আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিরসরাই থেকে আমিনবাজার : সমাজ ও শবদেহ

মিরসরাই থেকে আমিনবাজার : সমাজ ও শবদেহ ফকির ইলিয়াস ===================================== সমাজ শবদেহের সৎকার করে। কিন্তু সমাজ কখনো খুনি হতে পারে না। খুনি হতে পারে না রাষ্ট্রও। যে কোনো শ্রেণীর হত্যাকারীরা যদি রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্রয় পায়, তাহলে সমাজে ধস নামে। নামতে বাধ্য হয়।

সমাজের ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ে। চট্টগ্রামের মিরসরাইতে গেলো কদিন আগে যে ৪০ জন স্কুল ছাত্র নির্মমভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলো, এর জন্য দায়ী কে? সমাজ, না রাষ্ট্র? সেই খুনি ট্রাক ড্রাইভার অবশেষে গ্রেপ্তার হয়েছে। সে প্রকৃত চালকও ছিল না। সে ছিল হেলপার। তার নাম মফিজ উদ্দিন।

গত ১১ জুলাই মিরসরাইয়ে মর্মান্তিক ট্রাক দুর্ঘটনায় ৪৩ স্কুলছাত্রসহ মোট ৪৫জন নিহত হয়। ঘটনা পরবর্তী সময়ে পুলিশ কর্মকর্তারা ট্রাকটির চালক (হেলপার) মফিজ উদ্দিনের বাড়ি গিয়ে তার স্ত্রী রোকেয়া বেগমের কাছে মফিজ উদ্দিনের ছবি চাইলে তার কোনো ছবি নেই বলে তিনি জানান। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্ঘটনার পরপর এর জন্য দায়ী ব্যক্তি হিসেবে হেলপার মফিজের নাম জানাজানি হওয়ার পর বাড়িতে থাকা তার সব ছবি পুড়িয়ে ফেলেন স্ত্রী রোকেয়া বেগম। তারপরও মিডিয়াকর্মীরা সেই মফিজের ছবি উদ্ধারে সমর্থ হয়েছেন। মিরসরাই দুর্ঘটনার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা দুজনেই ঐ এলাকা সফর করেছেন।

সমবেদনা জানিয়েছেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে বেশ কিছু অর্থ সাহায্যও দিচ্ছে সরকার। কিন্তু সেটাই তো শেষ কথা নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গাড়ি চালানোর সময় ড্রাইভাররা যাতে মোবাইল ফোনে কথা না বলতে পারে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তার এই আদেশ কজন শুনবে? বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের সড়ক ও জনপথগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক।

অধিকাংশ বড় বড় সড়ক ও রাজপথের মাঝখানে ডিভাইডার নেই। গাড়ি চালাবার লেন ব্যবস্থা না থাকায় মুখোমুখি সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’Ñ এমন একটি সামাজিক আন্দোলন দীর্ঘদিন থকেই চলে আসছে। কিন্তু কাজ কি কিছু হচ্ছে? আমাদের সামাজিক মানসিকতা কি পরিবর্তিত হচ্ছে? খুব একটা হচ্ছে বলে মনে হয় না। দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, এসব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দেখভালের দায়িত্ব।

আর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বলছে, এসব দেখবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। কী আশ্চর্য যুক্তি! দেশের মানুষের অবস্থা এখন যেন জিম্মিদশা। না, এর উত্তরণের কোনো পথ খুঁজতে কাউকে তৎপর দেখা যাচ্ছে না। নিরাপদ সড়কের দাবিতে বহু বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা-সংগঠন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল কিংবা সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।

নিরাপদ সড়ক তৈরিতে সার্ভে, ফিটনেসবিহীন সড়কযান ও অনভিজ্ঞ চালক দিয়ে গাড়ি চালনা বন্ধ এবং সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করা, সড়কগুলোর উন্নয়ন, সড়কের পাশে যেখানে বিপজ্জনক খাদ রয়েছে তার পাশ দিয়ে শক্তিশালী প্রাচীর নির্মাণ, এসব কাজগুলো খুব জরুরি ভিত্তিতে করা দরকার। দুর্ঘটনা কারোই কাম্য হতে পারে না। । মানুষ দেখতে চায় না মিরসরাইয়ের পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া রাজিবের মতো অবুঝ শিশুর জীবন অকালে ঝরে যাক। সমাজ চায় নিরাপদ সড়ক।

