আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাসের হার ও জিপিএ বাড়াতে ‘সর্বোচ্চ উদারতা’, এইচএসসিতে রেকর্ডের নেপথ্যে

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ বাড়াতে এবার ‘সর্বোচ্চ উদারতা’ দেখানো হয়েছে। তিন দফায় তা নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট বোর্ডের কর্মকর্তারা। খাতা গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা থেকে শুরু করে পুনর্মূল্যায়ন এবং সর্বশেষ খাতা জমা দেয়া পর্যন্ত এ নিয়ে বোর্ড কর্মকর্তাদের নজরদারিতে ছিলেন পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকরা। ফল ঘোষণার আগে থেকেই এ নিয়ে কানাঘুষা ছিল দেশজুড়ে। সচিবালয়ে ফল ঘোষণা করতে শিক্ষামন্ত্রীর ডাকা সংবাদ সম্মেলনেও ঘুরে ফিরে এ প্রশ্নটি এসেছে বারবার।

মন্ত্রীর দপ্তরে আলাপচারিতায়ও সাংবাদিকদের তরফে বিশেষ এ নির্দেশনার প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিষয়টিকে ‘গতানুগতিক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত সব পাবলিক পরীক্ষায় উদারভাবে খাতা মূল্যায়নের নির্দেশনা রয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, এবারও বিশেষ কোন নির্দেশনা ছিল না। সরকার, মন্ত্রণালয় কিংবা মন্ত্রী হিসেবে তিনি কোন নির্দেশনা দেননি বলে জানান। শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে ১০ বোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত আন্তঃবোর্ড সভাপতি, ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ফাহিমা খাতুনও অভিযোগটি প্রত্যাখ্যান করেন।

ফল ঘোষণার পর মানবজমিন-এর অনুসন্ধান এবং দেশের বিভিন্ন জেলার অর্ধশতাধিক পরীক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের পাসের হার ও জিপিএ বাড়াতে নতুন কৌশল নেয়া হয়। বোর্ড কর্মকর্তাদের নির্দেশের ভাষা এক না থাকলেও ভাবার্থ ছিল প্রায় অভিন্ন। নতুন তিন বোর্ডের কর্মকর্তারা নতুনত্ব এবং বোর্ডের সমস্যাদি তুলে ধরে পরীক্ষকদের উদারভাবে খাতা মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। আর ঢাকা, কুমিল্লা বোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠিত বোর্ডের কর্মকর্তারা রীতিমতো নজরদারি করেছেন পরীক্ষকদের কাজে। বোর্ডে ডেকে এনে নির্দেশনা দিয়েছেন।

স্ব স্ব বিষয়ের প্রধান পরীক্ষকদের মাধ্যমেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রধান পরীক্ষকদের মাধ্যমে আবারও খাতার নম্বর বাড়ানো হয়েছে। কেবল বাংলা, ইংরেজি নয়, সমাজকল্যাণের মতো বিষয়েও প্রধান পরীক্ষকের মাধ্যমে নম্বর বাড়িয়ে নিয়েছেন বোর্ডের কর্তা ব্যক্তিরা। নারায়ণগঞ্জের একজন পরীক্ষক জানান, তিনি আড়াই শতাধিক খাতা মূল্যায়ন করেছেন। তার মধ্যে মাত্র ৩ জনকে অকৃতকার্য দেখাতে বাধ্য হয়েছেন।

এই তিন শিক্ষার্থীর খাতায় পাস করানোর মতো নম্বর দেয়ার সুযোগ ছিল না। প্রধান পরীক্ষকের কাছে এ নিয়ে তার জবাবদিহি করতে হয়েছে। অবশ্য প্রধান পরীক্ষক সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, তাদের কোন মতে পাস করিয়ে দিতে। নিজের এবং প্রধান পরীক্ষকের নাম বললেও তা প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওই পরীক্ষক বলেন, প্রধান পরীক্ষকের অধীনে তারা প্রায় তিন হাজার খাতা স্ক্রুটিনি করেছেন। সেখানে গ্রেড নম্বরের চেয়ে ৭-৮ পর্যন্ত কম পেয়েছে এমন শিক্ষার্থীদেরও নম্বর বাড়িয়ে গ্রেডের সর্বনিম্ন নম্বরে নেয়া হয়েছে।

