখে মনা ভাইকে খুঁজতে লাগলাম । আমরা কেউ তাকে খুঁজে পেলাম না । আর এটি কথা এখানে মোবাইলের কোন নেটউয়ার্ক নেই । কিছু এন্টেনা লাগিয়ে ওয়্যারলেস ল্যান্ড ফোন ব্যাবহার করছে । সৌম্য ভাইয়ের ধারনা ছিল মনা ভাই যে ল্যান্ড ফোন থেকে যোগাযোগ করেছিল সেটা এই বাজারের কোন নাম্বান।
তাই সেই নাম্বারে ফোন দেয়া হল। কিন্তু জানা গেল এই নাম্বারটি বলিপাড়ার নয় এটি হচ্ছে থানছি বাজারের । কি আর করা এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন গতি নেই । তাই আমাদের দলের নামাজিরা পাশের এক মসজিদে চলে গেল জুম্মার নামাজ আদায় করতে । এই ফাঁকে আমরা বাজারটা ঘুরে দেখছিলাম ।
বাজার ঘুরে আমরা একটা ছোট হোটেলে (রেষ্টুরেন্ট !) ঢুকে পরলাম। এখানে আমরা সিংঙ্গারা, জিলাপি ও রস পুরি নামে এক মিষ্টি খাবার খেলাম যার স্বাদ আজো আমার মুখে লেগে আছে। খেতে খেতে থানছি বাজার থেকে একটা চাঁন্দের গাড়ি আসল বলিপাড়া বাজারে । আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম দেখতে মনা ভাই এসেছে কিনা । কিন্তু না এই গাড়িতে মনা ভাই নেই।
এর কিছু সময় পরে নামাজিরা নামাজ পরে বাজারে চলে আসল। এবার সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা এখন দুপুরের খাবার খাব আর এর মাঝে যদি মনা ভাই না আসে তবে আমরা থানছি দিকে রওনা দিব ।
ঐ হোটেলেই দুপুরের খাবর খেলাম, মেনু ছিল ভাত, মাছ আর ডাল। যদিও খাবারের মান তেমন (মোটেই) ভাল ছিল না । কি আর করা এখানেতো আর কেউ হাজীর বিরীয়ানী নিয়ে বসে নেই ।
যা ছিল তাই খেলাম। ভাত শেষে চা-র অর্ডার দেওয়া হল । চা খেতে খেতে মনে হচ্ছিল এটা কি আসলে চা ! নাকি অন্য কিছু ?
চা পর্ব শেষ করে উঠার সময় আরেকটা চাঁন্দের গাড়ি এলো বাজারে । আমরা হোটেলের বাহিরে এসে দাঁড়ালাম। মনা ভাই এবার এসেছে কিনা দেখার জন্য কয়েক দোকান আমরা সকলেই ডু মারলাম।
সামনের ফোনের দোকানে আমরা মনা ভাইকে পেয়ে গেলাম সাথে ছিল আরেক ক্রেজি ট্রেকার রাতুল ভাই । তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে নিলাম । রাতুল ভাই আজি ঢাকা ফিরে যাবেন তাই রাতুল ভাইকে বিদায় দিয়ে মনা ভাই তরি-ঘরি করে খেয়ে নিলেন । এরপর তিনি আমাদের প্রোগ্রামটা ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন। আমরা থানছির বলিপাড়া বাজার থেকে একটি অপ্রচলিত এক ট্রেইল দিয়ে উল্টো দিক দিয়ে হেঁটে কেওকারাডং রেঞ্জে প্রবেশ করব ।
আমরা প্রথমে বলীপাড়া থেকে বগালেক যাব। মাঝে আমরা চ্যামা খাল নামে এক আদিবাসীদের পাড়ায় রাত্রী যাপন করব । এর পরের দিন আমরা খুব ভোরে উঠে বগালেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিব । এরপর বগালেকে রাত্রী থেকে পর দিন সকালে চলে যাব স্বপ্নের কেওকারাডং এর চূঁড়ায়।