চায় একটি সুষ্ঠু নীতিমালা। বাংলাদেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন একটি নিয়মতান্ত্রিক আইন ব্যবস্থা। দাণনরাতে হবে মানুষকেও। তাদেরকে বলতে হবে, লাইসেন্সবিহীন চালকের গাড়িতে, হেলপারের ড্রাইভিংয়ে আমরা গাড়িতে উঠবো না। কাজটি খুবই কঠিন।

কিন্তু কাউকে তো দাঁড়াতেই হবে। মিরসরাইয়ের এই ঘটনার জের কাটতে না কাটতেই ঢাকার আমিনবাজারে ‘ডাকাত সন্দেহে’ হত্যা করা হয়েছে আরো ছজন স্কুলছাত্রকে। গণপিটুনিতে এরা প্রাণ হারিয়েছে। পুলিশ বলছে, এলাকাবাসীর উত্তেজনার কারণে কিছু করা যায়নি। পবিত্র শবেবরাতের পরদিন সোমবার ভোররাতে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী এলাকার কেবলার চরে স্থানীয়দের পিটুনিতে ছয় ছাত্র নিহত হন।

এরা হলেন, ইব্রাহিম খলিল (স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ-বাংলা কলেজ), তৌহিদুর রহমান পলাশ (স্নাতক তৃতীয় বর্ষ-বাংলা কলেজ), কামরুজ্জামান কান্ত (স্নাতক প্রথম বর্ষ-বাংলা কলেজ), টিপু সুলতান (স্নাতক প্রথম বর্ষ তেজগাঁও সরকারি কলেজ), শামস্ রহিম শাম্মাম (‘এ’ লেভেল-মাস্টারমাইন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ) ও মনির সেতাফ (বিবিএ-বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি)। এই নির্মমতম ঘটনার পর মামলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তদন্ত হবে। পুলিশ বলেছে, ওরা যদি স্কুলছাত্র হয় তারা ওখানে যাবে কেন? ঐ ঘটনায় বেঁচে যাওয়ায় একজন আল আমিন বলেছে সে কিভাবে বেঁচে গেছে গণপিটুনি থেকে। আল আমিনের ভাষ্যমতে, আল আমিন ও তার ছয় বন্ধু রোববার রাতে রিকশা করে দারুস সালাম থেকে পর্বত সিনেমা হলের সামনে নামেন।

পরে পায়ে হেঁটে গাবতলী ব্রিজ পার হয়ে বড়দেশী বালুর মাঠে তারা মাদক সেবন করেন বলে জানান আল-আমিন। শবেবরাতের পরদিন ভোররাতে তারা মাদক সেবন করেছিল, তাও এক ভয়ঙ্কর খবর। সামাজিক অবক্ষয় কতোটা মারত্মক হলে মানুষ এমনটা করতে পারে! বাংলাদেশে সমাজ ও নৈতিকতা কি আসলেই নির্বাসিত? এর কোনো জবাব নেই। পুরো দেশটাকেই একটা লাশে পরিণত করার জন্য কারা তৎপর? ভিকারুননিসা স্কুলের সেই পাষ- শিক্ষক পরিমল জয়ধরের ঘটনায় আঁতকে উঠেছে গোটা দেশ। আবারো চোখ ফেরানো যাক সেই ঘটনাটির দিকে।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, গত ২৮ মে আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার পাশে ‘এফ’ ব্লকে ৬ নম্বর রোডের ৩৫৯ নম্বর বাসায় একতলা ভবনের একটি কক্ষে ওই স্কুলের ১০ম শ্রেণীর ওই ছাত্রীকে হাত বেঁধে, মুখে ওড়না গুঁজে ধর্ষণ করেন পরিমল। সে সময় পরিমল তার মোবাইল ফোনে মেয়েটির ছবি তুলে রাখেন বলেও মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়ছে ঘটনার পর ছাত্রীটির হাতের বাঁধন খুলে কাউকে এ বিষয়ে কিছু বললে ইন্টারনেটে নির্যাতনের ছবি ছেড়ে দেয়া হবে বলে হুমকি দেন পরিমল। পরে ১৭ জুন পরিমলের কাছে পড়তে গেলে আবারো তিনি ছাত্রীটিকে নির্যাতন করেন। সেদিন ওই ছাত্রী প্রতিবাদ করলে পরিমল তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন।

