নিরন্তর
শাশ্বত নিপ্পন
চান মিঞা যখন তার জমির পাশে এসে বিষণ্ণ দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়াল তখন বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পড়েছে। জমি বলতে ধলকা মাঠের দশ কাঠা ধানি জমি। মনোহরপুরের জমিতে ধানই ফলে বেশি। নব গঙ্গা নদীর পলিতে গড়া এই গ্রামের চারপাশে ধু ধু সবুজ আর সবুজ। যে দিকেই দৃষ্টি যায়, শুধু ধান আর ধান।
বছরে এখানে চার বার ধান ফলে। অবশ্য চান মিঞা পায় তিন বার। কারণ বর্ষার সময় কোথা থেকে ভেসে আসা পানির অতলে কোথায় তলিয়ে যায় চান মিঞার এই নিচু দশকাঠা তা হদিস পাওয়া ভার। তখন অন্য কাজ করে পেট চালায় চান মিঞা। তারপরও জমিই তার অন্নপূর্ণা; চাষই তার পেশা।
এবার কিন্তু তার ব্যতিক্রম। খরা চলছে। মনোহরপুরের উর্বর মাঠে এবার সবুজ ধানের সমারোহ নেই। চারদিকে শুধু ধূসর বিবর্ণতার জয়জয়কার। মাঝে মাঝে দু’এক ফালি জমিতে সবুজ ধান ফলেছে গতবারের মত।
চান মিঞার দশ কাঠাতে গজিয়ে ওঠা ধান গাছগুলো এর মধ্যেই কুঁকড়ে গেছে। আকাশে বৃষ্টি নেই; দোকান বাজারে ডিজেল নেই; আর থাকলেও তা কেনার সাধ্য দরিদ্র চাষির নেই। তাই সেচও নেই। শহরে এ সব নিয়ে আলোচনা চলছে অনেক। এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান সাহেবেরা অনেক ব্যস্ত; রাতদিন তাদের ঘুম নেই।
সবই নাকি গত সরকারের কারসাজি, তারপরও আলোচনা চলছে--- আর ধলকার মাঠে দশ কাঠা ভুঁই-এ গজিয়ে ওঠা ধান গাছ গুলো কুঁকড়ে যাচ্ছে; বাড়ছে চান মিঞার সুদের টাকা; ধানের মত বিবর্ণ হচ্ছে চান মিঞার দৃষ্টি। হঠাৎ ঘাড়ের কাছে সুগন্ধ নিঃশ্বাসে চান মিঞা চমকে উঠে। অত্যন্ত আদরে চান মিঞার ঘাড়ে হাত রেখে আলহাজ্ব মোঃ দলিল উদ্দিন বলে উঠে-
এবার ধান কেমন হল রে চান মিঞা; মুখ বড় শুকনো লাগে? শরীর ভাল তো?
একেরপর এক প্রশ্ন গুলো করে হাজী সাহেব আরো নিবিড় হয় চান মিঞার সাথে। সফেদ পাঞ্জাবি, দামি লুঙ্গি; মাথায় টুপির সাথে কাঁচাপাকা দাড়িতে অপূর্ব মানায় দলিল উদ্দিন সাহেবকে। তার ঘাড়ের উপর পড়ে থাকা হাজী গামছাটা হাজী সাহেবের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে চারগুণ।
চান মিঞা আরো একটু বিব্রত হয়ে ওঠে। হাজী সাহেব সম্মানী লোক; আশপাশের দশ গায়ে তার বিস্তর নাম ডাক। এখনো মাঠে তার চাষের জমি আছে আশি/নববই বিঘার উপর। বাজারে দুটো তেলের গোডাউন। শহরে ইসলামিক দলের সংগে আছে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
মিন মিন করে চান মিঞা বলে উঠে, ‘‘মারা যাব; সংসারের সবাইকে নিয়ে এক সাথে মারা যাব; না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরব এবার। ’’
হাজী সাহেব কোমল হেসে প্রতিবাদ করে-
ছিঃ তওবা কর; এখনই তওবা কর; এসব বেদ্বীনের বুলি শোনাও গোনাহ!
