আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২০০৬ সালে বিএনপি সম্পর্কে যা বলেছিলেন অলি : ‘রাজাকারনির্ভর’ দলটির সঙ্গে কতোদিন টিকবে গাঁটছড়া?

বাঙ্গাল মানুষ ‘বিএনপি এখন রাজাকারনির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। বিএনপির মধ্যপন্থী নীতি বিসর্জন দিয়ে দল ও জনগণের সম্মতি ছাড়াই বেগম জিয়া ব্যক্তিগত লাভের আশায় রাজাকারদের সঙ্গে জোট করেছেন। শিবিরকে জিয়া পরিবারের সদস্য বানিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কলঙ্কিত করা হয়েছে। এদের হাতে বাংলাদেশের জাতিসত্তা কোনোভাবেই নিরাপদ নয়’Ñ বিএনপিকে নিয়ে এ মন্তব্য করে ২০০৬ সালে দল ছেড়েছিলেন কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ। মাত্র ৫ বছরের মাথায় ডিগবাজি খেয়ে আবার সেই রাজাকারনির্ভর বিএনপির সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধলেন মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমদ।

সে সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটি থেকে পদত্যাগী নেতা কর্নেল অলি আহমদের কণ্ঠে ছিল বিদ্রোহের দামামা। ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর এলডিপির (লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি) আত্মপ্রকাশের দিন মিডিয়ার সামনে বিএনপির বিরুদ্ধে মনের ঝাল ঝেড়ে অলি আহমদ খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও বাবরকে আখ্যায়িত করেছিলেন জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে। জিয়া পরিবার দেশে লুটপাট ও দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেছে উল্লেখ করে তাদের বিচারও দাবি করেছেন বহুবার। খালেদা জিয়া কাউকে সম্মান করতে জানেন না, হাওয়া ভবন ও তারেক সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু এবং বিএনপি-জামাত জোটের কাছে দেশ-জাতি অনিরাপদ দাবি করে এদের হাত থেকে দেশ উদ্ধারের আহ্বানও ছিল তার কণ্ঠে। বিগত ৫টি বছর বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্যে ক্রমাগত বিএনপি-জামাত জোটের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করা কর্নেল অলি হঠাৎ করেই ভোল পাল্টালেন।

তিনি এখন খালেদা জিয়ার সঙ্গে জোট করতে উদগ্রীব। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের নানা সমালোচনায় মুখে খই ফুটছে। অথচ বেমালুম ভুলে গেছেন ২০০৬ সালের শেষ দিকে বিএনপি ছেড়ে এলডিপি গঠনের কথা। খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, বাবরকে নিয়ে কঠোর সমালোচনার কথা হয়তো এখন তার মনেও নেই। নাকি ডিগবাজি খাওয়া রাজনীতিবিদদের মতো কর্নেল অলিও শেষ বয়সে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন গড্ডলিকা প্রবাহে।

বিএনপি-জামাত বিদ্বেষী কর্নেল অলির আচমকা পরিবর্তনে অবাক হয়েছেন দেশের সাধারণ জনগণ। কোন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় ড. অলি আবার বিএনপিতে ফিরতে চাইছেন এটি দেশবাসীর কাছে বোধগম্য নয়। তবে দেশের সাধারণ মানুষ ভুলে যাননি ২০০৬ সালে সদ্য এলডিপি গঠনকারী কর্নেল অলির বিএনপি বিরোধী খিস্তি। এলডিপির আত্মপ্রকাশের দিন বক্তৃতায় কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, দল গঠনের শুরু থেকে যারা বিএনপির সঙ্গে ছিলেন, আজ দলের ভেতর তারা অবাঞ্ছিত হয়ে গেছেন কারণ তারা জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও নীতির কথা বলতে চান। খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের স্বৈরাচারী নেতৃত্বে বিএনপি আজ অধিক মাত্রায় দুর্নীতিগ্রস্ত।

অদক্ষ, অগণতান্ত্রিক, জনবিরোধী সিদ্ধান্তের জন্য বিএনপি আজ জনগণের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। ওই বক্তৃতায় তিনি আরো বলেন, বর্তমান বিএনপি শহীদ জিয়ার ১৯ দফা ও তার আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে শুধু প্রজেক্ট করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছে। ওই সময় তারেক রহমানের কঠোর সমালোচনা করে অলি আহমদ বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির গণতান্ত্রিক কাঠামো অবশিষ্ট নেই।

এই দলে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। তারেক জিয়া ছাড়া কোনো কাজ হয় না। এমনকি দলের প্রার্থী মনোনয়নও না। সিনিয়র নেতা ও পরীক্ষিত ত্যাগী নেতাকর্মীরা আজ দলের ভেতর অপাঙ্ক্তেয়। জাতির স্বার্থ একটি মহলের কাছে আমলযোগ্য কোনো বিষয় নয়।

তারা দুর্নীতির ভাগ পাওয়াটাকেই মুখ্য বিষয় বলে মনে করে। এ কারণে অতি অল্প সময়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তারা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। এরপর ২৮ অক্টোবর বারিধারায় পার্টির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সীমাহীন লুটপাটের সঙ্গে জড়িত তারেক রহমানসহ জোট সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে রাষ্ট্রপতির কাছে দাবি জানান কর্নেল ড. অলি। তিনি বলেন, হাওয়া ভবন এদেশে দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু। লাগামহীন দুর্নীতির কারণে বিএনপির অনেক মন্ত্রী-এমপি রাতারাতি অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।