তিনি জানান, একটি খাতায় সর্বোচ্চ ১০ নম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর ক্ষমতা দেয়া ছিল প্রধান পরীক্ষককে। টাঙ্গাইল কুমুদিনী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিষয়ের এক পরীক্ষক মানবজমিনকে বলেন, যথেষ্ট উদারভাবে তিনি খাতা মূল্যায়ন করেছেন। বোর্ডের নির্দেশনা পেয়েছেন খাতা আনতে গিয়ে। তার সঙ্গে প্রধান পরীক্ষকও ছিলেন। তিনিও টাঙ্গাইলের।

প্রায় ৪ শতাধিক খাতা তিনি দেখেছেন। স্ক্রুটিনিতে তার খাতায় খুব বেশি নম্বর পরিবর্তন করতে হয়নি। এ জন্য বোর্ড কর্মকর্তা এবং প্রধান পরীক্ষকের প্রশংসা পেয়েছেন বলে জানান ওই নারী পরীক্ষক। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের একজন ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক জানান, তিনি নিজে খাতা দেখেননি। তবে তিনি একজন প্রধান পরীক্ষকের অধীনে খাতা স্ক্রুটিনি করেছেন।

তিনি জানান, সিলেট বোর্ডের তরফে তাদের বলা হয়েছে, নতুন বোর্ডের ভাবমূর্তি বাড়াতে নিজের সন্তানের খাতা মনে করে সর্বোচ্চ উদারতা দেখাতে হবে। তারা তাই করেছেন। তবে তিনি এ নিদের্শনাকে নতুন বলতে নারাজ। বলেন, ৪-৫ বছর আগেও এমন নির্দেশনা ছিল। তখন পরীক্ষকরা খাতায় নম্বর দিতে চাইতেন না।

বর্তমানে পরীক্ষা করা বেশ উদার। আর স্ক্রুটিনি যারা করেন, তাদের উদারতা আরও বেশি। দু’জন একই ব্যাচের। ২৪তম বিসিএস-এর সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। নামের বানান থেকে শুরু করে সবকিছুই অভিন্ন।

তবে বিষয় ভিন্ন। নোয়াখালীর একটি কলেজের ইংরেজির শিক্ষক একজন, অন্যজন জামালপুরে গণিতের শিক্ষক। দু’জনই খাতা দেখেছেন। মোবাইল ফোনে কথা হয় তাদের সঙ্গে। জামালপুরের এই পরীক্ষক বলেন, গণিতের খাতা মূল্যায়নে উদারতা দেখানোর সুযোগ কম।

তারপরও বোর্ডের নির্দেশনা মেনে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন বেশি নম্বর দিতে। নোয়াখালীতে কর্মরত একই ব্যাচের ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষক বলেন, তার দেখা খাতায় ৬২-৬৫ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। স্বাভাবিকভাবে মূল্যায়ন করলে এ হার ৫০-এর নিচে নেমে যেতো। তবে কুমিল্লা চিওড়া সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের একজন প্রভাষক বোর্ডের নির্দেশনা আমলে নেননি বলে জানান। তিনি বলেন, খাতা মূল্যায়নের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপনীয়।

গণমাধ্যমে এ নিয়ে কোন বক্তব্য দেয়া শপথ ভঙ্গের শামিল। আমি এ নিয়ে কোন কথা বলবো না। শুধু একটু বলবো বোর্ডের বিশেষ নির্দেশনা আমলে নিইনি। আমার বিবেক বিবেচনা মতেই খাতা মূল্যায়ন করেছি। পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীলতা বাড়ছে না: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. এএফ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, পাসের হার বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীলতা বাড়ছে না।

মেধার বিকাশ হচ্ছে না। তিনি বলেন, সব কিছু যান্ত্রিক হয়ে গেছে। আর এ জন্য মেধার বিকাশ হচ্ছে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি পরীক্ষার পাসের হার দিয়ে শিক্ষার মান বিবেচনা করা যায় না। পরীক্ষায় অংশ নেয়া সকলেরই পাস করা উচিত।

পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করে যারা পরীক্ষা দেয় না তাদের বিবেচনায় আনতে হবে। কেন তারা ঝরে পড়লো, কোথায় সমস্যা ছিল তা-ও দেখতে হবে। অধ্যাপক ইসলাম বলেন, ফেল করায় কয়েকজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে- এটা খুবই দুঃখজনক। আমি চাই সবাই পাস করুক। সবার ফলাফল অবশ্য এক সমান হবে না।

আর পাসের হার দিয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা যায় না। সূত্র: দৈনিক মানবজমিন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.