ধানের বীজ নিছি ধারে; বৌ ছেলে মেয়ের পেটও চলছে ঋণের পয়সায়। তেলের অভাবে এক বালতি পানিও জমিতে দিতে পারিনি; আকাশে মেঘের রেখাও নেই। মাঠের ধান মাঠেই শেষ হয়ে যাচেছ।
আল্লাহ্ মেহেরবান।
তিনি চাইলে পাথরেও ফুল ফোটে, জালেমও আলেম হয়।
তারপরও ফি-বছর তো আমরাই মরি; প্রতি রাতেই রাহেলার মা-রাই পেটের যন্ত্রণায় কাতরায়।
হাজী সাহেব কিছুটা ধমকের সুরেই বলে উঠে-
তবুও তওবা কর; মরা বাঁচা তাঁর হাতে: হায়াত রিযিক কেবল তাঁরই হাতে। ঐ সুদখোর হায়াত খাঁর ক্ষ্যামতা কি মানুষের জান নেয়!
গত বছর মনোহরপুরের ঈদ্গা মাঠে ধর্মসভা বসেছিল সন্ধ্যার পর। সুদূর মাগুরা থেকে এক যুবক আলেম এসেছিল ওয়াজ নসিয়ত করতে।
তিনিও এসব কথাই বলেছিলেন আর রাত কাটিয়েছিলেন হায়াত খাঁর বাড়ীতে। তার আগের বছর গোয়াল পাড়ার বিধবা ইনদু বুড়ি কে সন্ধ্যার পর ধলকা মাঠের পুব পাড়ে গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। গ্রামের সবাই জানে হায়াত খাঁর সাথে জমি-জমা আর সুদের হিসাবের জের নিয়েই এই খুন। প্রমাণ নেই যথেষ্ট তাছাড়া বিধবা বুড়ির তেমন কেউ নেই তাই মামলাও হয়নি। তবুও ‘‘জানের মালিক আল্লাহ পাক’’-এ কথা চান মিঞাকে বিশ্বাস করতেই হয়।
হাজী সাহেবের কথাগুলো সেই সভার বয়ান এর প্রতিধ্বনি বলে মনে হয় চান মিঞার কাছে।
হাজী দলিল উদ্দিন বলে চলে, আকাশের পানি আল্লাহ-নিয়ামত; মরু দেশে বৃষ্টি নেই তাদের জানে শান্তিও নেই; আল্লার দিলে যখন রহম হবে; তখন আপনা থেকেই পানি নামবে।
পানি না আসুক, বড় বিটা আমরা চার পুরুষ ধরে আপনাদের মানি- একটু ত্যাল জুগাড় করে দ্যান জমি তে একটু পানি দি; ধান গুলান বাঁচুক; সম বছরের খোরাক তো !
