পথ বাঁধতে চেয়েছিল বন্ধনহীন গ্রন্থি...
ইহা একটি ছোটবেলা প্রযোজনাঃ পর্ব একঃ গান
আমার স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো, অনেক আগের অনেক কথাই আমি খুব ভালোভাবেই মনে করতে পারি... এর ভালো-মন্দ দুইই আছে। ভালো স্মৃতির মাঝে বলা যায়, আমার তিন-চার বছর বয়েসে ইকবাল রোড্ নানাবাড়ির তিনতলার বারান্দায় আমার ছোটখালার প্রতিরাতে আমাকে কোলে নিয়ে গান গাইতে গাইতে আমাকে ঘুম পাড়ানোর কথা আমার মনে আছে [যদিও এখন ভাবলে যে দৃশ্যটা আমি দেখি তা দর্শকের চোখ দিয়ে, খালার কাঁধে মাথা রেখে আশপাশ পর্যবেক্ষণের নয়!] খালার গাওয়া যে গানটা আমার প্রিয় ছিল সেটা ভালবাসার গান, 'আকাশের ঐ মিটি মিটি তারার পানে কইবো কথা, নাইবা তুমি এলে'... খালাকে নাম দিয়েছিলাম 'আকা'- এই গানের প্রথম শব্দের অপভ্রংশ করে, তাঁকে এখনও তাইই ডাকি...
আমার দুই খালা গান গাইতেন খুব সুন্দর, আরেক খালা নাচতেন ভালো, বড় খালা ছিলেন পড়াশোনায় তুখোড় আর আমার মা ছিলেন রান্না-ইকেবানা-হাতের কাজ-সেলাই ইত্যাদি বহুগুনে গুনান্বিতা। তখনকার দিনে বোধহয় রেওয়াজ ছিল মেয়েদের বিভিন্ন কারুশীল্পে পারদর্শী করার, ভালো পরিবারে বিয়ে দেবার রিকোয়্যারমেন্ট ছিল বোধহয় এরকম! সেজ খালা আর ছোটখালা একসাথে হলেই বাসায় বসতো গানের আসর। মোটামোটি প্রতি বৃহঃস্পতিবারেই খালা-মামারা জমায়েত হতেন ১০/১৭, আমাদের ইকবাল রোডের বাসায়, সুস্বাদু নানা গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যেত চারপাশ! একেক খালা একেক রকম খাবার রাঁধতেন, মেজ মামা আইসক্রিম/কুলফি বানাতেন, ছোটমামা আমাদের নিয়ে বেড়িয়ে আসতেন তার মোটরবাইকে, আর বড়মামা মুখ গম্ভীর করে নানাভাইকে নকল করে আমাদের দিতেন ধমক! ছোটখালা বিয়ে করে জ্যামাইকায় আর সেজ খালা কুমিল্লা ক্যাডেটে টীচার হয়ে চলে যাবার আগ পর্যন্ত প্রতিসপ্তাহ শেষে এমনটাই রীতি ছিল। খাওয়া দাওয়া সেরে রাতের বেলা বসবার ঘরের কার্পেটে বালিশ নিয়ে আধশোয়া হয়ে সিনেমা দেখা হতো অথবা বসতো গানের আসর।
অসংখ্য রবীন্দ্র/নজরুল সংগীতে ভরা আমার এই ছেলেবেলাটা, শত অপ্রাপ্তির মাঝেও আমার বড় প্রিয়। খালার কাছে শিখেছিলাম কত্ত গান, দুপুরে আম্মু ক্যাসেট বাজাতো সতীনাথ বা ফাতেমা তুজ জোহরার, ছোট্ট আমার খুব পছন্দের ছিল আলমগীর। এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছি আমি আলমগীরের ক্যাসেটটা, 'আমার হাড় কালা করলাম রে', 'আমায় ভাসাইলিরে' এই গানগুলো এখনও আমাকে নিয়ে যায় বছর ১৫-১৬ আগের অলস দুপুর গুলোয়, যখন কাজ শেষে আম্মু কুরুশের কাজ নিয়ে আধশোয়া হয়ে গান শুনছে আর আমি মেঝেতে বসে ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দিচ্ছি বা গুলি বানাচ্ছি গুলতির জন্য। সতীনাথের গলায় আমার পছন্দ ছিল দুটো গান, 'এলো বরষা' আর 'আকাশ এতো মেঘলা'... মনে পড়ে এই গান গুনগুন করতে করতে কতদিন দুপুরে বেনী দুলিয়ে এঁকেছি মেঘে ভরা আকাশের নিচে ভিজে ঝুব্বুস মানুষের ছবি...
তারপরে যেভাবে সবাই শেখে সেভাবেই শিখলাম,
টাট্টু ঘোড়া পাড়লো ডিম
শেয়াল দিলো তা
দুদিন পরে বের হলো এক কানা বগীর ছা
বাহ বাহ বাহ। বাহ বাহ বাহের সাথে তাল মিলিয়ে হাত তালি দেয়াটা আমার প্রায় ব্যারামের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল!
