মনের এলোমেলো ভাবনাগুলোকে শব্দের ফ্রেমে বাঁধার এক অপচেষ্টা। "নীলু"
নীলা পেছনে ফিরে তাকায়। দরজার কাছে নীলার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন।
"নিলু মা বেরোচ্ছিস"?
নীলু তৈরি হয়েই ছিল। অফিসের জন্য বের হবো হবো ভাব।
"কিছু লাগবে বাবা"?
বাবা কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। এখনও মেয়ের কাছে ঘরের টুকিটাকি জিনিসের কথা বলাটা আত্মস্থ করতে পারেননি। বাবা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেন, নীলুর দিকে না তাকিয়েই বললেন।
"বিস্কুট মনে হয় শেষ হয়ে গেসে, তোর মা খেতে চাইছিলো"।
নীলার মনটা খারাপ হয়ে যায়, ঘরে বিস্কুট নেই এটা তার জানা উচিত ছিলো।
আরো আগেই এনে রাখার দরকার ছিলো। বাবাকে তাহলে এভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বিস্কুটের কথা বলতে হতোনা।
"আমার মনে ছিলনা বাবা, সেদিন দেখেছিলাম অল্প ক’টা আছে। আজই আসার সময় নিয়ে আসব"।
নীলু কথাগুলো অপরাধীর সুরেই বলে।
কিন্তু বাবা মনে হয় সেটাকে বিরক্তি হিসেবেই নিলেন।
"না না তোর কষ্ট করে আনার দরকার নেই, হাসানকে দিয়ে আনিয়ে নেবো, তুই শুধু একটু......"। বাবা মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, বুঝিবা কল্পনা করছেন মাটির নিচের স্থায়ী আবাস্থলে যেতে আর কতদিন বাকি। মাটির উপরিভাগটা কেন তাকে সে দয়া করছেনা।
অবসরপ্রাপ্ত বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নীলার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
কিন্তু কান্নাগুলো আগের মত আর প্রান পায়না, শুকনা রুটির মত গলায় জট পাকিয়ে থাকে। যা গেলাও যায়না, উগরানোও যায়না। বাবার ছোটখাটো একটা চাকরি ছিলো, সেই চাকরীর টানাটানির সংসারে কোনভাবে বেঁচে থাকাই যখন দায়, তখন নীলা কিভাবে কিভাবে যেন ভার্সিটি পাস দিয়ে ফেললো। একদিন বাবার সেই চাকরীটাও চলে যায়। দেয়ালে যখন পিঠ থেকে এল, তখন হঠাৎ জানা গেলো এই দেয়ালটাও আর তাদের নয়, সবকিছু নাকি এখন চাচার।
সৃস্টিকর্তা হয়তো এতোটা দুর্যোগের মাঝে তাদের ফেলতে চাননি, তাইতো অনার্সটা পাস করার সাথে সাথেই নীলার চাকরিটা হয়ে যায়। তারপর এক নতুন গল্পের শুরু।
"বাবা হাসানের সামনে পরীক্ষা, আমিই নিয়ে আসবো, ওকেও ভালো মন্দ কিছু খাওয়ানো দরকার"।
কথাগুলো কঠিন স্বরে বলতে চায়নি নীলা। কিন্তু তারপরও যথেষ্ট কঠিন শোনালো।
বাবা এখন নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কি ভাবছেন উনি? উত্তরাধিকারে তার দুর্ভাগ্যটুকু মেয়েকেও ভাগে দিয়ে দিলেন কিনা। নীলা ঘর থেকে বের হয়ে আসে। যাবার আগে একবার মার সাথে দেখা করে যাবে। মার বাম হাত আর বাম পা প্যরালাইজড।
তারপরও তার বিছানায় শোয়া মা বাবার মত এতোটা কুন্ঠিত নন। মার কাছে আসলেই নীলুর মনটা হাল্কা হয়ে যায়। না, মা জেগেই আছেন।
"মা তোমার বিস্কুট আনতে ভুলে গিয়েছি”"
“"হ্যা,এর জন্যই তো তোর বাবাকে বলার জন্য পাঠালাম। তুই কি কম্পিউটার নাকি যে সব মনে রাখবি।
একে তো সারাদিন খাটাখাটনি করিস। তারউপর বাসায় এসে চারহাতে রান্নাও করিস। তোকে যে কয়টা ভালমন্দ খাওয়াবো, আল্লাহ সেই শক্তিটাও দিলেন না"। “
"তোর বাবার মনটা বেশি ভালো না, সেদিন এসে যারা তোকে দেখে গিয়েছিলো, মানা করে দিয়েছে। চাকুরী করা মেয়ে চায়না তারা।
তুইও রাজী হলিনা। আমাদের জীবন তো শেষই হয়ে গেলো, এখন তো মনে হয় যাবার আগে তোর জীবনটাও শেষ করে দিয়ে গেলাম। হাসানেরও বাস্তব জ্ঞান হলনা। কে আসবে তোকে নিতে, যখন দেখবে আমরা তোর ঘাড়ে এভাবে চেপে আছি"।
নীলা চুপ করে বসে রইলো।
বাবা যে কথাগুলো বলতে পারেন না, মা সেগুলো অবলীলায় বলে ফেলেন। সেই ভালো। ঘরের মাঝে দেয়াল তুলে আড়াল হবার কি দরকার। কি দরকার কল্পনায়, কাছের মানুষটির কল্পনা বুঝে নেয়ার। নীলার সংসার বলতে এখন অবসর বাবা, রুগ্ন মা আর এস এস সি পরীক্ষার্থী ভাই হাসান।
স্বার্থপর বরপক্ষের জন্য তারা মোটেও কোন আদর্শ কন্যপক্ষ নয়। বিয়ের পর বউ কামাই করবে, আর সে কামাই শ্বশুর শ্বাশুরির পেটে যাবে, এটা মেনে নেয়ার মত মহানুভব পাত্র পাওয়াটা কিছুটা নয়, অনেকটাই জটিল। নীলা মনে মনে খুশিই হয়, দুনিয়ায় মোট কতোগুলো খারাপ মানুষ আছে সে জানেনা, এই সুযোগে যদি কিছু খারাপ মানুষ চিনে নেয়া যায়, মন্দ কি!