তোর এইটুকু জমিতে পানি দিতে কতটুকু আর তেল লাগবে; কিন্তু আমি আল্লাহর-রাসূলের দেশ ঘুরে আসার পর থেকে আর ব্যবসায় বসি না; পেট্রল ডিজেলের কথা সঠিক জানিও না।
চান মিঞা অবাক বিস্ময়ে হাজী সাহেবের সম্মোহনী মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। পড়ন্ত বেলার মৃদু বাতাসে হাজী সাহেবের কানে রাখা আরব দেশের দামি আতরের খুশবু ছড়িয়ে পড়ে।
চান মিঞা প্রাণ ভরে সেই পবিত্র সুগন্ধ নিতে চেষ্টা করে। কিন্ত তার নাকে পাকা ধানের সুবাস আসে বার বার।
হাজী দলিল উদ্দিন বলে চলেন-
বুঝলি চান মিঞা পাপ, পাপ! আল্লা আল্লা কর; শুধু তিনিই পারেন পাথরে ফুল ফোটাতে। তিনি না চাইলে, গোটা আরব জাহানের সমস্ত তেল এনে তোর জমিতে ঢেলে দিলেও একটা ঘাসও জন্মাবে না- বুঝলি, আল্লা আল্লা কর।
চান মিঞা বুঝতে পারে না ফাঁকটা কোথায়।
সমস্যাটা কোন খানে। ছেলে বেলা থেকেই প্রতিবার সে রোজা করে আসছে। সেহেরী খেয়ে সারাদিন পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় ছোলা আর আরব দেশের পচা খেজুর দিয়ে রাহেলা, রাহেলার মা আর ছোট দুটো ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ইফতার খুলেছে সে। তারাবির নামাজে দাঁড়িয়ে পার করেছে অনেক সময়। তবুও রাহেলার মার পেটে ঘা-র ব্যাথা সারে না; গত বছর রাহেলা তিন বছরের শিশু কন্যার হাত ধরে তালাক নিয়ে চান মিঞার ঘরে এসে উঠেছে।
হায়াত খাঁর গদি ঘরের লাল খাতায় সুদের বোঝা ভারি হচ্ছে; আর চান মিঞার দশ কাঠা ভুঁইয়ের ধান সেচের অভাবে কুঁকড়ে যাচ্ছে। তারপরও হাজী সাহেবের কথাগুলোকে বিশ্বাস করতেই হয় চান মিঞাকে। বিশ্বাস করতেই হয় যে নানা ধরনের গোনাহর কারণে আজকে চান মিঞার এই অবস্থা। সারা বছরের আশা ভরসা চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডিজেল তো একটা উছিলা মাত্র।
হঠাৎ চান মিঞা বলে উঠে-
বড় বিটা, আরবে ধান হয়?
না।
তালি ওরা খায় কি?
উদার হাসি হেসে হাজী সাহেব জবাব দেয়-
আরে, ওরা তো ধনী; অনেক অনেক ধনী!
কিডা করেছে?
আল্লাহ্ রববুল আল-আমীন; তিনিই তো সব।
তাহলে, আমরা কার বান্দা; আমরা ক্যানে এ্যামন ধারা? ক্যানে আমাদের গরিবী ঘোঁচে না?; ক্যানে সারা বছরের আহার সম্বল মাঠেই শেষ হয়ে যায়: প্রতি রাতে শুধু রাহেলার মা-রাই কাতরায় ক্যানে?
এই বার কিছুটা অবাক হয়ে হাজী দলিল উদ্দিন তাকায় চান মিঞার দিকে। কিছুটা ধমকের সুরে বলে উঠে-
সমস্যা টা কি বলত? তোর কথায় বেদ্বীন কাফেরদের আলামত পাচ্ছি।
মাফ দ্যান বড় মিঞা; ভুল হইলে মাফ দ্যান।
আরে আমি মাফ দেওয়ার কে? মাফ দেবেন পরোয়ার দিগার। তওবা তার কাছে কর। আরে শোন; ঈমান দৃঢ় করো; তিনি মোসিবৎ দিয়ে আমাদের ঈমানের পরীক্ষা নেন। অবশ্য ঈমান- আকিদা মজবুত রাখা খুবই শক্ত।
হাজী সাহেবের বয়ান চান মিঞার কানে পৌছায় না।