ঘড়িতে সময় দুইটার উপরে ।
মনা ভাই কয়েকজন আদিবাসী কে জিজ্ঞাসা করে জানে নিলেন আমাদের পথের দিক নির্দেশ, যদিওবা অনেকে আমাদের পাগল ভেবে হাসা-হাসি করছিল । আমরা দশ ট্রেকার পা বাড়ালাম আমাদের আপন গন্তব্যে । পাহাড়ে খুব দ্রুত অন্ধকার নেমে আসে তাই আমাদেরও দ্রুত পা চালাতে হবে । তবে আধাঁর নেমে এলেও আকাশে চাঁদ উঠে আসবে আমাদের সংঙ্গী হতে । যাই হোক আমরা যে ট্রেইল ধরে হাঁটছি তার শুরুর দিকেই পার হতে হল সাঙ্গু নদী।
পানি অনেক কম । আমি নদীর দুই পারে দেখলাম বর্ষায় এই নদীর পানি কতো উপরে উঠতে পারে। আমার মনে হল বর্ষায় নদীর পানি প্রায় ২০-২৫ ফিট উপরে উঠে আসে। আমরা এই নদী পার হলাম ছোট্ট লম্বা এক কাঁঠের (এক গাছের) নৌকা দিয়ে।
নৌকায় মনা ভায়ের সাথে আলাপ হল সুভাষ ত্রিপুরা নামের একভদ্র লোকের সাথে।
তিনি টিন্ডুর আদিবাসী এক স্কুলের শিক্ষক । তার কথা শুনে মনে হল তিনিও আমাদের সাথে কিছু পথ এগুবেন। এরপর নদীর পাড় ধরে বেশ কিছু পথ যাবার পর আমরা আস্তে আস্তে উপরে উঠতে লাগলাম । খুব বেশি উপরে উঠতে হইনি আমাদের । কিন্তু আমার ব্যাগ এর কারনে আমার অবস্থা কাহিল।
আশেপাশের পরিবেশটা সুন্দর ছিল, তাই মনে জোর পেলাম । ছোট ছোট টিলা, জুম ক্ষেত, পাহাড়ের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে চলা সাঙ্গু দেখতে দেখতে সামনের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি দ্রুত গতিতে । জুম ক্ষেতের ভেতর দিয়ে কিছুদূর আসার পর আমরা সবাই ছোট বাঁশের লাঠি নিলাম ।
একে একে বেশ কয়েকটা ছোট বড় পাহাড়, পাড়া আর অনেকটা পথ পিছনে ফেলে আমরা চলে এসেছি নিবেদিতা কুমারী মারিয়ার ধর্ম পল্লীর সমনে । এখানে দাঁড়ালাম ।
মনা ভাই এদিক সেদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলেন একজন গাইড, যিনি আমাদের পৌছে দেবে চ্যামা খাল। আমরা আজ রাতেই চ্যামা খাল পৌঁছতে চাই শুনে সুভাষ দা আমাদের বললেন আপনাদের আজ চ্যামা খাল পৌঁছতে আনেক রাত হয়ে যাবে । আর গভীর রাতে পাহাড়ি বনের ভিতর দিয়ে চলাফেরা করাটা নিরাপদ হবেনা । আপনারা চ্যামা খাল না গিয়ে মুঙ্গোহা পাড়া নামে ত্রিপুরাদের একটি গ্রাম আছে, ওখানে আমার শশুর বাড়ীতে রাত কাটাতে পারেন। আমরা সবাই রাজি হয়ে গেলাম।
এই নিবেদিতা পাড়া থেকে আমরা আস্তে আস্তে নেমে গেলাম এক ঝিরি পথে । আমাদের ট্রেকে এটাই প্রথম ঝিরি । আসরের নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় শামিম, মেহেদী ও বক্কর ভাই ঝিরির পানিতে অজু করে পাশেই এক শুকনো জায়গায় নামাজ পড়ে নিলেন। এই ঝিরি পথে আমরা আধ-ঘন্টার মত হেঁটেছি । এরপর আমরা অল্প একটু পথ উপরে উঠে এলাম ।