আজ অফিসের দেরী হয়ে গেলো। তাড়াহুড়ো করে নামার সময় শুনতে পেল পাশের ফ্ল্যাটের চাচীর সুউচ্চ গলা, “"আইবুড়ো মেয়ের এত সাজগোজ যে, রাস্তা থেকে জামাই ধরে আনার মতলব নাকি"”। সাজগোজ বলতে নীলার তাড়াহুড়ো করে ইস্ত্রি করা সালোয়ার কামিজ আর একটা বেঢপ সাইজের লেডিস ব্যাগ।
এর মধ্যে মাত্র দুটো জিনিসই ম্যাচিং, জুতা আর ছাতা, দুটোই কাল রঙের। নীলা এসবের পাত্তা দেয়না,তার শুধু একটাই চিন্তা, বাবা শুনে ফেলেলেন নাতো, ক’দিন ধরে বাবার প্রেসারটা বেশ হাই।
অফিসের গাড়িটা নীলার জন্য দাঁড়ায়নি। কেউই কারো জন্য দাঁড়িয়ে থাকেনা। যেমন দাঁড়ায়নি আশরাফও।
স্কলারশিপটা পাওয়ার পর পরই বিয়ে করে বউ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেলো। নীলা বেশি কিছু তো চায়নি, অল্প ক’টা বছর, হাসানের পরীক্ষাটা শেষ হোক। না, আশরাফ অপেক্ষা করেনি। নীলাও কষ্ট পায়নি। আনন্দ পেয়েছিলো।
আবিস্কারের আনন্দ, মুখোশের আড়ালে স্বার্থপর মানুষগুলোর আসল চেহারা আবিস্কারের আনন্দ।
নীলার অফিসটা যেন একেবারে জমাটবাঁধা। বাহিরে খরা হচ্ছে, না সুনামি হচ্ছে ভেতর থেকে বোঝার কোন উপায় নেই। নীলার ধারনা একমাত্র ভুমিকম্প ছাড়া এ অফিস থেকে আর কিছুই টের পাওয়া যাবেনা। নীলা পাশের ডেস্কে তাকায়।
সিরাজ একমনে কাজ করছে। কি অদ্ভুত পরিশ্রমী আর আত্মমগ্ন একটা ছেলে। এত বছরের শহুরে কাঠিন্য তার গ্রাম্য সরলতাকে এতোটুকুও ম্লান করতে পারেনি। নীলার মাঝে মাঝে অবাক লাগে, সিরাজ জানে তো, তার পাশের ডেস্কটাতে নীলা নামের একটা মেয়ে বসে। সিরাজের মা বাবা নেই, মামার কাছে মানুষ।
পড়াশোনা আর কর্মজীবন হল আর মেসে থেকেই কেটেছে। কেমন হত সিরাজ যদি সিরাজ না হয়ে নীলা হত! বাবা মা নিশ্চয়ই খুশি হতেন। গর্ব করতেন। পাত্রপক্ষের কাছে মাথা নুইয়ে থাকতে হতোনা, পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার মুখ ঝামটাও খেতে হতোনা। এসব ভাবতে ভাবতেই নীলার চোখ চলে যায় সামনের ডেস্কে।
কাদের ভাই মুখে একটা কুৎসিত হাসি ঝুলিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। নীলা চোখ সরিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনে মন দেয়। একজন অবিবাহিত মহিলা কলিগ, তার দিকে এভাবে তাকানো তো পুরুষদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
"মিস নীলা"
নীলা ঘাড় না ঘুরিয়েই জানে এটা সিরাজ। এমন অদ্ভুতভাবে জুনিয়র অফিসারকে আর কেউ ডাকবেনা।
"আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি, আপনি কি আমার কল আসলে একটু ট্যাকল দিতে পারবেন"?
"চেষ্টা করবো"
"থ্যাংকস"
সিরাজ চলে গেলনা। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বলল," আপনাকে আজ বেশ ভালো লাগছে"।
কিছু বুঝে উঠার আগেই নীলা দেখল সিরাজ সামনে থেকে এক রকম দৌড়ে পালাচ্ছে।
এটা কোন ভালোবাসার গল্প না।
তাই সিরাজের বলা কথাটা নীলার ভাবনার জগতটা এলমেলো করে দিতে পারেনি। সিরাজও কোন বৃষ্টি ভেজা বিকেলে নীল গোলাপ নিয়ে ভালোবাসার কথা জানাতে আসেনি। কিন্তু নীলা আর সিরাজের বিয়ে হল, পারিবারিকভাবেই হোল। সংসারটা কিন্তু এখনো আগের মতই আটপৌরে। নীলার ঘরে এখনো এসি নেই, গ্যারেজে গাড়িও নেই।
কিন্তু তারপরও বাবা মার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায়না, অনেক দিন হোল। এটা কোন ভালোবাসার গল্প না, তারপরও নীলা সিরাজকে ভালোবাসে। এমন চমৎকার একজন স্বামীকে ভালো না বেসে কি পারা যায়?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।