নাচের স্কুলে হতো আরেক মজা।
কমল ভাইয়া শুধু হাতে তালি বাজিয়ে আগে আমাদের গানটা শেখাতো, পরে দেখিয়ে দিত নাচের মুদ্রা। সেখানেও শিখেছি অনেক গান যেগুলো বাসায় আকা এলে শিখিয়ে দিত আমাকে অনেক যত্নে।
মোমেরও পুতুল মমীর দেশের মেয়ে
নেচে যায় বিহবল চন্চল পায়,
সাহারা মরুর পারে খর্জুর বিথীর ধারে,
বাজায় নুপুর ঝুমুরঝুমুর মধুর ঝংকারে!!
এছাড়াও,
প্রজাপতি প্রজাপতি
কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা
টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা!!
আমরা সবাই রাজা
আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলবো কি শর্তে ।
লাল টুকটুকে বউ যায়গো
লাল নটের ক্ষেতে গো লাল নটের ক্ষেতে
তার আলতা পায়ের চিহ্ন এঁকে নালতা শাকের গায়ে!!
শুকনো পাতার নুপূর পায়ে নাঁচিছে ঘূর্ণিবায়,
জলতরঙ্গে ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি ঢেউ খেলে সে যায়...।
ধিতাং ধিতাং বোলে
তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল
আজি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল
সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা, বাংলা মায়ের কোল...
লীলাবালি লীলাবালি
বরজবতি সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে...
জাতীয় জাদুঘরে প্রথম যেদিন অনুষ্ঠান ছিলো আমাদের সেদিন 'সোহাগ চাঁদ বদনী ধনি নাচো তো দেখি' - দলীয় নাচের মাঝে ৬-৭ বছরের আমার শাড়ি খুলে গিয়েছিল, সবাই যখন নাচছে তখন অপমানে আমার চোখে পানি এলেও আমি নাকি শাড়ি ধরে গটগট করে স্টেজের পিছনে চলে গিয়েছিলাম।
হায়রে... ভাগ্যিস বয়েস কম ছিল, নাহলে বেইজ্জতি কারবার হয়ে যেত!
এরপরে নাচ জমা হলো অতীত স্মৃতির মাঝে, স্কুলে গানের ক্লাসে যেতাম সবসময়েই, তবে এবার এতে একটু বেশি মনোযোগী হলাম। যিনি আমাদের গান শিখাতেন সেই আপুর নাম মনে নেই আমার, তবে তিনি কিছু অদ্ভুত সুন্দর গান শিখিয়েছিলেন আমাকে। মনে আছে আকার কাছে বিকেলে বসে 'Doe a deer a female deer' শেখার কথা। আর ছিল 'এসো গান শিখি'- টিভির সামনে বসে খালামনির কাছেও কম গান শিখিনি আমি।
একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল
আমাকে তুই বাউল করে সঙ্গে নিয়ে চল
এই জীবন মরণ মাঝে তোর সূর যেন বাজে!!
ধনেধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক, সকল দেশের সেরা।
তিমি মাছের নাম তো জান জান কি তার পরিচয়
নামটা তিমি মাছ হলেও আসলে সে মাছ নয়।
আইলো দেয়া ঈশানে,
সকালে কি বিকেলে
মাঠে ঘাটে নামলো পানির ঢল্রে
নামলো পানির ঢল...
ঐ ঝিলে বিলে ঢেউ খেলেরে
ছলাত ছলাত ছল...
মুক্তা মেলা ছাতি মাথায়
বর্ষা এলো রে
সারা গায়ে গোলাপ পানি
ছিটিয়ে দিলো রে...
মেঘের কোলে রোদ উঠেছে বাদল গেছে টুটি,
আজ আমাদের ছুটিও ভাই আজ আমাদের ছুটি ...
যাদুর পেন্সিল আহা যাদুর পেন্সিল
আমার থাকতো যদি এমন একটা যাদুর পেন্সিল।
আমি যার নুপুরের ছন্দ
বেনুকার সূর
কে সেই সুন্দর কে ??
ঝড় এলো এলো ঝড় আম পড় আম পড়
কাঁচা আম পাকা আম টকটক মিষ্টি
এই যাহ এলো বুঝি বৃষ্টি।
ক এ কলা খ এ খাই,এত বেশী খেতে নাই।
গ এ গরু ঘ এ ঘাস কত ঘাস খেতে চাস।
একদিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাবো,
নীল আঁকাশে সবুজ ঘাসে খুশীতে হারাবো।
হাট্টিমাটিমটিম,
তারা মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা হাট টিমাটিম টিম।
বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপুরে
আয় বাবা দেখে যা দুটো সাপ রেখে যা
ও মাগো মা অন্যকিছুর গল্প বল...