অথচ কয়েক বছর আগেও তাদের পায়ের তলায় জুতা ছিল না। খালেদা জিয়া কাউকে সম্মান করতে জানেন না বলেও মন্তব্য করেন কর্নেল অলি। পার্টির প্রেসিডিয়াম কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে (৩০ অক্টোবর ২০০৬) কর্নেল অলি আহমদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্য, দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া সময়মতো ব্যবস্থা নিলে এতোগুলো (১৬) প্রাণহানি ঘটতো না। ৩ নভেম্বর ২০০৬ পার্টির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল অলি বলেন, দুর্নীতিবাজরা আগামীতে ক্ষমতায় আসতে পারলে পাজারোর বদলে মার্সিডিজ গাড়ি হাঁকাবে।

আবারো দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করবে। এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, বেগম জিয়াকে এখন ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ তার দল এখন ক্ষমতায় নেই। আপনি এমন কিছু করুন যেন দেশের ১৪ কোটি মানুষের কাছে আপনি সম্মানিত হয়ে থাকেন।

এর পরদিন (৪ নভেম্বর ২০০৬) পার্টির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জোট সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেন তিনি। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ৪ উপদেষ্টার সঙ্গে এক বৈঠকে (১৫ নভেম্বর ২০০৬) তারেক রহমানকে ইঙ্গিত করে অলি আহমদ বলেন, এখন রাষ্ট্রপতি আর কবর জিয়ারতের রাষ্ট্রপতি নেই। আমরা দুর্নীতিবাজদের লিস্ট দিয়েছি। প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ১৮ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জামাত-বিএনপি ছাড়া অন্যসব দলকে একসঙ্গে পথ চলার আহ্বান জানান অলি।

তিনি বলেন, লুটপাট ও দুর্নীতির কারণে বিএনপি-জামাত জোটের সময় দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁয়েছিল। চট্টগ্রামের পটিয়ায় এলডিপি নেতা কর্নেল অলির জনসভায় (২১ নভেম্বর ২০০৬) দফায় দফায় হামলা চালায় বিএনপি ও ছাত্রদলের ক্যাডাররা। ওই হামলায় নিহত হন ২ জন এবং আহত ১৫ জন। এর পরের দিন (২২ নভেম্বর) চট্টগ্রামে আয়োজিত জনসভায় বিএনপি, খালেদা জিয়া, তারেক-বাবরের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন কর্নেল অলি। খালেদা, তারেক ও বাবরকে জেএমবির মদদদাতা উল্লেখ করে অলি বলেন, তারা যদি জঙ্গিবাদ ও জেএমবির মদদাতা না হতো তাহলে জঙ্গি তৎপরতা এতোদূর এগুলো কী করে।

আমি খালেদা জিয়াকে বহুবার বলেছি, ৪/৫ জনের জন্য বিএনপি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারেককে রাজনীতিতে আনবেন না। খালেদা জিয়ার অহঙ্কারের শিক্ষা এবার জনগণ দেবে। ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামে অন্য আরেকটি জনসভায় বিএনপির ব্যাপক সমালোচনা করে অলি বলেন, মানুষ এখন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এক জনসভায় (১০ ডিসেম্বর ২০০৬) এলডিপি নির্বাহী সভাপতি কর্নেল অলি অভিযোগ করে বলেন, বিশেষ দলকে ক্ষমতায় নেয়ার ষড়যন্ত্র করছেন রাষ্ট্রপতি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় (১৫ ডিসেম্বর ২০০৬) খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান রাজাকারদের ক্ষমতায় বসিয়েছে অভিযোগ করে কর্নেল অলি বলেন, এদের হাতে দেশ নিরাপদ নয়। এরা সুপ্রিম কোর্ট থেকে শুরু করে সরকারি অফিসসহ সবকিছুকে দলীয় অঙ্গ সংগঠনে পরিণত করেছে। ৩০ ডিসেম্বর ২০০৬ নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল অলি বলেন, খালেদা জিয়া ও হাওয়া ভবনের নির্দেশে দেশ চালাচ্ছেন ড. ইয়াজউদ্দিন। খালেদা-নিজামীরা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চান না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ভোটের লড়াই আর জোটের নীতির পালে জোর হাওয়া লাগার সময়ই ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সঙ্গে জোট বাঁধেন ড. অলি।

পরে আসন ভাগাভাগি নিয়ে মহাজোটের সঙ্গে সমস্যার কারণে এককভাবে নির্বাচনে যায় এলডিপি। ১৮টি সংসদীয় আসনে প্রার্থী দিয়ে দুটিতে জয়লাভ করে এবং ১৬টিতেই তারা জামানত হারায়। এদিকে নির্বাচনের পর বেশ কিছুদিন রাজনীতিতে নীরব থাকলেও সম্প্রতি জোটের রাজনীতি চাঙ্গা হওয়ার সুবাদে কদর বাড়ে অলি আহমদের এলডিপিসহ ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর। আবারো সরব হয়ে ওঠেন অলি আহমদ। ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে বৈঠক করেন পুরোনো দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে।

জোটের রাজনীতিতে ভুলে গেছেন পুরোনো দিনের বিএনপিবিরোধী গীত। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেইÑ এই চিরন্তন সত্যের মতোই অলি হয়তো ফিরে যাবেন পুরোনো দলে, গাইবেন জিয়া পরিবারের জয়গান। কিন্তু দেশবাসীর মনে প্রশ্ন, কতোদিন টিকবে খালেদা-অলির এই গাঁটছড়া?  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।