বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ সাদা রঙের একটা অ্যাম্বাসেডরের পিছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে ছিল সুচিত্রা । ১৯৭১ সাল। মে মাসের মাঝামাঝি।
কদিন ধরে কলকাতা শহরটি তীব্র তাপদাহে পুড়ছে। বৃষ্টি তো দূরের কথা। বৈশাখের শুরুতে দু-একদিন ঝড় উঠেছিল ; তারপর ঝড়েরও দেখা নেই। কলকাতাসহ পুরো পশ্চিম বাংলা তাপ প্রবাহে তেতে আছে।
অ্যাম্বাসেডর গাড়িটা টার্ন নিয়ে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকে কিছু দূর অগ্রসর হয় ।
সময়টা এখন মধ্যাহ্ন। পার্ক স্ট্রিটে যান চলাচল স্বাভাবিক। ভিড় থাকলেও জ্যাম নেই। হর্নের শব্দে অবশ্য মাথা ধরে যায়।
সুচিত্রা আজ আকাশী রঙের জামদানী পরেছে।
ওর আঠাশ বছরের ঢলোঢলো শরীরটি শ্যামলা। তবে বেশ চটক আছে। শার্প চোখমুখ। সানগ্লাসে আরও মোহনীয় দেখায়।
গাড়ির ভিতর থেকেই ফুটপাতের ওপর ঋত্বিক ঘটক কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সুচিত্রা।
সুচিত্রার বুকটা ধক করে উঠল। সামান্য ঝুঁকে বসল মেয়েটি।
ড্রাইভার কে বাঁ পাশের ফুটপাত ঘেঁষে গাড়ি থামাতে বলল সুচিত্রা। গাড়ি থামলে নেমে এল । রাস্তায় পোড়া ডিজেলের গন্ধ।
গা গুলিযে ওঠে। তার ওপর ভীষণ গরম। আগুনের হলকা ত্বকে ছ্যাঁকা দিচ্ছে। ঋত্বিকদা এমন প্রখর রোদের ভিতর কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন?
এত বড় গুণী শিল্পীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বুক কাঁপছে সুচিত্রার। প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের সামনে দাঁড়ালে বুক কাঁপারই কথা।
সুচিত্রার জন্ম কলকাতার এক শিল্পমনস্ক বনেদী পরিবারে। জন্মাবধি প্রখ্যাত সব শিল্পসাহিত্যিকদের চোখের সামনে দেখে আসছে। তারপরও ঋত্বিক ঘটক কোথায় যেন আলাদা। ঋত্বিক ঘটক এক আগুনের নাম। মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা-এসব ছবিগুলোয় যে আগুনের ছাপ স্পষ্ট।
সুচিত্রা প্রায়ই বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ে প্রবন্ধনিবন্ধ লিখে থাকে। ঋত্বিক ঘটক এর মূল্য সে বোঝে। ঋত্বিক ঘটক কে মনে মনে গুরু মানে সুচিত্রা। সম্প্রতি 'কোমল গান্ধার' ছবিটি সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা "দেশ" পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।
ঋত্বিকদার পরনে ধুলিমলিন পাজামা-পাঞ্জাবি।
চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। এক মাথা এলোমেলো চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা। সে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
সুচিত্রা হাত জোর করে নমস্কার করে।
ঋত্বিক মাথা ঝাঁকালেন। মুখে মৃদু হাসি।
দাদা আমায় চিনতে পারছেন কি? সুচিত্রা ক্ষীণ উদ্বেগ বোধ করে। মিষ্টি হেসে সুচিত্রা বলল, আমায় চিনতে পারছেন তো ঋত্বিকদা? আপনার সঙ্গে গত বছর অক্টোবরে শান্তি নিকেতনে দেখা হয়েছিল ।
ঋত্বিক সুচিত্রার মুখটি ভালো করে খেয়াল করলেন।
তারপর বললেন, ওহ হ্যাঁ। তুমি সুচিত্রা রায় তো? টালিগঞ্জ বাড়ি। অন্নদাশঙ্কর রায় তোমার কী রকম জ্যাঠা হন না? ঠিক বলেছি তো?