একযে ছিল রাজা রানী অনেক হল...
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় গেয়েছোযে গান
ফিঙ্গে নাচে দোয়েল নাচে
নাচ ময়ূরী নাচরে
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
হায় রে আমার মনমাতানো দেশ
সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা, সোনা নয় তত খাঁটি
বল যত খাঁটি তার চেয়েও খাঁটি, বাংলাদেশের মাটি...
হায় ছোট্টবেলার সেই দিনগুলো হারিয়ে খারাপ তো লাগেনা মনটা...
সেই লাল-নীল হলুদে রাজা রানী পুতুলে, ভরা ছিল জানালার কোনটা।
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান দেবো মেপে
আয় রিমঝিম বরষার ফাগুনে
রে কাঠ ফাঁটা রোদের আগুনে
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে আয়রে!!
টগবগ টগবগ টগবগ টগবগ
ঘোড়া ছুটিয়ে...
এরপরে একদিন নতুন কুঁড়িতে শুনে শিখে ফেললাম,
জানো?...আমি জাদু জানি...
আমার জানা নানা রকম ফুস মন্তর ফুসে...
আগুন জ্বলে কাঠ কয়লা তুষে...
আর পাথর গলে হয় নোনা পানি...
আমি জাদু জানি...
কোনও এক সিনেমার গান,
মাস্টার সাব আমি নামদস্তখত শিখতে চাই,
কোনওদিন কেউ যেন বলতে না পারে,
তোমার কোনও শিক্ষা নাই।
এই সিনেমার নাম মনে নাই, তবে গোলাম মোস্তফা ছিলেন এইটা মনে আছে
আয়রে আমার কোলে আয় এখুনি,
এ হাত টা ভালো করে ধর এখুনি,
ছেলেবেলার মত বায়না ধরে,
কাছ থেকে নেনা তুই আমায় কেড়ে।
আয় খোকা আয়.......আয় খোকা আয়।
এছাড়া 'দ্য জাঙ্গল বুক' এর, 'জঙ্গলে ভোর হলো, আজ নতুন প্রভাত এলো। ' 'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী'র একটা গান ছিল, আর 'ছুটির ঘন্টা' সিনেমার [মনে হয় - আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী; সাথী মোদের ফুলপরী...] এখন মনে পড়ছেনা। মন খারাপ আরও ছিল 'ধন্যি মেয়ে' সিনেমার গান, 'যাহ যাহ বেহায়া পাখি যা না...'
'কোথাও কেউ নেই' এর 'হাওয়ামে উড়তা যায়ে' আর রুদ্রের 'ভাল আছি ভালো থেকো'... এই গানগুলোও ভুলবোনা কখনও!
যে গানগুলো উল্লেখ করেছি মোটামোটি সবগুলোর সুর আর কথা মনে আছে একটু হলেও। আরও গান ভুরভুরি কাটছে মনে।
আরেকটা পোস্টে নাহয় দিব বাকিদের নিয়ে।
এইরকম একটা পোস্ট লেখার চিন্তা আসে মাস দুয়েক আগে যখন একদিন যখন জি এম তানিম আমাকে নিচের গানের লিঙ্কটি দ্যান, আর 'বাঁধ ভাঙ্গার আওয়াজ'-এ অপ্সরাপুর একটা পোস্ট পড়ে। এই লেখার ধারণা দেবার জন্য ধন্যবাদ তাদেরকে। বেশ কিছু গানের কথা মনে করিয়ে দেয় আপুর পোস্ট। অবশ্য আরেকটি ছোট কারণ আম্মুর টিভিপ্রীতি।
প্রতিরাতে জি বাংলায় ছোট্ট ছোট্ট গুবলু গাবলু বাচ্চাদের মুখে, 'আহ! উহ!' অশ্লীল শব্দ যোগে সেরাম প্রেমের গান [খাবার ঘর পেরিয়েও] শুনে আমি যারপরনাই বিরক্ত। কিছুতেই বুঝে পেলাম না এতো সুন্দর বাচ্চাদের গান থাকতে এইসব খাইষ্টা গান কিকরে এই পিচ্চিগুলাকে গাইতে দেয়া হয়! আমার বান্ধবীর ছোট খালাতো বোন যখন চোখ বড় বড় করে গায়, 'অল্প বয়েসে পিরিতি করিয়া, হয়ে গেল জীবনের শেষ' তখন হাসি চাপতে না পারলেও মেজাজ কম গরম হয়না! মন খারাপ
অন্তরা চৌধুরী - ছোটবেলার গান
[দুঃখিত বানান ভুলের জন্য, আর পোস্টের আকারের জন্য... একটা গানও বাদ দিতে ইচ্ছা করলোনা, এই অংশটাই দুই পর্বে দিলে ভালো লাগবে বলে মনে হয়নি। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।