ভাল আছি পটুয়াখালি জেলার বাউফল এলাকার সবাই ধীমান মিস্ত্রী কে এক নামে চেনে। নামকরা কাঠমিস্ত্রী। কাঠ খোদাই করে মূর্তি গড়ে। এত নিখুঁত কাজ, মনে হয় মূর্তি গুলো যেন এখনই নড়েচড়ে উঠবে। জন্মসুত্রেই পেয়েছে এই পেশা, ধিমান মিস্ত্রীর বাবা পরিমল কুস্টিয়ায় এক জমিদার বাড়ির সব জানালা দরজা এবং আসবাবপত্র একা হাতে খোদাই করেছিলেন।
সেই থেকেই তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পরে । মাঝে মাঝেই বিভিন্ন জমিদার বাড়ি থেকে ডাক আসত । একবার কুমিল্লার এক জমিদার বাড়িতে বিশাল এক পালঙ্ক গড়ে দিয়ে অনেক বকশিস পেয়েছিল। সব মিলিয়ে ভালোই চলছিল পরিমলের দিনকাল। ঘরে লক্ষি প্রতীমার মত সুন্দরী বউ কমলা।
এমন বউ রেখে দেশে দেশে ঘুরে বেরাতে আর ইচ্ছা করতনা। এদিকে বউ আবার পোয়াতি। কিন্তু বরিশালের জমিদার ঢাকায় বুরিগঙ্গার তীরে এক রংমহল বানাবে । সেখানে কাঠ খোদাই করে আসবাবপত্র বানাতে হবে পরিমলকেই। কি আর করা খুব মন খারাপ হলেও তাই যেতেই হল।
সন্ধ্যায় জমিদার বাবুর নায়েবের সাথে লঞ্চে করে ঢাকা রওনা দেয়। আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। কমলাকে সবাই টিপ্পনী করত পরিমল বুঝি রংমহলের কোনো বেশ্যার প্রেমে পড়ে কমলার কাছে আর ফিরে আসেনি। কিন্তু কমলা জানে পরিমল সেই মানুষই নয়। কমলাকে বড় ভালোবাসত পরিমল।
মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় জমিদার বাড়ি গিয়ে পরিমলের খোঁজ করবে। কিন্তু ভয় হয় ,জমিদার বাবুর নাকি আবার সুন্দরী মেয়েছেলের নেশা আছে। সেখানে গিয়ে কমলা যদি আরো বিপদে পড়ে। ধীমান কে নিয়ে বড় অভাবের সংসার কমলার। ধীমান একটু বড় হলেই কমলা বুঝতে পারে ধীমানের কাজের হাতও ওর বাবার মত ।
ছেলেকে এই পেশায় যেতে দেয়নি কমলা। স্বামীর মত একমাত্র ছেলেও যদি এভাবে ভিনদেশে গিয়ে ফিরে না আসে। কিন্তু ধিমানের কাজ থামিয়ে রাখতে পারেনি কমলা। বনের গাছ কেটে কেটে মূর্তি গড়ত ধীমান ছোটোবেলায়। এত জীবন্ত সব মূর্তি যেন স্বর্গ থেকে দেবদেবিরা সব মর্ত্যে নেমে এসেছে।
চারিদিকে ছড়িয়ে পরতে লাগলো ধীমানের প্রতীভার কথা। কিন্তু কমলা কিছুতেই ধিমান কে ওর কাছ থেকে দূরে যেতে দেবেনা । গেলো মাসে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছে। বউ খুব সংসারি মেয়ে। ছেলের বউ কমলাকে ইদানিং আর ঘরের কাজ করতে দেয়না।
কমলার ঘরটাকে কাঠের তৈরী দেবদেবীতে ভরিয়ে দিয়েছে ধীমান। সারাদিন তাদের পূজোতেই সময় কেটে যায়। ধীমান ঘরে বসেই মূর্তি গড়ে আর বিভিন্ন এলাকার মন্দির থেকে লোক এসে সেই মূর্তি কিনে নিয়ে যায়। সবাই বলে ধীমানের পয়মন্ত বউ। ঘরে আসার পর থেকেই সংসারের সব অভাব দুর হয়ে গিয়েছে।
এভাবে ধীমানের সংসার একেবারে খারাপ চলছিলনা। কিন্তু গত দুই বছর থেকে ধীমানের যেন কি একটা হয়েছে। ধীমানের ছেলেটার বয়স এখন ছয় বছর। এতটুকু হাতে মাটি দিয়ে মুর্তি গড়তে শিখেছে। ছেলের অবস্থা দেখে কমলার মনটা ভালোলাগেনা।
ধীমান কেমন অন্যমনষ্ক থাকে সারাদিন। দুই বছর হতে চলল কোনো মূর্তি তৈরী করেনা। সংসার যে কিভাবে চলে কমলা কিছুই বুঝতে পারেনা। ধীমান কে কিছু জিজ্ঞাসা করলেই রাগ করে ইদানিং। বাড়ির এক পাশে একটা কাঠের ঘর তৈরী করেছে।
এত নিখুত শিল্প ধীমান আগে আর কখনোই তৈরী করেনি । ঐ ঘরে কাউকে যেতে দেয়না । মেঝেতে কাঠের একটা চৌকি বিছানো । তার চারপাশেও কারুকাজ করা। কমলা দূর থেকে উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করে ।
ছোট একটা জানালা দিয়ে খুব বেশি আলো ঢোকেনা ঘরের ভেতর। কমলার ও বয়স কম হলনা। দুরের জিনিস ঝাপসা লাগে। ঘরের কাছে কেউ গেলেই খেঁকিয়ে ওঠে ধীমান। তাই কমলা ঘরের বেশি কাছে না যেয়ে ঘুরে চলে আসে।
