বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের রজব মাস। মধ্যাহ্নের বিবর্ণ আকাশে গনগনে সূর্য যেন আরবের মরুভূমির উপর গলিত অনল বর্ষন করছে । যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল মরিচিকাময় রুক্ষ ধূ ধূ মরুপ্রান্তর।
তবে দূরে একটি মরুদ্যানের আভাসও যেন চোখে পড়ে। তপ্ত বালির উপর একটি উট চলেছে। উটের উপরে উপবিষ্ট খলিফা ওমর আল খাত্তাব । খলিফা চলেছেন জেরুজালেম নগরে। ওখানে সাধু সোফ্রোনিয়াস-এর কাছ থেকে জেরুজালেম নগরের দায়িত্বভার বুঝে নিবেন।
উটের রশি ধরে হাঁটছিল একজন মধ্যবয়েসি আবিসিনিয় দাস। দাসের নাম আবু দাইয়ান। প্রখর রৌদ্রের তাপদাহে আবিসিনিয় দাসটির কৃষ্ণবর্ণের শরীরটি ঘেমে গেছে । তৃষ্ণায় কন্ঠনালী শুকিয়ে গেছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পরছে তার ।
পায়ের তলায় উষ্ণ বালি তপ্ত শলাকার মতো বিঁধছে। খালি পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে কপালের ঘাম মুছে নিল আবু দাইয়ান। খিদেও টের পায় সে।
উটের উপরে উপবিষ্ট খলিফা একবার চকিতে আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ওহে আবু দাইয়ান, এইবার একটু থামো তো বাপু।
আবু দাইয়ান উটের রশি ধরে থমকে দাঁড়াল।
খলিফার ইশারায় উটটি হাঁটু গেড়ে বসল। খলিফা উট থেকে নেমে এলেন। কষ্টসাধ্য যাত্রাপথেও সৌম্যদর্শন খলিফার মুখটি ভারি প্রসন্ন দেখায়। খলিফা আশেপাশে তাকালেন।
নিকটেই একটি মরুউদ্যান। সে উদ্যানে খেজুর গাছের সারি এবং জলাশয় রয়েছে দেখে খলিফা দু-হাত তুলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালেন ।
খলিফা বললেন, চল, আবু দাইয়ান এখন নামাজ সেরে নিই। নামাজ সেরে কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে।
খলিফা আবু দাইয়ান এর পাশে বসে জলাশয়ের শীতল পানিতে অজু সেরে নিলেন।
অজু সেরে খলিফা আজান দিলেন।
মধুর দরাজ কন্ঠস্বর খলিফার। আজানের সুর দূরের ধূসর পাহাড়শ্রেণিতে প্রতিধ্বনিত হল। খেজুর পাতারা আন্দোলিত হল বাতাসে । বেহেস্তি সুরের আকর্ষনে কয়েকটি আবাবিল পাখি উড়ে আসে।
আজান শেষ হলে আবু দাইয়ান খেজুর গাছের ছায়ায় চাদর বিছাল। তারপর খলিফার পাশে নামাজে দাঁড়াল। নামাজের পর আবু দাইয়ান খলিফার মুখোমুখি খেতে বসল। একটিই মাত্র রুটি অবশিষ্ট আছে। আর আটটি খেজুর।
খলিফা রুটির অর্ধেক ছিঁড়ে আবু দাইয়ান কে দিলেন। খেজুরও সমান ভাগ করলেন খলিফা।
...আবু দাইয়ান এতে বিস্মিত হয় না। সে বেশ কিছুকাল ধরে খলিফার সান্নিধ্যে আছে । অনেক আগেই খলিফার উদারতার পরিচয় পেয়েছে সে ।
খলিফা সাদাসিদে জীবনযাপন করেন। মসজিদের সিঁড়িতে ভিখেরিদের পাশে ঘুমান। মদিনার অনেকেই আবু দাইয়ান কে দাস বলে ‘তুই তোকারি’ করে। খলিফা আবু দাইয়ান-এর পুরো নাম ধরেই ডাকেন। মদিনার অনেকেই দাস বলে আবু দাইয়ান কে অবজ্ঞা করে।
