তখন আমি বেশ ছোট। বয়স ৯ কি ১০ হবে। কি করে যেন সে বয়স হতেই বেশ গল্পের বই এর ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার সেই বই পড়া হবিটাকেই উৎসাহ দিতে বাবা, মা, মামা, চাচা, খালারাও আমাকে মোহোৎসাহে বই উপহার দিয়ে যেতে লাগলেন। সে সময় একদিন হঠাৎ হাতে পেয়ে গেলাম এক অদ্ভূত সুন্দর বই।
বইটার নাম মৎস্যকুমারী। বইটার প্রচ্ছদে ছিলো অদ্ভুত একটা ছবি। অপূর্ব সুন্দর মিষ্টি চেহারার এক মায়াবতী কন্যার শরীরের অর্ধেকটায় মাছের সুদৃশ্য আঁশ মন্ডিত লেজ। কি যে অদ্ভুত এক ব্যাপার! আমার শিশুমনে যা ভীষনভাবে দাঁগ কেটে গেলো। মনে পড়ে, খুব অবাক হয়ে দেখেছিলাম সেই ছবিটা।
এমনকি বইটা কতবার যে পড়েছিলাম তার ইয়ত্তা নেই আর প্রতিবারই বইটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম ছবিটাকে।
সেই আমার প্রথম জলের তলের জগতটার সাথে পরিচয়। জলের তলে যে হাজার রকমের প্রাণী থাকে সেও কিছুটা জেনে গিয়েছিলাম হয়তো এই বইটা পড়েই। তারপরপরই আমার ভেতরে জন্মে জলের তলের রহস্য জানবার এক দুর্মর ঝোঁক। তারও অনেক পরে জেনেছিলাম এই মৎস্যকুমারী গল্পের সৃষ্টিকারী হ্যান্স ক্রিসচিয়ান এ্যান্ডারসন সম্পর্কে।
এরপর এই মৎস্যকুমারী বা জলকন্যা আমার জীবনের এক প্রিয় অধ্যায় হয়ে উঠলো। জলের তলে থাকবে শুধুই মাছ টাইপ জলচর প্রাণীরা, সেখানে যে এমন সব অদ্ভুত সুন্দর রাজপ্রাসাদ থাকতে পারে , থাকতে পারে এমন সব মনুষ্য সদৃশ প্রাণীরা, সে ব্যপারটা আমাকে আমার ছোট বেলায় খুবই বিমোহিত করেছিলো।
সেই জলকন্যা বা মৎস্যকুমারী এরিয়েল, মর্ত্যবাসী রাজকুমার এরিককে ভালোবেসে যাকে দিতে হয়েছিলো চরম মূল্য, সে ব্যাপারটাও আমাকে বিমর্ষ করে তুলতো খুব বেশী। সেই জলকন্যার দুঃখে আমার হৃদয় ভেঙ্গে যেত। খুব খুব ভাবতাম সেই অতল জলের নীচে সত্যি কি আছে ওমন কোনো রাজপ্রাসাদ.....এরিয়েলদের বাড়ি? মা বলতেন, হ্যাঁ আছে ।
নইলে গল্প হলো কোথা থেকে? আমার মায়ের এমন সব গল্পকথার জন্য বা আমাকে হাবিজাবি যা হোক একটা বুঝ দেবার জন্যই হয়তোবা মিথ্যেটাকে সত্যি ভেবেই কল্পনার রাজ্যে ভাসতে ভাসতে আমি একসময় হয়ে উঠলাম জলজ্যান্ত একটা কল্পনা বিলাসী ভাবুক।
আমি প্রায় দুপরেই জানালায় বসে গালে হাত দিয়ে দূরে তাকিয়ে ভাবতাম আচ্ছা জলকন্যা এরিয়েল তো ভালোই ছিলো সুনীল সাগরের জলরাজ্যের রাজ প্রাসাদে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলেই ঢেউ এর তালে তাল মিলিয়ে ভুস করে জলের উপর ভেসে ওঠা, সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় ভেসে দূর থেকে দূরে চলে যাওয়া। কি দরকার ছিলো তার মর্ত্যের রাজকুমাররে প্রেমে পড়বার? সুখে থাকতে ভুতে কিলানো আর কি। যত্তসব!:
আরো ভাবতাম তারা তো অর্ধেক মানবী ও অর্ধেক মাছ আর তাইতো মানুষের মত হাঁটতে পারেনা ।
বলতে পারেনা মানুষের ভাষা। রাজকুমার এরিকের জন্য সে মাছের লেজ বিসর্জন দিয়ে মানুষের মত পা বানিয়ে মর্তে উঠে এসেছিলো। জলের যাদুকরীর নিষ্ঠুর ভয়ংকর শর্তও সে মেনে নিতে দ্বীধা বোধ করেনি যে যদি সে বিফল হয় আর কখনও ফেরা হবে না তার জলরাজ্যে। একবার জলজগৎ বিসর্জনের পর সাগরের এক ফোঁটা জল গায়ে ঠেকলেই নির্ঘাত মৃত্যু। সব শর্ত নির্বিচারে মেনে নেয় জলকন্যা।
তবুও পায়না ভালোবাসার মানুষের মন। শেষ পর্যন্ত বেঁছে নিতে হয় করুণ মৃত্যু।
জলকন্যার এমন আত্নত্যাগ সেই ছেলেবেলাতেই আমার মনে এমন ভাবেই গেঁথে গিয়েছিলো যে এই জীবনে আর ভোলা হলোনা তাকে। যখন যেখানেই তাকে পেয়েছি বেড শিটে, ছবিতে, স্টিকারে, ব্যাগে আপন করে নিয়েছি তাকে। বলতে গেলে বেশ বড় হবার পরেও বিশাল এক জলকন্যা মেমোরিয়াল স্টোর ছিলো আমার।
তার কিছু অবশিষ্ঠাংশ এখনও অবশ্য আছে।
বড়বেলায় লিটল মারমেইডের আদলে তৈরী মুভ্যির জলকন্যা।
স্প্লাশ মুভ্যি
http://www.allmovia.com/mov/splash/
সত্যি বলতে কি আমার আজও বিশ্বাস হয় যে জলকন্যা বলে কেউ একজন ছিলো যে একদিন সাগরের জলে মিশে গিয়েছিলো তার ভালোবাসার চরম মূল্য দিতে।
এরপর আমার কল্পনার রাজ্যে যোগ হলো আরেক জলমানব যার নাম ইকথিয়েন্ডর। ইকথিয়েন্ডরের দুঃখ আবারও আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো দূর বহূদূর এবং বহূদিন।
গুণী লেখক এ্যালেক্সানডার বেলায়েভের উভচর মানুষ বইটা পড়বার পর আমার তখন মোটামুটি দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে আসলেই জলের তলে জলমানব বা জলমানবী বলে কিছু একটা নিশ্চিৎ আছেই। তারা হয়তো মানুষের ভাষায় কথা বলতে জানেনা , চলতে পারেনা এই ধুলোমাটির ধরিত্রীতে কিন্তু মানুষের জন্য রয়েছে তাদের এক বুক ভালোবাসা। আহা মর্ত্যের মানব মানবীরা কিছুতেই কেনো বুঝেনা তাদের দুঃখ, তাদের আবেগ?