পড়ন্ত বেলায় দূর থেকে ভেসে আসে শ্যালো পাম্পের ভট ভট আওয়াজ। পাম্পের এই কর্কশ শব্দটুকু চান মিঞার কানে ভারি মিষ্ট শোনায়, মনে হয় কি মন প্রাণ আকুল করা মধুর কোন ছন্দ। কোন সৌভাগ্যবান তার জমিতে সেচ দিচ্ছে; তার জমির ধানগুলো এই ঝিরি ঝিরি হাওয়ায় মৃদু দুলছে- আকুলি বিকুলি করে উঠে চান মিঞার প্রাণটা সেই পানি পাওয়া ধান গাছ গুলো দেখার জন্য। হাজী সাহেব বলে চলে-
এই বিশ্ব জাহান আল্লাহর; মুসলমানও আল্লাহর; অর্থাৎ এই বিশ্বের মালিক মুসলমানেরা। তাই বেদ্বীন নাসারা, বেধর্মী, কাফেরদের হাত থেকে এই বিশ্ব, এই দেশ, এই গ্রাম, এই পাড়াকে রক্ষা করতে হবে।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আল্লাহর শাসন কায়েম করতে হবে।
চান মিঞা আবার গত বছরের ধর্মসভার কথা মনে পড়ে যায়। আলেম সাহেবও এই সুরেই কথা বলছিলেন। সেদিন সেই সভাকে ঘিরে যে গ্রামীণ ছোট্ট মেলা বসেছিল তাকে অ-ইসলামিক বলে হুজুর উঠিয়ে দিয়েছিলেন। এসব ভাবতে ভাবতে নামাজের ওয়াক্ত এসে যায়।
হাজী দলিল উদ্দিন চান মিঞা কে ‘‘সালাতের দাওয়াত’’ দিয়ে মসজিদের দিকে এগিয়ে যান। চান মিঞা আবার উদাস হয়ে যায়। চারদিক সচকিত করে গ্রামের মসজিদ থেকে আযান শুরু হয়; কিন্তু চান মিঞা শুনতে পায় না। তার কানে শুধু শ্যালো পাম্পের ভট ভট আওয়াজই আসতে থাকে। অন্ধকার ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে মনোহরপুরকে।
এভাবেই দিন কাটতে থাকে। অনাবৃষ্টি এ বছর মনোহরপুরের পিছু ছাড়ে না। এর মধ্যে যারা চড়া দামে ডিজেল কিনে জমিতে সেচ দিতে পেরেছিল, তাদের ধানে ক্রমেই সোনালী রং ধরতে শুরু করে। গ্রামের চাষী বৌদের মধ্যে দেখা দেয় চাঞ্চল্য। এ সময় কোন যাদু মন্ত্র বলে চান মিঞার স্থবির সংসারটা চালাচ্ছে রাহেলার মা আর রাহেলা।
সংসারে হাড়ি চড়ার কথা না, তারপরও তিন বেলা ভাত হচ্ছে; রাহেলার চুলে বাহারী রংয়ের ফিতে দোলে; গায়ে ফুল কাটা ব্লাউজ আর পাড় লাগানো সুতি শাড়ি কোথা থেকে আসে- জেনেও জানতে চায় না চান মিঞা। এখন তার দিন কাটে নাতনীর দেখ-ভাল করে। মেহেরপুরের ধান কলে কাজ নিয়েছে রাহেলা। প্রতি সকালে মেহেরপুর যাওয়ার সময় সে বলে-
আববা তোমার জন্য কিছু আনতে হবে?
চান মিঞা কিছুই বলে না। রাহেলা এবার একটু ঝাঁজের সাথে বলে উঠে-
কথা তো বুলচ না, দরকার ন্যাই তাইলি;
আসমানির কে দ্যাক্বা বলেই রাস্তায় পা দেয় রাহেলা।
পথে যেতে যেতে খিল খিল হেসে উঠে সে। ঘরের দাওয়াই বসে চান মিঞা শুনতে পায়। এশার নামাজে দাঁড়িয়ে চান মিঞা টের পায় রাহেলা ফিরছে। রাহেলার সঙ্গের মেয়েটি খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলে উঠে-
দেখিস আর যেন নিচে না নামে।
রাহেলা উত্তর দ্যায়-
নামলেই বা ক্ষতি কি; অনেকেই তো নামল; বলেই খিল খিল করে হেসে উঠে।