এবারের পথটা মোটামুটি সমতল তাই তেমন কষ্ট হচ্ছিল না । এরপর আমাদের কিছুটা পথ নিচে নামে আস্তে হল । বেশ ভালই লাগল নিচে নামতে কিন্তু সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল এক পাহাড়ি পথের এক বাঁক । আমাদের এই বাঁক বেয়ে উপরে উঠতে হবে। উপরে উঠতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল ।
শরীল ঘেমে গেছে, নাক ও মুখ দিয়ে সমানে জোরে জোরে নিঃশ্বাস পরছে, একটু পর পর পানি খাচ্ছি । আর মনে মনে বলছিলাম “আল্লাহ্ বাঁচাও আমারে, সৌম্য মিয়ার পোস্ট পইড়াতো লাফাইতে লাফাইতে চইলা আইলাম, এখনতো রস পরে” ।
……..এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে আমি অনেক পিছনে পরে রইলাম । আস্তে আস্তে যখন উপরে এলাম দেখি সবাই বসে বিশ্রাম নিচ্ছে । আমি মনে মনে আনন্দ পেলাম এই ভেবে যে, যাক এবার একটু বসে বিশ্রাম নেয়া যাবে ।
একি আমাকে দেখে সবাই উঠে হাঁটা শুরু করল । মনা ভাই বলল সবাই উঠেন, অন্ধকারে পাহাড়ে হাঁটা কষ্টকর হয়ে যাবে।
মনা ভাই আমাকে বিশ্রাম নিতে দিলনা । মনা ভাইয়ের উপর খুব রাগ হল, কিছু সময় তাকে মনে মনে বকা ঝকা করলাম । কি আর করা, আমরাই যখন তাকে দলনেতা বানিয়েছি কথাতো শুনতেই হবে তাই বাধ্য হয়েই হাঁটতে লাগলাম ।
তবে এবারের পথটা একটু ভাল । আস্তে আস্তে নিচে নেমে যাচ্ছি, ইস্ সব রাস্তা কেন এরকম হয়না ।
অনেকটা পথ চরাই উতরাই করে যখন দু’তিন পাহাড়ের পরে ছোট একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে, গ্রামটা দেখতে সুন্দর লাগছিল । আমার মনে পরম শান্তি দোলা খেল । এই বুঝি সুভাষদার শশুর বাড়ী চলে এসেছি ।
কিন্তু আমার সকল শান্তিকে অশান্ত করে সুভাষ দা জানালেন এটা মুরংদের গ্রাম রামদু পাড়া । মনা ভাই ও সৌম্য ভাই আমাদের সবাইকে সাবধান করে দিলেন এই বলে, মুরং নারীরা টপ লেস পোষাক পরে । কেউ ছবি তুলতে যাবেন না । ওরা বাঙালীদের সাথে তেমন একটা খাপ খায়ে চলতে পারেনা, চুপ চাপ সোজা হেঁটে চলেন ।
এই পাড়ায় প্রথমেই আমাদের স্বাগত জানাল পাড়ার এক উঠতি নেতা … ঘেউ.উ..উ…উ… ঘেউ…ঘেউ. উ.. উ ।
পাড়ার কুকুরকে মনে হল আমাদের দেখে সে মহা বিরক্ত, শুধু ঘেউ… ঘেউ… করছে । ছোট ছোট বাচ্চারা মহা উৎসাহ (নাকি কৌতুহল!) নিয়ে আমাদের দেখতে লাগল । আমার মনে হল এরা কোনদিন সমতলের বাঙালী দেখেনি । আমাদের মাঝ থেকে সৌম্য ভাই তাদের কাছে পানি চাইল । তারা আমাদের দিকে পানি পাত্র বাড়িয়ে দিল ।
আমরা পানি পান করলাম ।
এর মাঝে সূর্ষটা যাই যাই করে চিম্বুকের কোলে ঢলে পড়ল । আর অপর পাশ দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাল এক ফালি রুপালী চাঁদ । মনে মনে ভাবছি এই অন্ধকারে কখন যে বন্য শুকুর আমাদের তারা করবে আর তখনি হবে আসল এ্যাডভ্যাঞ্চার । আমরা সকলেই টর্চ বের করে আবার হাঁটতে লাগলাম ।