এ্যালেক্সানডার বেলায়েভ
বইটিতে ডঃ সালভাদর সৃষ্টি করেছিলেন একটি মুমূর্ষ শিশুদেহে ডলফিনের অঙ্গ প্রতঙ্গ জুড়ে এক উভচর মানব। যে কিনা পানিতে ভেসে থাকতে পারে দিনের পর দিন কিন্তু ডাঙায় ধুলোবালিতে খুব বেশীক্ষন থাকতে না পারলেও বেশ কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারতো। জল ছাড়া একটানা বেঁচে থাকা সম্ভব ছিলো না তার পক্ষে।
অপরুপ মায়াময় নিস্পাপ আমার ছেলেবেলার সেই স্বপনকুমারও প্রেমে পড়েছিলো এক মর্ত্যমানবীর আর তাকেও জলকন্যার মত দিতে হয়েছিলো ভালোবাসার চরম মূল্য। ছুটে এসেছিলো সে জলমানব ইকথিয়েন্ডর অনেক কষ্ট সয়েও তার প্রিয়তমা গুত্তিয়েরের কাছে তাকে এক নজর দেখবার আশায়। বিনিময়ে মানুষের কাছে পেয়েছিলো নিষ্ঠুর আচরণ আর প্রবন্চনা। হায়রে ভালোবাসা । জীবন মরণ সব হিতাহিত জ্ঞান লোপ পাইয়ে দেয়।
মাঝে মাঝে যখন টেলিভিশন বা খবরের কাগজে দেখি বা পড়ি, পথ ভুলে বন থেকে মনুষ্য জগতে চলে আসা কোনো বনের প্রাণীকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে বা কোনো ডলফিন বা সাগরের প্রাণীর ভুলক্রমে জেলেদের জালে আটকে পড়া আর তারপর করুণ পরিনতির দৃশ্য । আমার মনে পড়ে এরিয়েলকে। মনে পড়ে ইকথিয়েন্ডকে। ছেলেবেলার জলের তলের সেই প্রিয় মানুষদের জন্য সেই সূচীভেদ্য তীক্ষ ব্যাথাটা আজও হৃদয়ের মাঝে চিনচিন করে বেজে ওঠে। মনে প্রশ্ন জাগে আমরা কেনো পারিনা এই সুন্দর
অপরূপ বৈচিত্রময় সৃষ্টির সেরা জগৎটাতে সবাই মিলে যে যার মত করে ভালোভাবে একটু বাঁচতে? প্রাণভরে উপভোগ করতে বেঁচে থাকার প্রতিটা নিঃশ্বাস?
লেখাটি স্তব্ধতা ভাইয়া আর ধীরে বৎসকে উৎসর্গ করা হলো.......কারণ অনেকদিন আগে আমার লেখা এ পোস্টটিতে Click This Link
তাদের সহ আরো অনেকের(পলাশমিঞা, বড় বিলাই, পথে-প্রান্তরে, সমুদ্র কন্যা, সকাল রয়, চতুষ্কোণ, রাজসোহান, মনিরুল হাসান, সায়েম মুন,কাব্য,টানজিমা, ভাঙ্গন,ফাহাদ চৌধুরী, কাঠের খাঁচা,হায় ঈশ্বর!,আসাদ বাবু, মে ঘ দূ ত, দুরন্ত স্বপ্নচারী,অরুদ্ধ সকাল ,মেহেরুবা, হাসান মাহবুব, বৈরী হাওয়া, হানিফ রাশেদীন, পাহাড়ের কান্না, সাঁঝবাতি'র রুপকথা, আমি ভাল আছি, নস্টালজিক ,মুকুট বিহীন সম্রাট, নাগরিক, হিরম্ময় কারিগর কোর আই সেভেন,সুরন্জনাআপু,জেরী, প্রতীক্ষা ,হানিফ রাশেদীন, বীনা, জুন, রেজোয়ানা, ভোরের তারা, রিমঝিম বর্ষা ) কমেন্টগুলো আমাকে এ লেখা লিখতে অনেকদিন যাবৎ খোঁচাচ্ছিলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।