বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ টোগো দেশটি পশ্চিম আফ্রিকায় । আটলান্টিক সমুদ্রের পূর্ব পাড়ে। দেশটির রাজধানী লোমে।
এককালে দেশটি শাসন করত ফরাসিরা । আজও লোমে শহরের পুরনো হলদে দালানকোঠায় ফরাসি শাসনের চিহ্ন রয়ে গেছে । শহরটিও তেমন ঘিঞ্জি নয়, বরং বেশ ফাঁকা। বহুতল ভবনও বড় একটা চোখে পড়ে না। শহরের উপকন্ঠে রয়েছে তেল শোধনাগার।
সে দিকটা অবশ্য ঘিঞ্জি। তবে মনোরম উপকূলে রয়েছে নীলাভ পানির লেগুন; রয়েছে সুদৃশ্য কটেজ, সুইমিং পুল; এসব কারণেই টোগোয় পর্যটন শিল্প জমজমাট।
১৯৯৫ সালের অগাষ্ট মাসের মাঝামাঝি । বর্ষাকাল সদ্য সমাপ্ত হয়েছে। এ দেশটিতে দু-বার বর্ষা আসে।
এরপর আবার বর্ষা আরম্ভ হবে সেপ্টেম্বর মাসে । তখন আকাশময় ভেসে বেড়াবে মেঘ । একটানা ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়বে । এখন অবশ্য আকাশের রং নীল ; পশ্চিমের আটলান্টিক সমুদ্র থেকে লোনা বাতাস উড়ে এসে শহরময় ছড়িয়ে পড়েছে ।
সকাল ন’টা।
লোমে শহরের ১৩ নং বুলেভার্ড সড়কে একটি কালো মার্সিডিজ চলেছে। মার্সিডিজের পিছনের সিটে বসে আছেন প্রিন্সেস ডায়ানা । রাজকুমারীর পরনের সাদা রঙের টিউনিকের উপর ঘিয়ে রঙের কোট। মাথায় হ্যাট; তাতে একটি লাল গোলাপ বসানো । রাজকুমারীর মায়াময় নীলাভ চোখ দু’টি স্বপ্লীল।
মুখে স্বর্গীয় ভাবনার প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তি। যেন রাজকুমারী এই মুহূর্তে মার্সিডিজে বসে নেই, কোনও দূরবর্তী সাদাকালো নির্জন গির্জেয় ধ্যানমগ্ন।
প্রিন্সেস ডায়ানার ঠিক পাশে বসে আছেন ড. মাউসতাফা সালাফাউ। মাঝবয়েসি ভদ্রলোকটি ব্রিটিশ স্কুল অভ লোমে-র অধ্যক্ষ। স্কুলটি প্রিন্সেস ডায়ানা পরিদর্শন করতে যাচ্ছেন।
পাঁচ দিনের শুভেচ্ছা সফরে টোগো এসেছেন প্রিন্সেস ডায়ানা । লোমে শহরটি পছন্দ হয়েছে রাজকুমারী । লোমে বন্দর নগরী হলেও বেশ পরিচ্ছন্ন শহর। বর্ষাকাল অতিক্রান্ত হয়েছে বলে সারাদিন উজ্জ্বল রোদে ভরে থাকে । আটলান্টিকের লোনা বাতাস গায়ে মেখে ফুটপাত দিয়ে শহরময় হাঁটতে ইচ্ছে করে রাজকুমারীর।
তবে সেটা সম্ভব না। প্রিন্সেস ডায়ানা রাজকুমারী। রাজকুমারীদের বন্দি জীবন যাপন করতে হয় ।
কৃষ্ণবর্ণের ড. মাউসতাফা সালাফাউ-এর শরীরটি স্থূলকায়। পরনে কালো কোট।
সাদা শার্টের উপর টাইটি হলুদ । ঈষৎ কোঁকড়া চুল। ভরাট মুখটি কিছুটা লম্বাটে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ফরাসি ভাষায় কথা বলছেন ড. মাউসতাফা সালাফাউ ।
... এ দেশে ইউই ভাষাভাষী মানুষই বেশি। এরা একাদশ থেকে ষোড়শ শতকে আফ্রিকার নাইজার নদীর উপত্যকা থেকে টোগোয় এসেছিল। তারপর ষোড়শ শতকে টোগো হয়ে উঠেছিল পশ্চিম আফ্রিকায় দাস ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র।
রাজকুমারী কেঁপে উঠলেন ...
ড. মাউসতাফা সালাফাউ অবশ্য সে কাঁপন টের পেলেন না ...