সুচিত্রা মাথা নাড়ে। মৃদু হাসে। আমার কি সৌভাগ্য! এত বড় মানুষটা সব মনে রেখেছে।
ঋত্বিকদার পিছনে একটা কালো রঙের বিশাল ব্যানার। তাতে বড় বড় করে সাদা অক্ষরে বাংলা এবং ইংরেজিতে লেখাঃ “বাংলা দেশের শরনার্থীদের
জন্য দান করুন। ” ফুটপাতের লোকজন যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ছে। অনেকেই টাকাপয়সা দিচ্ছে। রেলিং ঘেঁষে একটা বড় বাক্স ।
লোকজন টাকাপয়সা ওই বাক্সেই ফেলছে।
বাক্সের পাশেই লম্বা একটি টুল। তার ওপর গিটার হাতে এক বিদেশি তরুণ বসে আছে। গায়ের রং তামাটে । হিপিদের মতো লম্বাচুল, চোখে সানগ্লাস।
মুখ ভরতি লালচে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনে ঢোলা বেলবটম প্যান্ট আর রঙীন হাওয়াই শার্ট। মাথায় একটি সাদা রঙের সোলার হ্যাট। গিটার আর মাউথ অর্গান বাজিয়ে নাকি গলায় তরুণটি গাইছে:
Come senators, congressmen
Please heed the call
Don't stand in the doorway
Don't block up the hall
বব ডিলানের গান। সুচিত্রার প্রিয়।
ঋত্বিক তরুণকে দেখিয়ে বললেন, ও হল স্টিভ টার্নার। গায়ক ও সাংবাদিক। সপ্তাহ খানেক হল আমেরিকা থেকে এসেছে।
হ্যালো। সুচিত্রা হেসে বলল।
গান গাইতে গাইতে স্টিভ হেসে মাথা নাড়ল।
ঋত্বিক বললেন, স্টিভ-এর সঙ্গে কবি অ্যালান গিনসবার্গও কলকাতা এসেছেন।
উনি কোথায়? সুচিত্রা কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
কে? অ্যালান ?
হ্যাঁ।
অ্যালান আজ সকালে শক্তির সঙ্গে বারাসাত শরনার্থী শিবিরে গিয়েছে।
শক্তি? মানে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়?
হ্যাঁ। বলে ঋত্বিক কপালের ঘাম মুছে নিলেন। তারপর বললেন, গতকাল অবধি টাকাপয়সা যা জমেছিল তা দিয়ে ওরা ওষুধ আর খাবার কিনে নিয়ে গেল ।
ওহ্ । সুচিত্রা ছোট্ট শ্বাস ফেলে।
স্টিভ টার্নারের দিকে তাকালো। ওদের মত কত দেশবিদেশের উদার মানুষ আজ পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ হোক কাল হোক পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবেই। শিল্পবিরোধীদের বিরুদ্ধে শিল্পের জয় অনিবার্য!
সুচিত্রা?
বলুন ঋত্বিকদা ।
এসেছো যখন তখন দুটো টাকা দিয়ে যাও।
বলে ঋত্বিক হাত বাড়ালেন।
সুচিত্রা অস্ফুট স্বরে বলে, ছিঃ দাদা। আপনি এভাবে বলছেন কেন? আমি কি বাইরের কেউ ? ব্যাগ খুলে একশ টাকার কড়কড়ে কটা নোট বার করে সুচিত্রা । তারপর নোটগুলি বাড়িয়ে দেয় ঋত্বিকের দিকে। সুচিত্রার হাত কাঁপছে।
এখুনি যে গুরুর স্পর্শ পাবে।
নোটগুলি নিতে নিতে ঋত্বিকদার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখল সুচিত্রা। যেন মেলায় হারিয়ে যাওয়ার সন্তানকে ফিরে পেয়েছে মা। সুচিত্রা জিগ্যেস করে, দাদা, সকাল থেকে কিছু খেয়েছেন?
ঋত্বিক হাসলেন। মনে মনে বললেন, এখন খাওয়ার সময় কই সুচিত্রা, এখন একটা যুদ্ধ চলছে ...ভারি অন্যায় যুদ্ধ; যুদ্ধটাকে ঘিরে পৃথিবী এখন পশু আর মানুষে দু-ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে।
আর পদ্মা-মেঘনার দেশে কত যে রক্ত ঝরছে এই মুহূর্তে ... এই মুহূর্তে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে শিশুর কচি হাত আর পা। সুতীক্ষ্ম বেয়োনেটে এফোঁড় -ওরফাড় হয়ে যাচ্ছে শিশুর মায়ের বুক। পুড়ে যাচ্ছে আজন্ম পরিচিত মমতায় ঘেরা ঘরবাড়ি ... বাংলার পলিমাটিতে জমে আছে লাশের স্তূপ ... বাংলার নীলাভ আকাশে ক্ষুধার্ত শকুনের উড়াল। বহু নীচে নদীর জল ... সে জলে লাশ ... নদীর পাড়ে লাশ ... রাস্তায় লাশ ... কলাঝোপে লাশ ... উঠানে লাশ ... কুয়ায় লাশ ... বাড়ির ভিতরে লাশ ... বাড়ির বাইরে লাশ .... লাশ লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ আর লাশ ....