আধাঁর এখনও আমাদের পিছু নেইনি । আমরা যে ট্রেইল ধরে হাটছি এটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে । চাঁদের আলোয় পথটা এখনো দেখা যাচ্ছে । তাই আমি টর্চ জালাচ্ছিনা । কারন যে এলাকায় আমরা যাচ্ছি সেখানে বিদ্যুৎ এর ব্যাবস্থা নেই ।
আর আমার টর্চটা চার্জ দিতে হয় । আস্তে আস্তে আমরা জংগলের অনেক গভীরে চলে এসেছি । চাঁদের আলো এখন আর নিচে পরছেনা । চারদিক আস্তে আস্তে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আসছে তাই টর্চ জালিয়ে পথ চলতে হচ্ছে । এই অচেনা জঙ্গলে আমরা কয়েক জন ট্রেকার ছাড়া আর কেউ নেই ।
পায়ের নিচে নুরি পাথর, ঝরা পাতার মড় মড় শব্দ আর অনেক দূরে হরিনের মায়াবী ডাক আর বন্য জন্তু জানোয়ারের ভয় । আমরা এখন যে ট্রেইল ধরে হাঁটছি তার ডান পাশে ছিল খোলা খাঁদ । নিচে টর্চ ধরেই আঁতকে উঠলাম । টর্চের আলো নিচ পর্যন্ত যাচ্ছেনা । আর আমরা যে পথ ধরে হাঁটছি সেটা বড়জোর এক ফুটের মত ব্যাস হবে ।
পা একটু এদিক সেদিক হলেই….
এভাবেই আমরা হেঁটেছি ঘন্টা দুয়েক । এর পর আমাদের কাংক্ষিৎ শশুর বাড়ী দেখা পেলাম সামনের কয়েকটা পাহাড়ের উপরে । শশুর বাড়ীটা মুঙ্গোহা পাড়ায় অবস্থিত । আমরা আস্তে আস্তে মুঙ্গোহা পাড়ায় চলে এলাম । সুভাষ দা তার শশুর বাড়ীর লোকদের সাথে কথা বলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন ।
আমরা সবাই ব্যাক প্যাক রেখে কাপড় চেঞ্জ করে বিশ্রাম নিচ্ছি । ব্যাগ প্যাক নামানোর পর বুঝতে পারলাম আমার কাঁধ প্রচুর ব্যাথা হয়ে আছে । কাঁধের ব্যাথায় আমি হাত নারাতে পারছিলাম না । আর এই ফাঁকে মনা ভাই আমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছেন । তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।
যাকে আমি রাস্তায় মনে মনে বকা-ঝকা করেছি আর সেই কিনা নিজের বিশ্রামের কথা ভুলে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছে । বাড়ীর বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম তাদের পানির উৎস এই পাহাড়ের পাদদেশে, আর এর জন্য আমাদের পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নামে যেতে হবে । তারা জানালো, তাদের ব্যাবহারের জন্য তারা পানি উপরে এনে রেখেছে; আমাদের সেই পানি ব্যাবহার করতে বলল। কিন্তু তাদের কষ্ট করে বয়ে টেনে আনা পানি নষ্ট করতে ইচ্ছে করলনা আমাদের। আমার গোসল করতে খুব ইচ্ছা হচ্ছিল তাই আমি, জ্যাক, মেহেদী ও শরিফ পাহাড়ের গাঁ বেয়ে নিচে চলে এলাম সাথে নিয়ে এলাম পথে শেষ হয়ে যাওয়া পানির খালি বোতল।
