তোমার আমার ঠিকানা,পদ্মা-মেঘনা-যমুনা
বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরবময় ইতিহাস সবার সামনে তুলে ধরার জন্যই আমার এ খুদ্র প্রয়াস( ইতিহাস ও ফটো ব্লগ)।
জাদুঘর বা মিউজিয়াম শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক শব্দ ‘মউজিয়ন’ থেকে। গ্রীকদের কলাবিদ্যার দেবী মিউজেসের মন্দিরকে এক সময় মিউজিয়াম বলা হতো। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মিশরের আলেকজান্দ্রাতে টলেমি লাইব্রেরি স্থাপন করেন এবং এর নাম দেন মিউজিয়ম, অথ্যাৎ জ্ঞানের তীর্থস্থান। আলেকজান্দ্রায় তখন বিজ্ঞান ও ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বহু পুরাকৃতির সমাবেশ ঘটেছিলো।
রোমান যুগে মিউজিয়ম শব্দটি ইউনির্ভাসিটি হিসেবে পরিচিতি পায়।
আমরা তিন পাগল
ভারতের মুদ্রাতত্ত্ব গবেষক ও ব্রাহ্মলীপির প্রথম পাঠ উদ্ধারকারী জেমস প্রিসেপ ১৮৩৭ সালে জাদুঘর স্থাপনের প্রথম প্রস্তাব পেশ করেন। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ১৮৬৬ সালে ভারতের জাদুঘর স্থাপিত হয়। ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৩ সালের ৭ আগষ্ট। পরে ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা জাদুঘরের নাম পরিবর্তন করে জাতীয় জাদুঘর নামকরণ করা হয়।
তবে বাংলাদেশের প্রাচীনতম জাদুঘর হচ্ছে রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। বাইরে থেকে জাদুঘর ভবনটি দেখে যে ঐতিহ্যের কথা মনে পড়ে যায়, এই ভবনের ভেতর ঢুকলে সেই ঐতিহ্যগুলিকে যেন নাগালেও পাওয়া যায়। ভবনটি বরেন্দ্র যাদুঘর বলে পরিচিত। আসল নাম বরেন্দ্র গবেষণা যাদুঘর। শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া এই যাদুঘরে বড় যত্নে ঘুমিয়ে আছে প্রাচীন বাংলার হাজার বছরের গেীরবময় ইতিহাস।
বাঙালি ইতিহাস, ঐতিহ্য আর স্থাপত্যশিল্পের সবচে বড় সম্ভার এই বরেন্দ্র যাদুঘর। শুধু তাই নয় এই যাদুঘর দণি-পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি আর প্রত্নতত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা। প্রতিদিন প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন দেখতে কয়েকশ' দর্শনার্থী আসেন এখানে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রত্নসম্পদ অন্বেষণে এবং গবেষণায় এটির অবদান ব্যাপক। ১৯১০ সাল থেকে বরেন্দ্র যাদুঘরের প্রত্মসম্পদ অন্বেষণ এবং গবেষণা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দয়ারামপুরের জমিদার শরৎকুমার রায়, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অয় কুমার মৈত্র এবং রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলের শিক রমাপ্রসাদ চন্দ।
পরে তাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রামকমল সিংহ এবং কলকাতা জাদুঘরের রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তারা সকলে বিপুল পুরাকৃতি সংগ্রহ করেন।
বরেন্দ্র জাদুঘরের বর্তমান পুরাকৃতির সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। বরেন্দ্র জাদুঘরটি নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯১০ সালে এবং শেষ হয় ১৯১৩ সালে। ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এটি উদ্বোধন করেন।
দিঘাপতিয়ার রাজপরিবারের আনুকূল্যে এ জাদুঘর বঙ্গীয় শিল্পকলার সমৃদ্ধ ভান্ডারে পরিণত হয়। ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর বর্তমান ভবনটিতে বরেন্দ্র যাদুঘরের পথচলা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগ হবার পর পাকিস্তানী শাসকের বৈরী আচরণের ফলে বরেন্দ্র জাদুঘরটি আর্থিক সংকটে পড়ে। ১৯৬৪ সালে এটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে এর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধিগ্রহণ করে। এবং নতুনভাবে পরিচালনা শুরু করে।
তখন থেকেই জাদুঘরটি একটি পরামর্শক কমিটির মাধ্যমে পরিচালনা শুরু হয়। বরেন্দ্র জাদুঘর নানান কারণে সমৃদ্ধ। এখানে হাজার বছরের সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন আছে।
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs
নৃত্যরত বালিকাঃমহেনজোদারো সভ্যতা
মহেনজোদারো সভ্যতা থেকে সংগৃহীত অসংখ্য প্রত্নতত্ত্ব এবং সহস্রাধিক পাথরের ভাস্কর্য এই জাদু ঘরের অনন্য নিদর্শন যা পৃথিবীর অন্য কোন জাদুঘরে নেই। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির এই যাদুঘরে মহার্ঘ্য পুরাকীতি কষ্টি পাথর ও বেলে পাথরের মুর্তির সংখ্যাই রয়েছে আড়াই হাজারের মতো।