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা ক্রমশ নানা আতঙ্কের শিকার হচ্ছে। হরতাল, মিছিল দমনে মোবাইল কোর্ট বসানো হচ্ছে। খবর বেরিয়েছে, রমজানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারি ও খুচরা বাজার তদারকি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পর্যাপ্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এজন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের চাহিদা অনুসারে পর্যাপ্তসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দিতেও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছেন।

পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ানোর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলেছেন আদালত। রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ না নেয়া কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এসব ঘটনা প্রমাণ করছে, সরকারের চালিত ব্যবস্থা বারবারই মুখ থুবড়ে পড়ছে। আমিনবাজার এলাকার মানুষ ডাকাত আতঙ্কে আছেন দীর্ঘদিন থেকেই। যার ফলে তারা সন্দেহ নিয়েই হামলে পড়েছেন।

এর জন্য দায়ী কে? রাষ্ট্র যদি ঐ এলাকার মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারতো তবে হয়তো এমনটি হতো না। আর বিরোধী দল বিএনপি সে সুযোগ নিয়েই বলছে, দেশের আইনশৃঙ্খলার প্রতি সরকার উদাসীন। খুব স্পষ্ট করে বলা দরকার, কোনো উদাসীনতাই রাষ্ট্র ও মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। গণতান্ত্রিক কোনো সমাজে অসহিষ্ণু, অমানবিক, উদ্ধত কোনো কাজকর্মই গ্রহণীয় হতে পারে না। পরিমল জয়ধর, ট্রাকচালক মফিজ, কিংবা আমিনবাজার এলাকার সেই ‘উত্তেজক খুনি’ গোষ্ঠী সকলেই এই সমাজের জন্য ক্ষতিকারক শক্তি বলেই বিবেচিত।

এজন্য এই সমাজকেই দাঁড়াতে হবে এসব শক্তির বিরুদ্ধে। আর রাষ্ট্রকে নিতে হবে তদারকির ভূমিকা। একটি ঘটনা ঘটলেই তা মিডিয়ায় শিরোনাম হবে, তারপর রাষ্ট্র সবকিছু বেমালুম ভুলে যাবে, তা হতে পারে না। প্রায় পনোরো কোটি মানুষের দেশে ‘দিনবদল’ খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু সমাজের নানা স্তরে শবদেহ ছড়াতে যারা ব্যস্ত, এদেরকে চিহ্নিত করা না গেলে সমাজ এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, ভিত টেকানোই মুশকিল হয়ে পড়বে।

রাষ্ট্রকে জানতে হবে, চিনতে হবে- কে ডাকাত আর কে ছাত্র। রাষ্ট্রকে জানতে হবে, কে শিক্ষক আর কে ধর্ষক। রাষ্ট্রকে জানতে হবে কে মুনাফাখোর আর কে প্রকৃত ব্যবসায়ী। তা না জানতে পারলে রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর মানুষের অনাস্থা বাড়বেই। তা ঠেকানো যাবে না।

আমরা দেখেছি লিমন হোসেনকে কিভাবে সন্ত্রাসী বানাবার কসরত করা হয়েছে। সে চেষ্টা এখন হয়তো আল আমিনের ব্যাপারেও হবে। কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান, কিংবা সমাজের মুখরক্ষা হবে? দেশের মানুষ সুবিচার অবশ্যই চান। আর সেই বিচার করতে গিয়ে কোনো উচ্চমহলের চাপ যেন সকল গণপ্রত্যাশাকে ম্লান করে না দেয়। নিউইয়র্ক, ২০ জুলাই ২০১১ ----------------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / ২৩ জুলাই ২০১১ শনিবার ছবি- লী শান ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.