আমরা পাহাড়ের গা বেঁয়ে অনেকটা নিচে নেমে আসার পর পানির দেখা পেলাম। উপরে কোন এক ঝিরি থেকে পাইপের মাধ্যমে এখানে পানি নিয়ে আসা হয়। মেহেদী ওজু করল, জাকারিয়া হাত মুখ ধূয়ে নিল। চারিদিক অন্ধকার, হালকা চাঁদের আলো । এর মাঝে আমি পানির পাইপের নিচে বসে পড়লাম ।
উয়াও! (ওরে বাপরে!) কি ঠান্ডা । তিন কি চার মিনিট আমি পানির পাইপের নিচে ছিলাম । এরপর কাঁপতে কাঁপতে পানি থেকে উঠে এলাম । গোসল করে মনে হল শরীলের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে এক অনাবীল প্রশান্তি সারা শরীলে বয়ে যাচ্ছে । এর পর শরিফ ভাই গোসল সেরে নিল ।
গোসল শেষে আমরা আস্তে আস্তে উপরে উঠে এলাম। উপরে উঠার সময় বুঝতে পারলাম আমরা অনেক নিচে নেমে এসেছিলাম । সারাদিনের ক্লান্তির পর এখন উপরে উঠতে মনে হচ্ছে এযেন এক বিশাল পথ । এই পথ যেন আর শেষ হবেনা । আমি মাঝে একবার দাঁড়ীয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিলাম ।
মনা ভাই বাড়ীর উঠানে আমাদের জন্য নুডলস্ রান্না করছে । তার চারপাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমিও সেখানে সামিল হলাম । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশে অনেক তারা। সৌম্য ভাই কাকে কাকে যেন আকাশের তারা দেখাচ্ছে ।
মাথার উপর আকাশটা এত বিশাল ও এত কাছে ছিল যে নির্দিধায় খুজে পেলাম বৃষ, প্রজাপতি আর কাল পুরুষতো চোখের সামনেই থাকে সব সময় । তারা দেখা বাদ দিয়ে মনা ভাইকে টর্চ জালিয়ে রান্নায় সাহায্য করলাম ।
খাবার তৈরি হয়ে গেছে, এবার ঘপা ঘপ খাবার সাবার করার পালা । আমাদের যে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে তার এক পাশে আমরা আর এক পাশে বাড়ীর লোকজন বসে আমাদের দেখছে । মনা ভাই ও বকর ভাই আমাদের মাঝে খাবার ডিস্ট্রিবিউসন করছেন ।
প্রথমে এ বাড়ীর লোকজনদের খেতে দিলেন এরপর আমাদের । আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজ নিজ প্লেট ধুয়ে ফেললাম । আমাদের অব্যবহারিত পলি ব্যাগ একত্রিত করে আগুনে পুরিয়ে ফেলা হল । এরপর বাড়ীর বাচ্চাদের হাতে চকলেট ও খেজুর দেয়া হল । ঘুমিয়ে পরার আগে মনা ভাই আগামীকালের প্ল্যান বুঝিয়ে দিলেন, কাল ঘুম থেকে উঠতে হবে ভোর সাড়ে চারটায় ।
আর সকালের সকল কাজ এক ঘন্টার মাঝে শেষ করে আমরা বের হয়ে যাব সকাল সাড়ে পাঁচটায় । এবার ঘুমানোর পালা… আমি মোবাইলে এলাম দিয়ে দিলাম । এরপর আমরা সকলেই ফেলে আসা সেই সব দুর্গম পথের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম এক চমৎকার ভোরের আশায় । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।