আজ রাতে আবার চন্দ্র গ্রহণ। গ্রহণ হলে কমলার খুব ভয় হয়। পরিমল যে রাতে ঢাকা গিয়েছিল সে রাতেও ছিল চন্দ্রগ্রহণ। তড়িঘড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। গ্রহণের সময় ঘর থেকে বের হওয়া অশুভ ।
ঠাকুরমার কাছে গ্রহণের গল্প শুনে ধীমানের ছেলেটা খুব ভয় পেয়েছে। আজ তাই সে বাবার সাথে ঘুমাতে চায়। ধীমান আপত্তি করবে ভেবেছিল কমলা। কিন্তু ধীমানকে খুশি মনে হল। অন্ধকারে ধীমানের চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে।
কমলার ইদানিং ধীমানকে দেখে খুব ভয় হয়।
দুই বছর ধরে এমন এক পুর্ণ গ্রাস চন্দ্র গ্রহণের অপেক্ষায় আছে ধীমান। এমন রাতে কেউ ঘর থেকে বের হয়না। তাই নিশ্বব্দে কাজটা সেরে ফেলা যাবে সহজেই। সবাই ঘুমিয়ে গেছে।
জেগে আছে শুধু ধীমান একা। দুই বছর আগের কথা, মায়ের নিষেধ অমান্য করে ধীমান ভারত গিয়েছিল এক রাজবাড়িতে কাজ করতে। সেখান থেকে ফিরার পর থেকেই ধীমানের আচরনের এই পরিবর্তন। আকাশ ভরা জোছনা। ধীমানের ছোট জানালা ভেদ করা সামান্য আলো এসে পড়ছে ছেলেটার মুখের উপর।
ছেলেটার মুখের দিকে তাকালেই বুকের মধ্যে কেমন একটা টান লাগছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। মাঝে মাঝে দু একটা ব্যাঙ ডাকছে পাশের ডোবায়। আর কিছুক্ষন পরই শুরু হবে চন্দ্রগ্রহণ। চৌকির কোনার কাথা উঠিয়ে দেখে নিল দুইটা সোনার মোহর আর কিছু টাকা ঠিকমত আছে কিনা।
এগুলো যাবার আগে নন্দির হাতে তুলে দিয়ে যেতে হবে। এদিয়ে হয়ত বেশ কিছু দিন চলে যাবে তাদের । চাঁদের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করেছে। চৌকিটা সরাতে হবে নিঃশব্দে। চৌকিটা সরালেই নীচে নেমে যাবার সিঁড়ি।
অনেক দিন ধরে মাটি খুরে এই সিঁড়িটা তৈরী করেছে ধীমান। নিচে নেমে গেলে ছোটো একটা ঘর। ঘর ভরা সব কাঠের দেবদেবীর ভিড়ে একটা সোনার মূর্তি। ছোট্টো ছেলেটার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে সোনার মূর্তি দেখে। মূর্তির পাশেই খানিকটা কাদামাটি রাখা।
ধীমান: দুই বছর আগে আমি যে রাজবাড়ীতে কাজে গিয়েছিলাম সেখানের রাণীমা আমাকে এই সোনার মূর্তিটি দিয়েছে। আমি এর সেবায় অনেক কাঠের মূর্তি গড়েছি। আজ থেকে এর দেখাশোনার সব দায়িত্ব তোমার। এই মাটি দিয়ে তুমি মূর্তি গড়বে। আর আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানেই আমার জন্য অপেক্ষা করবে।
মাটির মূর্তি গড়ার নেশায় মত্ত ছেলে টেরও পায়নি কখন তাকে ফেলে বাবা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে গিয়েছে।
সিঁড়ির মুখে একটা পাটাতন বিছিয়ে তার উপর মাটি দিতে হবে। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। মেঝেতে মাটি সমান করে গোবর দিয়ে লেপে রাখতে হবে যেন কেউ কখনও সিঁড়ির মুখ খুঁজে না পায়। সব কিছু তৈরি করাই আছে।
তারপরও যেন চিন্তায় সারা শরীরে ঘামের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
সব কাজ শেষ করে স্নান সেরে ঘরে ঢুকতে যাবে এমন সময় কমলার কাশির আওয়াজে একটু চমকে উঠলো ধীমান। ইদানিং মাঝে মাঝেই কমলার কাশিটা বেড়ে রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয়। মায়ের হাতেই টাকা আর সোনার মোহরের পুটলিটা দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ল ধীমান। বনের মধ্যে দিয়ে হেটে যেতে একটু কস্টই হচ্ছে।
কিন্তু চেনা পথে যাওয়ার সাহস করেনি। আর একটু দূরেই লঞ্চ ঘাট। লঞ্চের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কোনো রকমে লঞ্চে উঠে পড়তে পারলেই সব চিন্তার শেষ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।