আজ প্রিন্সেস ডায়ানার দিনটি কাটবে ড. মাউসতাফা সালাফাউ-এর সঙ্গে। ড. মাউসতাফা সালাফাউ অবশ্য রাজকুমারীরর নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন নন।
রাজকুমারীর গাড়ি বহরে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ ছাড়াও সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর আট/দশটি গাড়ি রয়েছে। নিরাপত্তা কর্মী ছাড়াও গাড়িবহরে সাংবাদিকদের গাড়িও রয়েছে। সারা পৃথিবী রাজকুমারীর ডায়ানার সংবাদ জানতে উদগ্রীব। সংবাদ ও ছবি তারাই পৌঁছে দিচ্ছে।
ড. মাউসতাফা সালাফাউ বলে যাচ্ছেন ... সপ্তদশ শতকে টোগো ভাগাভাগি করে নিয়েছিল জার্মানী, ব্রিটেন ও ফ্রান্স ।
তবে লোমে বন্দর নির্মান করেছিল জার্মানরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ-ফরাসি সম্মিলিত সামরিক অভিযানের পর জার্মানরা আত্বসমর্পন করে। এরপ ব্রিটিশ ও ফরাসিরা দেশটি ভাগ করে নেয়। উপকূলসহ লোমে শহরটি ফরাসিদের ভাগে পড়ে। আর অভ্যন্তরীণ খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চল ও কোকো প্লানটেশন-এর দখল বুঝে নেয় ব্রিটিশরা।
১৯৬০ সালে টোগো স্বাধীনতা লাভ করে। যা হোক। এবার আসল কথায় আসি। লোমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে। এটিই এদেশে উচ্চশিক্ষার প্রধান প্রতিষ্ঠান।
সরকার অবশ্য আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছে। স্কুলে শিক্ষার মাধ্যম ইউই ভাষা এবং ফরাসি। টোগোয় শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে মিশনারি স্কুলের ভূমিকা গুরুর্ত্বপূর্ণ। জনসংখ্যার অর্ধেক অংশে তারাই শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে ; ... বর্তমান সরকারের বাজেটের ২৫% শিক্ষাখাতে ব্যয় হয়। দেশের সকল শিশুকে প্রাইমারি স্কুলে আনার চেষ্টা করছে সরকার ।
তবে সমস্যাও আছে। টোগো দেশটি কৃষিভিত্তিক । জনসংখ্যার ৬৬% কৃষিখাতে নিয়োজিত। এদেশে কৃষির প্রধান বিপদ খরা। খরায় ফসল জ্বলেপুড়ে যায়।
কৃষক একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে ভাসমান জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয় । অনেকেই লোমে শহরে চলে আসে ...সরকার এদের খাওয়াবে না শিক্ষার ব্যবস্থা ...
প্রিন্সেস ডায়ানা কথাগুলি মন দিয়ে শুনছিলেন। তবে বারবার মনোযোগ ছিঁড়ে যাচ্ছিল তার । কালরাত্রে অদ্ভূত এক স্বপ্ন দেখেছেন প্রিন্সেস ডায়ানা ।
সেই স্বপ্নই এখন মাথার ভিতরে ভাসছে । ... মনে হল একটি গির্জে ... সাদাকালো নির্জন গির্জে ... তার আবছা গম্বুজ। কাঁচে ঘেরা ঘর। সাদাকালো মেঝে। ঘরে পা রাখতেই উড়ে গেল অজস্র পায়রা।
আর ... একটি শিশু। কালো রঙের । শক্ত কোঁকড়া চুল ... রাজকুমারী দৌড়ে যেতেই শিশুটি অদৃশ্য হল ... যেন কোনও দেবদূত শিশুটিকে নিয়ে গেছে ... গভীর শূন্যতার বোধ গ্রাস করে রাজকুমারীকে। যে গভীর শূন্যতার বোধ বুকের ভিতরে টের পাচ্ছিলেন কিশোরী বয়েস থেকে ...
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন প্রিন্সেস ডায়ানা ।
তারপর জানালার বাইরে তাকালেন ।
সকালের রাস্তা ফাঁকা । ফুটপাত লোকজনের চলাচল কম। ছবির মতো বাড়িঘর। বাড়ির সামনে নাড়িকেল আর কোকো গাছ চোখে পড়ে।
হঠাৎ প্রিন্সেস ডায়ানা বললেন, ড. মাউসতাফা সালাফাউ?
জ্বী।
বলুন।
আপনি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলুন, প্লিজ। প্রিন্সেস ডায়ানা বললেন।
জ্বী। বলছি।
অবাক হলেও ড. মাউসতাফা সালাফাউ রাজকুমারীর নির্দেশ অগ্রাহ্য করতে পারলে ন না।
ফুটপাত ঘেঁষে গাড়ি থামল।
প্রিন্সেস ডায়ানার গাড়ি থেমে যেতেই গাড়ির বহরটিও থেমে যায়। সাদা শার্ট, কালো কোট, কালো সানগ্লাস পরা নিরাপত্তা কর্মীরা দৌড়ে আসে। একহাতে হাতে ওয়ারলেস, আরেক হাত হোস্টারের সেমি-অটোমেটিক- এ...
দৌড়ে আসে সাংবাদিকরাও ।
তাদের হাতে ক্যামেরা।
প্রিন্সেস ডায়ানা গাড়ি থেকে নেমে এলেন।
তারপর ফুটপাতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।
ফুটপাতের ওপর কতগুলি স্থানীয় নারীপুরুষ বসে আছে। দেখলেই বোঝা যায় এরা দরিদ্র।
এদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। এরা সম্ভবত ভাসমান?। এরা কি খরার কবলে পড়ে সর্বশ্রান্ত হয়েছে? তখন ড. মাউসতাফা সালাফাউ বললেন ... এরা কি গ্রাম থেকে এসেছে?
একটি নারীর কোলে একটি শিশু। শিশুটি কালো। হাড়জিরজিরে।
চোখের কোণে পিচুটি, সর্দি লেগেছে ... নাক দেখলেই বোঝা যায় ...
ঝুঁকে সেই কালো শীর্ণ শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন রাজকুমারী।
ক্লিক ক্লিক ক্লিক ...
ঝলসে উঠল ফটোসাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ...
রাজকুমারী হাসলেন।
কিন্তু কেউই জানতে পারল না ... কিশোরী বয়েস থেকে রাজকুমারীর বুকের ভিতরে যে গভীর শূন্যতার বোধ ছিল, তা এই মুহূর্তে আর নেই ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।