চান মিঞার একাগ্রতা নষ্ট হয়। কান গরম হয়ে উঠে তার। চান মিঞা বুঝতে পারে ঈমানী পরীক্ষায় সে পাশ করতে পারছে না। তারপরও চান মিঞা দৃঢ় হওয়ার চেষ্ঠা করে। তার মনে হয়, এই নাছারার দেশে ঈমান মজবুত রাখা বড়ই কঠিন।
তার চারপাশে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের ঘটনাবলি নিশ্চুপ দেখে যায় চান মিঞা। আর নিজের সাথে কথা বলা চলে রাত দিন। নাওয়া খাওয়াও ভুলে যায় মাঝে মাঝে। নির্ঘুম রাতেও চান মিঞা বলে চলে-
আমি চাষীর বাচ্চা; চাষ আমার রক্তে,পেশা আর পরিশ্রম আমার নেশা- মাঠের ধান আমার জান, আমার প্রাণ; ওরা আমার ছেলে মেয়ের মত; আমি ওদের বাঁচাতে পারলাম না; বাপের সামনে ওরা মরে গেল পানির অভাবে- এ যেন আর এক কারবালা-
মধ্য রাতের বিড় বিড় কথায় ঘুম ভেঙ্গে যায় রাহেলার মা’র। ঝন্ ঝন্ করে বলে উঠে-
ঘুম না হয় উঠানে যাও, আমাকে একটু ঘুমাতে দাও; সকালে রাজ্যের কাজ।
আজ পূর্ণিমা না তবুও চারপাশ বেশ পরিষ্কার।
নির্ঘুম চান মিঞা দাওয়ায় উঠে বসে। হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে ভেসে আসে রাহেলার খিল খিল হাসি আর ভঙ্গুর কথালাপ-
হয়িছে হয়িছে এবার ছাড়;
ছাড়ব ক্যানে সস্তা?
‘‘সস্তা’’ না তো কি? আক্কাড় না কি ? ইস্ যেন গিলে খাবে!
খাবুই তো খাবুই তো।
খিল খিল করে হেসে ওঠে রাহেলা।
মাথার মধ্যে কে যেন হাতুড়ি পেটাতে থাকে চান মিঞার।
দম বন্ধ হতে থাকে তার; দিগ্বিদিগ জ্ঞান শুন্য হয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে চান মিঞা-
কে, কে কথা কয় ওখানে?
চান মিঞার চেঁচানিতে চারদিকে সুনসান নিরবতা নেমে আসে আর বিরক্ত হয় রাহেলার মা; বলে উঠে- কুথাই কে; চুপ করে থাক দিকিনি; সব কিছু দেখতি নেই।
চান মিঞার মনে হয় রাহেলার মা’র কথাই হয়তো ঠিক।
সব কিছু দেখতেও নেই; শুনতেও নেই। গ্রামের মসজিদে ফজরের আযান শুরু হয়। দু’একটা পাখিও ডাকতে শুরু করে; চান মিঞা বুঝতে পারে এখনই অন্ধকার কেটে যাবে; সকালের আলো ফুটবে; সব কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
সব কিছু পরিস্কার হওয়ার আগেই দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলে সে।
অতঃপর একদিন মনোহরপুর গ্রামে ধান কাটার ধুম লাগে। এবার যেন দুনিয়ার যত ধান হাজী সাহেবকে আল্লাহ দিয়েছেন। হাজী সাহেবের ধান দেখে আনন্দ পেতে থাকে গ্রামের চাষীরা। ভোর থেকে গ্রামের লোক ধান কাটতে থাকে দক্ষ হাতে।
কাজ অনেক তাই অবসরও নেই। মাঠের এক কোনে হাজী সাহেব বসিয়েছেন এক মাড়াই কল। ধান কাটার সাথে সাথে মাড়াই হয়ে বস্তা বন্দি হয়ে যাচ্ছে। জোর গলায় গান গেয়ে ধান কাটছে লোকেরা। কর্মব্যস্ততা দেখে হাজী দলিল উদ্দিন বলে উঠেন-
কাজ করো ভাইয়েরা, মন দিয়ে কাজ কর।