খলিফা সেরকম নন। খলিফা আবু দাইয়ান কে সমকক্ষই মনে করেন।
খেজুর গাছের ডালে একটি আবাবিল পাখি বসে ডাকছিল। খেতে খেতে মন দিয়ে সে ডাক শুনলেন খলিফা । খলিফার মুখে যেন আভা ছড়াল।
খাওয়ার পর দু-হাত তুলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালেন খলিফা। তারপর আবদুল দাইয়ান কে বললেন, আবদুল দাইয়ান। এবার তোমার পালা।
আবদুল দাইয়ান এবার উটের পিঠে চরে বসল।
মদিনা থেকে যাত্রা করার পর পালাক্রমে কখনও আবদুল দাইয়ান কখনও খলিফা উটের রশি ধরে হাঁটছেন।
এবার খলিফার উটের রশি ধরে হাঁটার পালা। যেন এই মুহূর্তে খলিফাই দাস আর আবু দাইয়ান প্রভূ। হাঁটতে হাঁটতে প্রখর রৌদ্রে ঘেমে উঠলেন খলিফা । পায়ের তলায় উষ্ণ বালি তপ্ত শলাকার মতো বিঁধছে। তবু খলিফার মুখটি ভারি প্রসন্নই দেখায়।
পথের চতুর্দিকে কমলা রঙের বালির সমুদ্র আর দূরে ধূসর রঙের পাহাড়শ্রেণি। প্রাণ ভরে আশেপাশের মনোরম দৃশ্যাবলী দেখছেন খলিফা।
অপরাহ্নে জেরুজালেম নগরের দূর্গপ্রাচীর দেখা গেল ।
আবু দাইয়ান কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠে বলল, হে আমিরুল মোমেনিন, আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। আপনি এবার উটে চরে বসুন।
খলিফা মৃদু হাসলেন। তিনি সবই বুঝতে পারলেন। জেরুজালেম নগরের শাসক সাধু সোফ্রোনিয়াস যদি আবু দাইয়ান কে খলিফা মনে করে তার কন্ঠেই ফুলের মালা পরিয়ে দেন।
খলিফা বললেন, আমরা মুসলমান। এই সম্মানই তো যথেষ্ট।
আবু দাইয়ান চুপ করে থাকে।
খলিফা উটের রশি ধরে জেরুজালেম নগরে প্রবেশ করলেন।
খলিফার পরনের তালি মারা ময়লা জোব্বা।
প্রসন্ন মুখে অনাবিল হাসি ...
ছোটবেলায় শোনা এই কাহিনীটি নতুন করে যেখানে পেলাম
পুনশ্চ:
খলিফা ওমর প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক এডোয়ার্ড গিবন তাঁর বিখ্যাত
The Decline and Fall of the Roman Empire গ্রন্থে লিখেছেন: “ Yet the abstinence and humility of Umar were not inferior to the virtues of Abu Bakr: his food consisted of barley bread or dates; his drink was water; he preached in a gown that was torn or tattered in twelve places; and a Persian satrap, who paid his homage as to the conqueror, found him asleep among the beggars on the steps of the mosque of Muslims ” (খলিফা ওমর-এর সংযম এবং বিনয়ে কোনও ক্রমেই খলিফা আবু বকর- এর চেয়ে কম নয়। তাঁর খাদ্য ছিল বার্লির রুটি কিংবা খেজুর এবং পানীয় ছিল পানি।
বারো জায়গায় তালি মারা জোব্বা পরে খলিফা বয়ান করতেন। একবার একজন পারসিক শাসনকর্তা বিজয়ী খলিফার কাছে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেলে দেখতে পান খলিফা মসজিদের সিঁড়িতে ভিখিরিদের পাশে ঘুমিয়ে আছেন। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।