এখানে পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজারা বিদেশ থেকে পাথর এনে বুদ্ধের নানা মূর্তি নির্মাণ করতেন। সেই সময় পাথর কেটে মূর্তি নির্মাণ করার দক্ষ ও বিখ্যাত কারিগরও ছিল এই এলাকায়। সেন আমলে এই সব মূর্তি পুকুর-কূপ ও নদীগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়। পরবর্তীকালে এইসব মূর্তি উদ্ধার করা হয় এবং বরেন্দ্র জাদুঘরে সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়। পাল আমলের প্রস্তর মূর্তি ছাড়াও এ জাদুঘরে রয়েছে গুপ্ত আমলের অনেক প্রস্তর মূর্তি।
খ্রীষ্টিয় একাদশ শতকে নির্মিত সূর্য মূর্তি, বুদ্ধ মূর্তি, ভৈরবের মাথা, দূর্গা-মহিষ, অর্ধনারী-শিবের মূর্তি, গঙ্গা মূর্তি বরেন্দ্র জাদুঘরের অমূল্য সম্পদ। প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহের দিকদিয়ে জাদুঘরটি অনেকবেশি সমৃদ্ধ। মোগল আমলের রৌপ্যমুদ্রা, গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গোলাকার রৌপ্য মুদ্রাসহ অমূল্য শিলালেখ যাদুঘরটির বিশেষ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
সূর্য দেবতা
ভৈরবের মাথা
হিন্দু দেবী কালী
নটরাজ
প্রাচীন স্তম্ভ
মুসলিম সুলতান ও নবাবদের হাতে লেখা ফরমান, পেইন্টিং অলংকৃত ধাতব পাত্র, দলিল, যুদ্ধাস্ত্র, কামান, ঢাল, তলোয়ার মাটির সীলমোহর, কাঠের মূর্তি, খেলনা ও দুর্লভ পাংকমার্ক মুদ্রাও রয়েছে এই ঐতিহাসিক জাদুঘরটিতে।
ঋকবেদঃ১৯শতক
দেবী মহাত্ন্যঃসাংস্কৃত
এখানে রয়েছে প্রাচীন পুঁথির বিশাল ভান্ডার।
সেই পুঁথি রয়েছে তালপাতার উপর লিখিত। পুঁথির বিশাল ভান্ডার (৫০০০ পুঁথির মধ্যে ৩৬৪৬টি সংস্কৃত এবং বাকি বাংলা পুঁথি), অষ্ট্র সাহস্রিকা প্রজ্ঞা পারমিতা, পালযুগ থেকে মুসলীমযুগ পর্যন্ত অংকিত চিত্রকর্ম, প্রজ্ঞা পারমিতা পুঁথিচিত্র থেকে মুঘল যুগের বিভিন্ন মিনিয়েচার, সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের পিতা ইমাদ উদ দৌলার অলংকৃত চিত্র নিয়ে এটি সমৃদ্ধ জাদুঘর হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিতি পেয়েছে। বরেন্দ্র জাদুঘর থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘তারাতন্ত্রম’, ১৯১৯ সালে প্রকাশিত ধাতু প্রদীপ, ১৯২৬ সালে প্রকাশিত ‘অলংকার কৌস্তুভ’ আজও রতি আছে এই জাদুঘরে। যা গবেষণার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আরো রয়েছে বিভিন্ন আকারের আকর্ষণীয় প্রদর্শনী। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের লেখা চিঠির অংশ বিশেষ। এইসব ব্যক্তিগত চিঠিতে তৎকালীন সময়ের সমাজ ব্যবস্থার চিত্রটি প্রচ্ছন্ন ছায়া ফেলে রেখেছে। এই বরেন্দ্র জাদুঘরটি সবুজ প্রকৃতির অপরূপ বিন্যাস আর ঐতিহাসিক রূপকথার মতো কিংবদন্তী মহামূল্যবান ঐতিহাসিক রক্ষিত সব প্রত্ন নির্দশনের অপরূপ সৌন্দর্য্য।
মটকাঃবৃহৎ মাটির পাএ
১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর বরেন্দ্র যাদুঘরটির দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে।
এর পর থেকে এখনও এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে রয়েছে।
এছাড়াও সম্প্রতি সিটি করপোরেশেনের অথায়নে প্রায় তিন লাখ টাকায় নির্মিত হয়েছে রাজশাহী নগর নামে একটি গ্যালারি । অচিরেই এটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হবে। আরেকটি গ্যালারিতে নতুন করে ঠাঁই পাবে সাঁওতাল, মুরারি, ওরাং, মুণ্ডা, মালপাহাড়ী ও রাজবংশীসহ নানা আদিবাসীদের ঐতিহ্যের নিদর্শন।
প্রস্তর লিখনঃ১৮১৩
ব্রহ্মা
বরেন্দ্র যাদুঘরের লাইব্রেরিতে রয়েছে ১২হাজার বইয়ের এক দূর্লভ সম্ভার।
একটি ফটোগ্রাফী শাখাও রয়েছে যাদুঘরে। এ শাখায় স্থান পেয়েছে দূর্লভ সব ফটোগ্রাফী। শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত এই যাদুঘরে প্রবেশ করতে কোনও টিকিটের প্রয়োজন হয় না। বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহরে অন্য দিনগুলিতে যাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য উম্মুক্ত। শনিবার থেকে বুধবার ১০টা থেকে সাড়ে ৫ টা এবং শুধু মাত্র শুক্রবার যাদুঘর দুপুর ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
তবে শীত কালে সকাল ১০ থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য খোলা থাকে বরেন্দ্র যাদুঘর।
জাদুঘরটি পরিদর্শন করে ধন্য করেছেন মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, স্যার আশুতোষ মুখ্যোপাধ্যায় , জ্যতি বসু প্রমুখ।
বাংলাদেশে শতবর্ষী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম, আর এ ধরনের গবেষণা বা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তো হাতে গোনা। পৃথিবীর অন্য কোনো এলাকায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখা হতো, কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতি ভিন্ন।
তথ্য ও ছবিঃ নেট+রাবি প্রত্নতত্ব বিভাগ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।