দুপুরে গোশত আর খেঁচুরি খাওয়াব ইন্শাল্লাহ। কাউকে অভুক্ত রেখে নিজে খাওয়া ইসলামে বারণ আছে। হাজী সাহেবের ঘোষণায় চারদিকে হৈ হৈ পড়ে যায়। এ সবই চান মিঞা বিরস মুখে দেখছিল আর একাই বিড় বিড় করে কি সব বলে বেড়াচ্ছিল মাঠের আইলে আইলে। বিকেলের দিকে হাজী সাহেবের নিজের দুটো পাওয়ার ট্রিলারসহ মেহেরপুর থেকে নিয়ে আসা আর আটটি পায়ার ট্রিলারে উচু করে ধানের বস্তা সাজিয়ে হাজী সাহেবের গোডাউন ঘরের দিকে রওনা হল।
ঠিক তখনই কি যেন হয়ে গেল চান মিঞার মধ্যে। বদলে গেল মুহূর্তে। নিজের মরিচা লাগা কাচিটা হাতে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়াল সে পাওয়ার ট্রিলারের সামনে। তারপর চিৎকার করে বলতে থাকে সে-
ধান নিয়ে কুথাই যাস তোরা? কার ধান কে নেয়? খবরদার এক পাও আর এগুবি না।
তার এই গগনবিদারী চিৎকারে সকলেই হতবিহববল হয়ে পড়ে।
হাজী দলিল উদ্দিন দৌড়ে এসে বলে উঠেন-
পথ ছাড় চান মিঞা, বেলা যায়।
চান মিঞা দাঁড়িয়েছে তার দশকাটা ভুঁইয়ের পাশে। হাতে তার মরিচা পড়া কাচি; দুচোখে আগুন। চান মিঞা আবার চিৎকার করে উঠে-
কার ধান কে নেয়? ধান দ্যান বড় বিটা, নইলে মান যায়।
দূরের আইলের কর্মব্যস্ত চাষীরা চান মিঞার চিৎকারে চমকে ওঠে।
হাজী দলিল উদ্দিন মুহূর্তে বুঝে নেয় বাতাসে বারুদের গন্ধ। সে বুঝতে পারে চান মিঞার এই চিৎকার ছড়িয়ে পড়লেই বিপদ। তাই ব্যবস্থা এখুনি করতে হবে। হাজী দলিলউদ্দিন চেঁচিয়ে উঠে-
ডাকাত, ডাকাত, বেটা দিনে দুপুরে ডাকাতি করতে চায়। ধর শালাকে।
সুমুন্দির এত বড় সাহস আমার ধানে হামলা করতে চায়।
হাজী সাহেবের ছুটে আসার আগেই ছুটে আসে তার ষন্ডা মার্কা তিন চার জন। এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে হুকুমের জন্য; মৃত্যু দূতের মত হাজী দলিল উদ্দিন হুংকার দিয়ে উঠে-
মার শালাকে; মেরে ফাটিয়ে দে; লাগলে মামলা আমি চালাব; কোর্ট কাচারী আমি সামলাব।
হুকুমের সাথে সাথেই চারখানা পাকা বাঁশের লাঠি ঝাঁপিয়ে পড়ে চান মিঞার বিগড়ে যাওয়া মাথাটার উপরে। দুর্বল চান মিঞার চোখে ধলকার মাঠটা দুলে উঠে একবার; সাথে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা।
কাটা কলা গাছের মত ধপা্স করে গড়িয়ে পড়ে চান মিঞা তারপর জবাই করা মুরগীর মত বার দুয়ের ঝাঁকি দিয়েই স্থির হয়ে যায়। তার কপাল ফেটে ফিন্কি দিয়ে রক্ত ছোটে; রক্ত চান মিঞার বুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ে তার দশ কাঠা ভুঁইয়ের মাটিতে। মাটির স্পর্শ পেয়ে তাজা লাল রক্ত ক্রমেই দানা বেঁধে শক্ত হতে থাকে। পড়ন্ত বিকেলের বাতাসে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে বিকট শব্দ করে পাওয়ার ট্রিলার গুলো এগুতে থাকে সারি বদ্ধ ভাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।