সুচিত্রা আবার ব্যাগ খুলতে-খুলতে বলল, আমার ব্যাগে রাংতায় মোড়ানো একটা প্যাঁড়া থাকার কথা। দাঁড়ান দেখছি।
এই যে, এই নিন। এখন এটা টপ করে খেয়ে নিন তো। গাড়িতে জলের বোতল রয়েছে। এনে দেব?
ঋত্বিক প্যাঁড়া নিলেন বটে, কিন্তু খেলেন না। বরং ম্লান হেসে পাঞ্জাবির পকেটে ভরলেন।
আপনি আচ্ছা মানুষ যা হোক। সুচিত্রার কন্ঠে অভিমান।
সুচিত্রা তুমি একসঙ্গে কত লাশ দেখেছ? ১০০? ২০০? ৩০০? ৪০০? ৫০০? ৬০০? ৭০০? ৮০০? ৯০০?
সুচিত্রার কথাটা শুনে ঋত্বিক ম্লান হাসলেন। ভাবলেন, মানুষ হিসেবে, শিল্পী হিসেবে আমার ভিতরকার যন্ত্রণা কি এই বাহারি আর্ট-কালচারে ডুবে থাকা মেয়েটি টের পাচ্ছে? মেয়েটি একসঙ্গে কত লাশ দেখেছে?
সুচিত্রা বলল, আমি তাহলে যাই ঋত্বিকদা । সৌগত আপিসে অপেক্ষা করছে।
ঋত্বিক জিগ্যেস করলেন, সৌগতবাবুর আপিস তো পার্ক সার্কাসে, না ?
বাব্বা! আপনার ঠিকই মনে আছে। কবে বলেছিলাম। সৌগতর আবার আজকে রাতের ট্রেনেই শিলিগুঁড়ি যাওয়ার কথা। আমার শাশুড়িকে কলকাতায় নিয়ে আসবে। ওঁর ছানি কাটতে হবে।
আমি এখন যাই ঋত্বিকদা ।
ঋত্বিক মাথা নাড়লেন। অল্প হাসলেন। কন্ঠনালী শুকিয়ে আছে। এখান থেকে কয়েক পা হাঁটলেই পার্ক হোটেল।
ওই হোটেলের শীততাপনিয়ন্ত্রিত বারে বসে এক গ্লাস বিয়ার পান করে তৃষ্ণা মেটাতে পারেন ।
যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে যাবেন না ঋত্বিক!
সুচিত্রা গাড়িতে উঠতে-উঠতে ভাবল: যে ভূখন্ডের অসহায় মানুষের জন্য এই ঋত্বিকদা এই মুহূর্তে তীব্র তাপদাহে পুড়ে যাচ্ছেন, সেই ভূখন্ডে তো ঋত্বিকদা আর কখনোই ফিরে যাবেন না। ঋত্বিকদারা পরিবারসহ ’৪৭ সালেই এ পাড়ে চলে এসেছেন । তবুও ... এত বড় ফিলম ডিরেকটর, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, যে ঋত্বিক ঘটককে জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে তুলনা করা হয় ... সে মানুষটি কেমন নাওয়া -খাওয়া ভুলে জ্বলন্ত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য ভিক্ষে করছেন।
এই ভাবনার সঙ্গে দু ফোঁটা অশ্রু যেন পিচ রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল।
একে কি বলে? ভালোবাসা? এই একটা জিনিস যা হোক। এ আছে বলেই সব আছে। নইলে পৃথিবী এদ্দিন টিকে থাকত না। কবে শেষ হয়ে যেত সব!
সুচিত্রা গাড়িতে উঠে বসে।
তারপর সাদা রঙের অ্যাম্বাসেডরটি যান্ত্রিক গুঞ্জন তুলে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যায়।
মধ্যাহ্নে তাপদাহে পুড়তে থাকে পার্কস্ট্রিট। আর গনগনে সূর্যের নীচে আহত ক্ষুধার্ত বাঙালি উদ্বাস্তুদের সাহায্যের জন্য ফুটপাতে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকেন সমসাময়িক বিশ্বের একজন শ্রেষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ...
... ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশি শরনার্থীদের জন্য চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের কলকাতার রাস্তায়- রাস্তায় ত্রানকার্যে সক্রিয় অংশ গ্রহনের কথা একটি পত্রিকায় পড়েছিলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।